
গত কয়েক দশকেরও বেশি সময় ধরে পাশ্চাত্যে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে চলেছে খাদ্য-সংশ্লিষ্ট রোগের প্রকোপ। বিস্তার ঘটেছে জানা-অজানা খাদ্যবাহিত জীবাণুর। মাত্রাতিরিক্ত ওজনের হার বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। স্থুলতা থেকে উদ্ভূত সমস্যা নিরসনে ব্যয় হচ্ছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসবের নেপথ্যে রয়েছে রসনা তৃপ্তিদায়ক ফাস্টফুড-এর উত্থান। বিশ্বজুড়ে যার আরেক নাম ‘জাংক ফুড’।
স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও তরুণ-তরুণীরা বেশি আসক্ত হচ্ছে এই খাবারের প্রতি। বাজারে নানা ধরনের ফাস্টফুড থাকলেও কোনটাতে কী পরিমাণ খাদ্য ক্যালরি রয়েছে তার উল্লেখ থাকছে না। এ কারণে মানুষ এসব খাবার খেয়ে অস্বাভাবিক মোটা হয়ে যাচ্ছে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাইপারটেনশন ও শ্বাসকষ্টসহ নানা অসংক্রামণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে। এসব খাদ্য তৈরি থেকে শুরু করে বাজারজাতে সরকারের কোনো সংস্থারই নজর নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের প্রতিটি স্কুল-কলেজের সামনে ফাস্টফুডের দোকান রয়েছে। এসব দোকান থেকে খাবার কিনে খাচ্ছে শিশু ও তাদের অভিভাবকরা। এসব খাবারের গায়ে ক্যালরির পরিমাণ উল্লেখ নেই। এগুলো খেয়ে শিশুসহ সবাই অস্বাভাবিক মোটা হয়ে যাচ্ছে। ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সারসহ নানা অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের মতে, ফাস্টফুডে আছে স্যাকারিন, টেস্টিং সল্ট, চর্বি ও চিনি। একই সঙ্গে ফাস্টফুডের প্রিজারভেটিভ, কেমিক্যাল, ঘনচিনি ও ক্ষতিকর রং মারাত্মক অসুখ-বিসুখ সৃষ্টি করে শরীরে। এসব খাবারে নষ্ট হয় দাঁত, লিভার, কিডনিসহ মূল্যবান অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।
ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞরা জানান, অস্বাভাবিক মোটা হওয়ার কারণে মানুষের শরীরে ইনসুলিন নামক হরমোন ঢুকতে পারছে না। এতে জীবকোষ নষ্ট হয়ে টাইপ-১ ডায়বেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এদের শরীরে ইনসুলিন ব্যবহারের বিকল্প নেই। এই ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের হার কম। টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার অনেক বেশি। খাদ্যাভাস, কায়িক পরিশ্রম, লাইফ স্টাইল পরিবর্তন করে এই ধরনের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে দিনে প্রায় দুই লাখ মানুষ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়। সে দেশের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)-এর হিসাব মতে, প্রতিবছর এক-চতুর্থাংশেরও বেশি আমেরিকান ফুড পয়জনিং-এর শিকার হন, যার অধিকাংশই কর্তৃপক্ষের গোচরে আসে না এবং যথাযথভাবে রোগনির্ণয়ও হয় না প্রায়শই। দু-একটা যা-ও হয়, সেটি প্রকৃত সংখ্যার নগণ্য অংশ মাত্র।
চটজলদি বা ঝটপট খাবার সবাই চেনে ফাস্টফুড নামে। এর প্রভাবেই পাল্টে গেছে গ্রামের বাজার কিংবা শহুরে আড্ডার রসনা ঐতিহ্য। ঠিক তার ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছে স্থুলতা, ক্ষুধামন্দা, কর্মে অবসাদ। বাড়ছে অসুখের খরচ। তবে এসব স্বাস্থ্য ঝুঁকি মাথায় নিয়েও ফাস্টফুড ঘিরে দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে ত্রিশ লাখের বেশি। যদিও রেস্তোরাঁয় খাবারের গ্রেডিং চালুর বাস্তবায়ন চলছে ধীরগতিতে।
একজন বিক্রেতা বলেন, স্ট্রিটফুড, থাইফুড, এরাবিয়ান ফুড আছে, মানে হচ্ছে এখানে সবধরনের ফুড পাওয়া যায়।
একজন ক্রেতা বলেন, স্ট্রিটফুডগুলোর হাইজিনের ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন থাকে। এই খাবারের হেলথ ইস্যু থাকবে, তবে সেটা যদি লিমিট অনুযায়ী খাওয়া হয়, তাহলে এটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়।
ফাস্টফুডের যে জাদু পুরো দেশকে আচ্ছন্ন করেছে তার বাজিকর হলো ঢাকা। এখানে প্রথম ফাস্টফুড এসেছিল সুইচ বেকারির কাঁচঘরে। অলিম্পিয়ার হ্যাম বার্গার, ফ্রেন্স ও সুইচ বেকারির হাত ধরে এসেছিল বার্গার-হটডগ। ৪ দশক ধরে সুইচ বেকারি ব্যাবসা করে আসছে সুনামের সঙ্গে। সময়ের সাথে তাদের কাঁচঘরে তাল মিলিয়ে এসেছে নতুন নতুন ফাস্টফুড।
ফাস্টফুডের তালিকা কেবলই লম্বা হয়েছে এরপর থেকে। চারদশকে রেস্তোরার বাইরে ফাস্টফুড ডালপালা মেলেছে ফুটপাত, পার্ক, বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে। যাতে প্রলুব্ধ হয়ে ভোজন রসিক ডুবেছে মোহে। নিয়মিত অভ্যাসে আপন করে নিয়েছে অসংক্রামক ব্যাধি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলের এক গবেষণার তথ্য বলছে গ্যাস্ট্রিক, ফ্যাটি লিভার, কোলন ক্যান্সার, ডায়াবেটিসের মতো ব্যধি লাফিয়ে বাড়ছে। দেশে মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশই অসংক্রামক রোগে। বিএসএমএমইউ এর পৃথক এক গবেষণায় পাওয়া যায় ফাস্টফুডে ক্ষতিকর উপাদানের উচ্চমাত্রা।
পাশাপাশি অগ্নাশয়, পেটের জ্বালায় ঘি ঢালা ফাস্টফুডের সমান্তরালে বেড়েছে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের বাজার। ২০২১ পর্যন্ত পাঁচ বছরে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ বিক্রি বেড়েছে ১২ শতাংশ হারে। একই প্রবৃদ্ধি থাকলে বর্তমানে দেশে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের বাজার দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার।
ক্ষুধামন্দা, স্থুলতা, উচ্চ রক্তচাপ, অনিদ্রার মতো শারীরিক সমস্যা নিয়েও রাজধানীবাসি নিয়মিত মুখে তুলছে ফাস্টফুড। সময় স্বল্পতা, সহজলভ্যতার অজুহাতে ভুলতে বসেছেন দেশি ও সুষম খাবার।
একজন ভোক্তা বলেন, আমি কয়েকদিন আগেই ভারত থেকে ডাক্তার দেখিয়ে আসছি। এখন একটু সাবধানে থাকছি। কারণ আবার এই গ্যাস্ট্রিক যেন কোনো সমস্যা না করে। আগে এই ফাস্টফুডের খাবার দিয়েই নাস্তা করতাম। আবার দেখা যেত রাতের খাবার বাইরে থেকেই খেয়ে যেতাম, সেজন্য বাসায় খেতাম না।
গড়ে ওঠা বিরুপ খাদ্যভ্যাসের কারণে বছর বছর চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। গত দুই দশকে মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় বেড়েছে ৭ গুণ। যার ৬৪ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে শুধু ওষুধে। সরকার এ খাতে বরাদ্দ বাড়ালেও দেশের মোট স্বাস্থ্য ব্যায়ের দুই-তৃতীয়াংশ ব্যয় হয় ব্যক্তির নিজ খরচে। চিকিৎসা বলছেন ব্যক্তি পর্যায়ে চিকিৎসা ও ওষুধ খরচ বৃদ্ধির কারণ খাদ্যভ্যাসের পরিবর্তন। ফাস্টফুডে আসক্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু ও তরুণরা।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের গ্যাট্রোএন্টেরোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, এই ফাস্টফুডের কারণে নানা ধরনের রোগ হতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ফ্যাটি লিভার। এতে লিভারে চর্বি জমে যায়। এছাড়াও আরও কিছু অসুখ আছে যেগুলো ফাস্টফুড থেকে খুব দ্রুত হয়। এগুলো থেকে লিভার ক্যান্সার হয়ে যেতে পারে।
তবে এসব স্বাস্থ্য ঝুঁকি মাথায় নিয়েও ফাস্টফুডকে কেন্দ্র করে যে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার প্রসার ঘটেছে তাতে প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষের রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়েছে বলে দাবি করছে রেস্টুরেন্ট ওনার্স এসোসিয়েশন। ২০১০ এর পর এ সেবা খাতে ১২ লাখ নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। বিবিএস এর সবশেষ হালনাগাদ বলছে ১১ বছর ব্যবধানে দেশে রেস্টুরেন্ট সংখ্যা ২ লাখ ৭৫ হাজার থেকে ৪ লাখ ৩৬ হাজারে পৌঁছেছে। এ খাতে বছরে বিক্রি ৩৮ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপির ১ শতাংশের কিছু বেশি। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে রেস্তোরাঁয় খাবারে গ্রেডিং চালু করলেও তা সীমাবদ্ধ ভালো রেস্তোরাঁর মধ্যেই।
বাংলাদেশ রেস্তোঁরা মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের মাস্টার শেফ নেই বললেই চলে। আমাদের ট্রেডিশনাল খাবারগুলো এখন প্রোমোট করার সময় হয়ে এসেছে। এতে করে আমাদের দেশে ফাস্টফুড থেকে কিছুটা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে।
ফাস্টফুডের বিকাশের সাথে সমান তালে বাড়ছে স্থূলতা। আর যে-কোনো শিল্পোন্নত দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে স্থূলতার হার অনেক বেশি। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ৬০-এর দশকে স্থূলতার যে হার ছিল সেটা এখন বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। আর শিশুদের ক্ষেত্রে এ হার ১৯৭০-এর চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। অর্থাৎ শিশুদের মধ্যে স্থূলতার হার প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় বাড়ছে আরো দ্রুত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক ইতিহাসে আমেরিকানরাই একমাত্র জাতি যারা এত দ্রুত এত মোটা হয়েছে। সিডিসি-র সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকার প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে লিঙ্গ বর্ণ বয়স শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্বিশেষে গণহারে সবার মধ্যে স্থূলতা বাড়ছে। ১৯৯১-এ ১৫ শতাংশ বা তার বেশি স্থূলতার হার ছিল মাত্র চারটি অঙ্গরাজ্যে। আর বর্তমানে এ সংখ্যা ৩৭টি অঙ্গরাজ্য ছাড়িয়ে গেছে।
স্থূলতার এমন হঠাৎ-বৃদ্ধির পেছনে কোনো জিনগত কারণ নেই। আমেরিকানদের জিন গত কয়েক দশকে রাতারাতি পাল্টেও যায় নি। পাল্টেছে তাদের খাওয়া এবং জীবনযাত্রার ধরন। কমেছে শারীরিক পরিশ্রম, বেড়েছে খাদ্যতালিকায় চর্বিজাত ও উচ্চ ফ্যাটযুক্ত খাবারের পরিমাণ। আর এসব খাবার সব জায়গায় এমন সহজলভ্য ও সুলভ হয়েছে ফাস্টফুড-শিল্পের আগ্রাসী বিকাশের ফলে।
স্থূলতার ‘মহামারি’ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন দেশে। বিস্ময়কর ব্যাপার, সত্তরের দশকের গোড়ায় আমেরিকার চেইন ফাস্টফুড শপ ম্যাকডোনাল্ডস জাপানে তাদের শাখা চালু করে, তারপর জাপানিদের অবস্থাও হতে শুরু করে আমেরিকানদের মতোই। পরবর্তী এক দশক না পেরোতেই জাপানে ফাস্টফুড খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় দ্বিগুণ-এ। সেইসাথে দ্বিগুণ হয়ে যায় শিশুদের স্থূলতার হারও। কারণ, ফাস্টফুড একবার খাওয়া শুরু করলে ছাড়া কঠিন। দিন দিন বাড়তেই থাকে এর আসক্তি। প্রমাণ খোদ আমেরিকানরাই। ফাস্টফুডের পেছনে ১৯৭০ সালে তাদের খরচ ছিল ছয়শ কোটি ডলার। ২০০১ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার কোটি ডলারে।
স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও তরুণ-তরুণীরা বেশি আসক্ত হচ্ছে এই খাবারের প্রতি। বাজারে নানা ধরনের ফাস্টফুড থাকলেও কোনটাতে কী পরিমাণ খাদ্য ক্যালরি রয়েছে তার উল্লেখ থাকছে না। এ কারণে মানুষ এসব খাবার খেয়ে অস্বাভাবিক মোটা হয়ে যাচ্ছে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাইপারটেনশন ও শ্বাসকষ্টসহ নানা অসংক্রামণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে। এসব খাদ্য তৈরি থেকে শুরু করে বাজারজাতে সরকারের কোনো সংস্থারই নজর নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের প্রতিটি স্কুল-কলেজের সামনে ফাস্টফুডের দোকান রয়েছে। এসব দোকান থেকে খাবার কিনে খাচ্ছে শিশু ও তাদের অভিভাবকরা। এসব খাবারের গায়ে ক্যালরির পরিমাণ উল্লেখ নেই। এগুলো খেয়ে শিশুসহ সবাই অস্বাভাবিক মোটা হয়ে যাচ্ছে। ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সারসহ নানা অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের মতে, ফাস্টফুডে আছে স্যাকারিন, টেস্টিং সল্ট, চর্বি ও চিনি। একই সঙ্গে ফাস্টফুডের প্রিজারভেটিভ, কেমিক্যাল, ঘনচিনি ও ক্ষতিকর রং মারাত্মক অসুখ-বিসুখ সৃষ্টি করে শরীরে। এসব খাবারে নষ্ট হয় দাঁত, লিভার, কিডনিসহ মূল্যবান অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।
ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞরা জানান, অস্বাভাবিক মোটা হওয়ার কারণে মানুষের শরীরে ইনসুলিন নামক হরমোন ঢুকতে পারছে না। এতে জীবকোষ নষ্ট হয়ে টাইপ-১ ডায়বেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এদের শরীরে ইনসুলিন ব্যবহারের বিকল্প নেই। এই ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের হার কম। টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার অনেক বেশি। খাদ্যাভাস, কায়িক পরিশ্রম, লাইফ স্টাইল পরিবর্তন করে এই ধরনের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে দিনে প্রায় দুই লাখ মানুষ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়। সে দেশের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)-এর হিসাব মতে, প্রতিবছর এক-চতুর্থাংশেরও বেশি আমেরিকান ফুড পয়জনিং-এর শিকার হন, যার অধিকাংশই কর্তৃপক্ষের গোচরে আসে না এবং যথাযথভাবে রোগনির্ণয়ও হয় না প্রায়শই। দু-একটা যা-ও হয়, সেটি প্রকৃত সংখ্যার নগণ্য অংশ মাত্র।
চটজলদি বা ঝটপট খাবার সবাই চেনে ফাস্টফুড নামে। এর প্রভাবেই পাল্টে গেছে গ্রামের বাজার কিংবা শহুরে আড্ডার রসনা ