
হু হু করে বাড়ছে দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি। ইতোমধ্যে প্লাবিত হয়েছে বিভিন্ন জেলার নিম্নাঞ্চল। বন্যা আতঙ্কে দিন কাটছে নদীর পাড়ের মানুষের। বৃষ্টি আর উজানের ঢলে বিপদসীমার উপরে প্রায় অধিকাংশ নদীর পানি। ভারী বৃষ্টিপাতে মৌলভীবাজার জেলার তিনটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যার কারণে নদী তীরবর্তী লোকালয়ের তিন লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার এইচএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র কাচালং সরকারি কলেজ ক্যাম্পাস বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এই কলেজের বিভিন্ন বিভাগের ৪৬৮ জন শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় অংশ নেয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। চলতি বর্ষা মৌসুমে তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া পয়েন্টে একাধিকবার বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। ওই পয়েন্টে বিপৎসীমা ধরা হয়েছিল ২৮ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। সেটা গত মঙ্গলবার থেকে বাড়িয়ে কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার পরিমাপ নির্ধারণ করা হয়েছে ২৯ দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার। ৫৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি করে বিপৎসীমার নতুন পরিমাপ নির্ধারণ করা হয়েছে।
আমাদের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৬ সেন্টিমিটার, চিলমারী পয়েন্টে ২৫ সেন্টিমিটার ও হাতিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে দুধকুমার, তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেও বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধির ফলে তলিয়ে গেছে নদের অববাহিকার চর, দ্বীপ চর ও নিম্নাঞ্চল। অনেক বসতবাড়িতে পানি চলে এসেছে। কাঁচা সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ-ব্যবস্থা ব্যাহত হয়ে পড়েছে। নদী তীরবর্তী বসতবাড়িতে পানি উঠায় গবাদিপশু আর আসবাবপত্র নিয়ে পার্শ্ববর্তী বাঁধে আশ্রয় নিলেও অনেকে বসতবাড়িতে উঁচু মাচান করে সেখানেই রয়েছেন। উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের বালাডোবা চরের আনোয়ার বেগম বলেন, গত দুই দিন থেকে ঘরের ভেতর পানি। মাচান উঁচু করে সেখানেই আছি সবাই। খাওয়া-দাওয়া ও যাতায়াতের খুব সমস্যা হচ্ছে। ঘর থেকে বের হতে গেলে নৌকা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
বেগমগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. বাবলু মিয়া বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধির ফলে আমার ইউনিয়নের অবস্থা খুব খারাপ। কয়েকটি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অসংখ্য পরিবারের ঘরে পানি প্রবেশ করেছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান জানান, কুড়িগ্রামের সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ৭২ ঘণ্টা ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
আমাদের মৌলভীবাজার প্রতিনিধি জানান, উজানের ঢল আর ভারী বৃষ্টিপাতে মৌলভীবাজার জেলার তিনটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যার কারণে নদী তীরবর্তী লোকালয়ের তিন লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত মৌলভীবাজার জেলার মনু, কুশিয়ারা ও জুড়ী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, দুপুর ১২টায় মনু নদীর পানি রেলওয়ে ব্রিজে বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার, চাঁদনীঘাট ব্রিজে বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধলাই নদীর পানি রেলওয়ে ব্রিজে বিপৎসীমার ১৬৮ সেন্টিমিটার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারা নদী শেরপুর ব্রিজে বিপৎসীমার ১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জুড়ী নদীর পানি বিপৎসীমার ১৯০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলার পাঁচটি উপজেলায় বন্যা কবলিত হয়েছে। তিন লক্ষাধিক মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মৌলভীবাজার কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাবেদ ইকবাল বলেন, ভারী বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢল নামার কারণে নদ-নদী ও হাওরের পানি আবারও বাড়ছে। কুলাউড়া ও জুড়ীর পানি হাকালুকি হাওরে গিয়ে পড়ে। কিন্তু হাওরের পানি ধীর গতিতে নামছে। ওই হাওরের পানি নামে কুশিয়ারা নদী দিয়ে।
