
নরসিংদী ফজরের নামজের পর রেললাইনে হাঁটতে বেড়িয়েছিলেন নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার পলাশতলী ইউনিয়নের কয়েকজন বাসিন্দা। তারা খাকচর দক্ষিণ পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে কমলপুর ও খাকচরের সীমানা দিয়ে যাওয়া ঢাকা-চট্টগাম-সিলেট রেললাইনে খণ্ড-বিখণ্ড অঙ্গ-প্রতঙ্গ পড়ে থাকতে দেখেন। একটু সামনে এগোলে ১০ ফুট দূরে দূরে তিনটি স্থানে পাঁচটি লাশ দেখতে পান তারা। পরে পুলিশকে খবর দেওয়া হলে তারা এসে লাশ উদ্ধার করে। পুলিশের পাশাপাশি রেলওয়ে পুলিশ, পিবিআই, সিআইডি ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। কোন সময়, কোন ট্রেনে কাটা পড়েছে; নাকি হত্যা করে লাশ এখানে ফেলে দেওয়া হয়েছে, তা এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। পরিচয় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত পাঁচ লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করেছে রেলওয়ে পুলিশ। গত সোমবার রাত ১২টায় নরসিংদী সদর হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে নরসিংদী রেলস্টেশন সংলগ্ন রেলওয়ে কবরস্থানে লাশগুলো দাফন করা হয়। এ ঘটনায় ভৈরব রেলওয়ে থানায় অপমৃত্যু মামলা করা হয়েছে। অপমৃত্যুর মামলা হলেও ঘটনাটি নিয়ে জনমনে রহস্য দানা বাঁধছে। আলোচনা চলছে গোটা জেলা ছাড়িয়ে দেশজুড়ে। যদিও মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে জানিয়েছেন, সব লাশই পুরুষের। তাদের বয়স আনুমানিক ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে হবে বলে জানিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, রায়পুরা মেথিকান্দা স্টেশন থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে ঘটনাস্থল কমলপুর। এর ঢাকামুখী রেললাইনের একপাশে জলাশয়ের সঙ্গে খাকচর দক্ষিণ পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। অপর পাশে নরসিংদী-রায়পুরা আঞ্চলিক সড়ক। এই সড়কে সিএনজিচালিত যানবাহন চলাচল করলেও স্থানীয় লোকজনের তেমন চলাচল নেই। ঘটনাস্থলের পাশে ঝোপঝাড়। দুই পাশে প্রায় আধা কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বাড়িঘর বা দোকানপাটও নেই। ঘটনাস্থলে কোনো সংযোগ সড়ক নেই। এখানে রাস্তা পারাপার হওয়ার সময় কেউ কাটা পড়ার কথা নয়। সেজন্য এটি ট্রেনে কাটা পড়ার ঘটনা, নাকি হত্যাকাণ্ড, তা নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ ধারণা করছেন, নিহত তরুণদের বেশভূষা ও পোশাক দেখে টোকাই শ্রেণির মনে হয়েছে। ট্রেনের ছাদে বা ইঞ্জিনে বসে তারা হয়তো যাচ্ছিলেন। দুই বগির মাঝখানে বা ইঞ্জিন থেকে পড়ে গিয়ে কাটা পড়ে মারা গেছেন। তবে এভাবে পাঁচজনের মৃত্যুর বিষয়টি রহস্যজনক। আবার কেউ বলছেন, হত্যার পর তাদের লাশ এখানে ফেলে গেছে কেউ। পুলিশের বিষয়টি তদন্ত করে দেখা দরকার। রেললাইনের পাশে বসবাসকারী রফিক মিয়া বলেন, দীর্ঘদিন ধরে রায়পুরা স্টেশন এলাকায় বসবাস করি। কিন্তু কখনো এত মানুষের এমন মৃত্যু দেখিনি। তারা কীভাবে মারা গেছে বুঝতে পারছি না। সকালে উঠে লাশ দেখতে পাই। মনে হচ্ছে, হত্যার পর তাদের লাশ কেউ এই জায়গায় ফেলে গেছে। স্থানীয় আজিজুর রহমান নামে এক ব্যক্তি বলেন, সকালে রেললাইনের পাশে লাশ পড়ে থাকতে দেখে থানায় খবর দেই। ধারণা করছি, রাতে ট্রেনে কাটা পড়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু একসঙ্গে এত মানুষ কীভাবে মারা গেলেন মাথায় আসছে না। মেথিকান্দা রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার আশরাফ আলী বলেন, ভোর ৫টা ২২ মিনিটে উপবন, ৫টা ৪৮ মিনিটে ঢাকা মেইল ও সাড়ে ৬টায় তিতাস ঢাকার উদ্দেশ্যে মেথিকান্দা স্টেশন পার হয়েছে। এর মধ্যে কোনো ট্রেনে কাটা পড়ে তাদের মৃত্যু হতে পারে। তারা ট্রেনের ছাঁদ থেকে পিছলে পড়ে কাটা পড়েছেন, নাকি রেললাইনে বসে থাকা অবস্থায় কাটা পড়েছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে নিহত ব্যক্তিরা স্থানীয় কেউ নন বলে জানা গেছে। লাশ উদ্ধারের আগে ওই রেললাইন দিয়ে আরও তিনটি ট্রেন চলাচল করেছে। পুলিশ ও রেল কর্তৃপক্ষের লোকজনের সঙ্গে কথা বলা হলেও পাঁচজনের মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি। সর্বশেষ স্টেশনে থাকা সিসিটিভির ফুটেজ পর্যালোচনা করা হয়। ভোরে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী মেইল ট্রেনটি মেথিকান্দা স্টেশন অতিক্রম করার সময় সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, ট্রেনটির ছাদে কয়েকজন যাত্রী ছিলেন। এই যাত্রীরাই মারা গেছেন কিনা সেটি নিশ্চিত হতে পারেনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। প্রত্যক্ষদর্শী দেলোয়ার হোসেন বলেন, সকালে রেললাইনের পাশে লোকজনের ভিড় দেখে এগিয়ে আসি। এসে দেখি রেললাইনে মানুষের শরীরের বিচ্ছিন্ন কিছু অংশ ও রক্ত। একটু সামনে এগুতেই একটি লাশ দেখা যায়। পরে আরেকটু সামনে গেলে আরও চারটি লাশ দেখা যায়। এটি পারাপারের কোনো রাস্তা নয়। তাই এই মৃত্যুগুলো রহস্যজনক মনে হচ্ছে। এলাকাবাসী আমিনুল ইসলাম বলেন, পাঁচজন লোক মারা গেছেন শুনে এখানে দেখতে এসেছি। যে জায়গাটিতে মারা গেছেন, এটি চলাচলের রাস্তা নয়। এমনকি তারা এলাকার লোকও নন। তারা কীভাবে এখানে এসেছেন কে জানে। নরসিংদী রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. শহীদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, আমরা ঘটনাস্থলে এসে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শরীরগুলো একত্র করেছি। এরপরই পরিচয় শনাক্তের জন্য নরসিংদীর পিবিআই সদস্যদের খবর জানিয়েছি। বেলা সাড়ে ১১টায় তারা ঘটনাস্থলে এসে লাশ শনাক্তের প্রক্রিয়া শুরু করে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন রেলওয়ের ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন। এ সময় তিনি বলেন, নিহত ব্যক্তিদের লাশের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টায় আঙ্গুলের ছাপ নিয়েছে পিবিআই। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এরা ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের ধারণা, ছাঁদ থেকে পড়ে লাশ এভাবে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয় না। আমরা সব বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত করছি। ঘটনার সময় চলাচলকারী ট্রেন, টিটি ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে আমরা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি। আশা করছি দ্রুতই রহস্য উদঘাটন করা যাবে। এছাড়া ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) অনির্বাণ চৌধুরী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) সামসুল আরেফীন, রায়পুরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইকবাল হাসান, সহকারী কমিশনার (ভূমি) শফিকুল ইসলাম, রায়পুরা থানার ওসি সাফায়েত হোসেন ও ভৈরব রেলওয়ে থানার ওসি আবদুল আলীম।