আমাদের রাঙামাটি প্রতিনিধি জানান, রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার এইচএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র কাচালং সরকারি কলেজ ক্যাম্পাস বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এই কলেজের বিভিন্ন বিভাগের ৪৬৮ জন শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় অংশ নেয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আজ বৃহস্পতিবার এই কেন্দ্রে রুটিন অনুযায়ী এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ইংরেজি ১ম পত্র পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে গতকাল বুধবার বাঘাইছড়ির নিম্ন অঞ্চল প্লাবিত হয়ে কলেজ ও আশপাশের এলাকার সব সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। কলেজের প্রধান সড়কটি ৫ ফুট পানির নিচে ডুবে রয়েছে। এছাড়া কলেজের নিচ তলার সবকটি পরীক্ষা কেন্দ্র পানিতে তলিয়ে গেছে। শুধু এইচএসসি পরীক্ষা নয়, কলেজে আজ থেকে শুরু হচ্ছে ডিগ্রি ২য় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা, অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তাদের পরীক্ষাও।
কাচালং সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, আমরা খুবই চিন্তিত বন্যার কারণে ৪৬৮ জন শিক্ষার্থীর পরীক্ষা কিভাবে নেব বুঝতে পারছি না। ইতোমধ্যে বন্যার বিষয়টি বোর্ড কর্তৃপক্ষ ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে, কিন্তু পরীক্ষা বন্ধের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আসেনি। এছাড়া ডিগ্রি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথা রয়েছে ১৭৪ জন। এইচএসসি পরীক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম বলেন, পানিবন্দি অবস্থায় আছি, ঘরে পড়াশোনা করার কোনো পরিবেশ নেই। শুধু আরিফুল নয়, উপজেলার প্রায় ঘরেই এখন এই চিত্র লক্ষ্য করা গেছে।
বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিরীন আক্তার বলেন, বিষয়টি আমি ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসককে জানিয়েছি। দেখা যাক কী সিদ্ধান্ত আসে।
আমাদের রংপুর প্রতিনিধি জানান, চলতি বর্ষা মৌসুমে তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া পয়েন্টে একাধিকবার বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। ওই পয়েন্টে বিপৎসীমা ধরা হয়েছিল ২৮ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। সেটা গত মঙ্গলবার থেকে বাড়িয়ে কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার পরিমাপ নির্ধারণ করা হয়েছে ২৯ দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার। ৫৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি করে বিপৎসীমার নতুন পরিমাপ নির্ধারণ করা হয়েছে। এতদিন তিস্তার কাউনিয়া পয়েন্টে কেন বার বার পানি বিপৎসীমার ওপরে যাচ্ছিল। এর কারণ খুঁজে পাওয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ড নতুন বিপৎসীমা নির্ধারণ করেছে বলে জানা গেছে।
তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত ডালিয়া ব্যারেজ চালু হয়েছে ১৯৯২ সালে। ডালিয়া ব্যারেজ চালুর পর থেকে বর্ষা মৌসুমে সর্ব প্রথম পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে আসছে ডালিয়া পয়েন্টে। তিন দশকের বেশি সময় ধরে এই অবস্থা চলে আসলেও চলতি বর্ষা মৌসুমে ব্যতিক্রম ঘটেছে। তিস্তার পানি ডালিয়া পয়েন্টে প্রথমে বিপৎসীমা অতিক্রম না করে কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। এর কারণ কী? পানি উন্নয়ন বোর্ড তা অনুসন্ধান করে গত মঙ্গলবার ঢাকা থেকে হাইড্রোলজি বিভাগ ওই পয়েন্টে পানি পরিমাপের লেভেল বাড়িয়ে দেয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য মতে, রংপুরের কাউনিয়ার তিস্তা রেল সেতু এলাকায় কয়েকটি চর জেগেছে। চরের কারণে পানির লেভেল ওপরে উঠে যাচ্ছে। পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করলেও নদীর দুই কূল উপচে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেনি। বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডের নজরে এলে তারা ঢাকার হাউড্রোলজি বিভাগের সাথে যোগাযোগ করে। অনুসন্ধান করে দেখতে পান জেগে উঠা চরের কারণে এমনটা হচ্ছে। তাই পানি পরিমাপের লেভেল বাড়িয়ে দিয়ে নতুন করে বিপৎসীমা নির্ধারণ করা হয়।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েকদিন ধরে থেমে থেমে হয়ে যাওয়া বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে কাউনিয়া উপজেলায় তিস্তা নদী তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে নদীপাড়ের মানুষ। তিস্তা নদী বেষ্টিত কাউনিয়া উপজেলার গদাই এলাকার প্রায় কয়েক শতাধিক পরিবার ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া চর এলাকায় কয়েকশ’ পরিবারের বসতভিটা নদীগর্ভে চলে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানি বলেন, অসময়ের বন্যা ও ভাঙনে প্রতি বছর এক লাখ কোটি টাকার সম্পদ তিস্তার গর্ভে চলে যায়। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য নদীখনন, সংরক্ষণ ও তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা ছাড়া বিকল্প নেই।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রংপুর বিভাগের আট জেলায় গেল জুনে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ধরা হয় ৪৮৯ মিলিমিটার। কিন্তু বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৭৩৫ মিলিমিটার। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ২৪৬ মিলিমিটার বেশি।
এদিকে পাউবোর বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আবহাওয়া সংস্থাসমূহের তথ্য অনুযায়ী, দেশের উত্তরাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন উজানে আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীসমূহের পানি সমতল সময় বিশেষে বৃদ্ধি পেয়ে কতিপয় পয়েন্টে স্বল্পমেয়াদে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।
সূত্র আরো জানায়, গতকাল দুপুর ১২টা থেকে তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ৩১ সেন্টিমিটার নিচ এবং সকাল ৬টায় ৩৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। কাউনিয়া পয়েন্টে নতুন পরিমাপ হিসাবে বিপৎসীমা ২৯ দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার ধরা হয়।
অন্যদিকে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে গতকাল দুপুর ১২টায় পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫১ দশমিক ৯২ সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে সকাল ৯টায় ৫১ দশমিক ৯৬ সেন্টিমিটার এবং সকাল ৬টায় ৫১ দশমিক ৯৮ সেন্টিমিটারে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়। এ পয়েন্টে ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হলে বিপৎসীমা অতিক্রম করে।
এদিকে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রংপুর জেলার কাউনিয়া, পীরগাছা ও গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তা অববাহিকার নিম্নাঞ্চল, চর ও দ্বীপ চরের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তিস্তা নদীতে পানি বাড়া-কমায় ভাঙনের মুখে পড়েছে বিভিন্ন এলাকা। বেশ কিছু চরাঞ্চলের বাড়িঘরের চারপাশে পানি প্রবেশ করার খবর পাওয়া গেছে। তলিয়ে গেছে গ্রামীণ সড়ক। ডুবে গেছে ওইসব এলাকার সবজিক্ষেত।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, ডালিয়ার পরিবর্তে কাউনিয়া পয়েন্টের পানি কেন বিপৎসীমা অতিক্রম করছে এর কারণ জানতে হাইড্রোলজি বিভাগে জানানো হয়েছিল। তারা নতুন করে বিপৎসীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে।
রংপুর বিভাগীয় কমিশনার জাকির হোসেন বলেন, উজানে ভারী বৃষ্টিপাত পাহাড়ি ঢলের কারণে উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, ঘাঘট, করতোয়া, ব্রহ্মপুত্রসহ সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ভারী বন্যার আভাস পাওয়া যায়নি। তারপরও সরকারিভাবে সব ধরনের আগাম প্রস্তুতি নেয়া আছে, যাতে বন্যায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক নদী পাড়ের পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখা হচ্ছে।
আমাদের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৬ সেন্টিমিটার, চিলমারী পয়েন্টে ২৫ সেন্টিমিটার ও হাতিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে দুধকুমার, তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেও বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধির ফলে তলিয়ে গেছে নদের অববাহিকার চর, দ্বীপ চর ও নিম্নাঞ্চল। অনেক বসতবাড়িতে পানি চলে এসেছে। কাঁচা সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ-ব্যবস্থা ব্যাহত হয়ে পড়েছে। নদী তীরবর্তী বসতবাড়িতে পানি উঠায় গবাদিপশু আর আসবাবপত্র নিয়ে পার্শ্ববর্তী বাঁধে আশ্রয় নিলেও অনেকে বসতবাড়িতে উঁচু মাচান করে সেখানেই রয়েছেন। উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের বালাডোবা চরের আনোয়ার বেগম বলেন, গত দুই দিন থেকে ঘরের ভেতর পানি। মাচান উঁচু করে সেখানেই আছি সবাই। খাওয়া-দাওয়া ও যাতায়াতের খুব সমস্যা হচ্ছে। ঘর থেকে বের হতে গেলে নৌকা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
বেগমগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. বাবলু মিয়া বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধির ফলে আমার ইউনিয়নের অবস্থা খুব খারাপ। কয়েকটি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অসংখ্য পরিবারের ঘরে পানি প্রবেশ করেছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান জানান, কুড়িগ্রামের সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ৭২ ঘণ্টা ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
আমাদের মৌলভীবাজার প্রতিনিধি জানান, উজানের ঢল আর ভারী বৃষ্টিপাতে মৌলভীবাজার জেলার তিনটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যার কারণে নদী তীরবর্তী লোকালয়ের তিন লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত মৌলভীবাজার জেলার মনু, কুশিয়ারা ও জুড়ী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, দুপুর ১২টায় মনু নদীর পানি রেলওয়ে ব্রিজে বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার, চাঁদনীঘাট ব্রিজে বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধলাই নদীর পানি রেলওয়ে ব্রিজে বিপৎসীমার ১৬৮ সেন্টিমিটার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারা নদী শেরপুর ব্রিজে বিপৎসীমার ১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জুড়ী নদীর পানি বিপৎসীমার ১৯০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলার পাঁচটি উপজেলায় বন্যা কবলিত হয়েছে। তিন লক্ষাধিক মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মৌলভীবাজার কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাবেদ ইকবাল বলেন, ভারী বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢল নামার কারণে নদ-নদী ও হাওরের পানি আবারও বাড়ছে। কুলাউড়া ও জুড়ীর পানি হাকালুকি হাওরে গিয়ে পড়ে। কিন্তু হাওরের পানি ধীর গতিতে নামছে। ওই হাওরের পানি নামে কুশিয়ারা নদী দিয়ে।
আমাদের রাঙামাটি প্রতিনিধি জানান, রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার এইচএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র কাচালং সরকারি কলেজ ক্যাম্পাস বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এই কলেজের বিভিন্ন বিভাগের ৪৬৮ জন শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় অংশ নেয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আজ বৃহস্পতিবার এই কেন্দ্রে রুটিন অনুযায়ী এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ইংরেজি ১ম পত্র পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে গতকাল বুধবার বাঘাইছড়ির নিম্ন অঞ্চল প্লাবিত হয়ে কলেজ ও আশপাশের এলাকার সব সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। কলেজের প্রধান সড়কটি ৫ ফুট পানির নিচে ডুবে রয়েছে। এছাড়া কলেজের নিচ তলার সবকটি পরীক্ষা কেন্দ্র পানিতে তলিয়ে গেছে। শুধু এইচএসসি পরীক্ষা নয়, কলেজে আজ থেকে শুরু হচ্ছে ডিগ্রি ২য় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা, অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তাদের পরীক্ষাও।
কাচালং সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, আমরা খুবই চিন্তিত বন্যার কারণে ৪৬৮ জন শিক্ষার্থীর পরীক্ষা কিভাবে নেব বুঝতে পারছি না। ইতোমধ্যে বন্যার বিষয়টি বোর্ড কর্তৃপক্ষ ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে, কিন্তু পরীক্ষা বন্ধের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আসেনি। এছাড়া ডিগ্রি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথা রয়েছে ১৭৪ জন। এইচএসসি পরীক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম বলেন, পানিবন্দি অবস্থায় আছি, ঘরে পড়াশোনা করার কোনো পরিবেশ নেই। শুধু আরিফুল নয়, উপজেলার প্রায় ঘরেই এখন এই চিত্র লক্ষ্য করা গেছে।
বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিরীন আক্তার বলেন, বিষয়টি আমি ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসককে জানিয়েছি। দেখা যাক কী সিদ্ধান্ত আসে।
আমাদের রংপুর প্রতিনিধি জানান, চলতি বর্ষা মৌসুমে তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া পয়েন্টে একাধিকবার বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। ওই পয়েন্টে বিপৎসীমা ধরা হয়েছিল ২৮ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। সেটা গত মঙ্গলবার থেকে বাড়িয়ে কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার পরিমাপ নির্ধারণ করা হয়েছে ২৯ দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার। ৫৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি করে বিপৎসীমার নতুন পরিমাপ নির্ধারণ করা হয়েছে। এতদিন তিস্তার কাউনিয়া পয়েন্টে কেন বার বার পানি বিপৎসীমার ওপরে যাচ্ছিল। এর কারণ খুঁজে পাওয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ড নতুন বিপৎসীমা নির্ধারণ করেছে বলে জানা গেছে।
তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত ডালিয়া ব্যারেজ চালু হয়েছে ১৯৯২ সালে। ডালিয়া ব্যারেজ চালুর পর থেকে বর্ষা মৌসুমে সর্ব প্রথম পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে আসছে ডালিয়া পয়েন্টে। তিন দশকের বেশি সময় ধরে এই অবস্থা চলে আসলেও চলতি বর্ষা মৌসুমে ব্যতিক্রম ঘটেছে। তিস্তার পানি ডালিয়া পয়েন্টে প্রথমে বিপৎসীমা অতিক্রম না করে কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। এর কারণ কী? পানি উন্নয়ন বোর্ড তা অনুসন্ধান করে গত মঙ্গলবার ঢাকা থেকে হাইড্রোলজি বিভাগ ওই পয়েন্টে পানি পরিমাপের লেভেল বাড়িয়ে দেয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য মতে, রংপুরের কাউনিয়ার তিস্তা রেল সেতু এলাকায় কয়েকটি চর জেগেছে। চরের কারণে পানির লেভেল ওপরে উঠে যাচ্ছে। পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করলেও নদীর দুই কূল উপচে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেনি। বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডের নজরে এলে তারা ঢাকার হাউড্রোলজি বিভাগের সাথে যোগাযোগ করে। অনুসন্ধান করে দেখতে পান জেগে উঠা চরের কারণে এমনটা হচ্ছে। তাই পানি পরিমাপের লেভেল বাড়িয়ে দিয়ে নতুন করে বিপৎসীমা নির্ধারণ করা হয়।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েকদিন ধরে থেমে থেমে হয়ে যাওয়া বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে কাউনিয়া উপজেলায় তিস্তা নদী তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে নদীপাড়ের মানুষ। তিস্তা নদী বেষ্টিত কাউনিয়া উপজেলার গদাই এলাকার প্রায় কয়েক শতাধিক পরিবার ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া চর এলাকায় কয়েকশ’ পরিবারের বসতভিটা নদীগর্ভে চলে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানি বলেন, অসময়ের বন্যা ও ভাঙনে প্রতি বছর এক লাখ কোটি টাকার সম্পদ তিস্তার গর্ভে চলে যায়। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য নদীখনন, সংরক্ষণ ও তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা ছাড়া বিকল্প নেই।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রংপুর বিভাগের আট জেলায় গেল জুনে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ধরা হয় ৪৮৯ মিলিমিটার। কিন্তু বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৭৩৫ মিলিমিটার। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ২৪৬ মিলিমিটার বেশি।
এদিকে পাউবোর বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আবহাওয়া সংস্থাসমূহের তথ্য অনুযায়ী, দেশের উত্তরাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন উজানে আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীসমূহের পানি সমতল সময় বিশেষে বৃদ্ধি পেয়ে কতিপয় পয়েন্টে স্বল্পমেয়াদে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।
সূত্র আরো জানায়, গতকাল দুপুর ১২টা থেকে তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ৩১ সেন্টিমিটার নিচ এবং সকাল ৬টায় ৩৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। কাউনিয়া পয়েন্টে নতুন পরিমাপ হিসাবে বিপৎসীমা ২৯ দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার ধরা হয়।
অন্যদিকে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে গতকাল দুপুর ১২টায় পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫১ দশমিক ৯২ সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে সকাল ৯টায় ৫১ দশমিক ৯৬ সেন্টিমিটার এবং সকাল ৬টায় ৫১ দশমিক ৯৮ সেন্টিমিটারে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়। এ পয়েন্টে ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হলে বিপৎসীমা অতিক্রম করে।
এদিকে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রংপুর জেলার কাউনিয়া, পীরগাছা ও গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তা অববাহিকার নিম্নাঞ্চল, চর ও দ্বীপ চরের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তিস্তা নদীতে পানি বাড়া-কমায় ভাঙনের মুখে পড়েছে বিভিন্ন এলাকা। বেশ কিছু চরাঞ্চলের বাড়িঘরের চারপাশে পানি প্রবেশ করার খবর পাওয়া গেছে। তলিয়ে গেছে গ্রামীণ সড়ক। ডুবে গেছে ওইসব এলাকার সবজিক্ষেত।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, ডালিয়ার পরিবর্তে কাউনিয়া পয়েন্টের পানি কেন বিপৎসীমা অতিক্রম করছে এর কারণ জানতে হাইড্রোলজি বিভাগে জানানো হয়েছিল। তারা নতুন করে বিপৎসীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে।
রংপুর বিভাগীয় কমিশনার জাকির হোসেন বলেন, উজানে ভারী বৃষ্টিপাত পাহাড়ি ঢলের কারণে উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, ঘাঘট, করতোয়া, ব্রহ্মপুত্রসহ সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ভারী বন্যার আভাস পাওয়া যায়নি। তারপরও সরকারিভাবে সব ধরনের আগাম প্রস্তুতি নেয়া আছে, যাতে বন্যায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক নদী পাড়ের পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখা হচ্ছে।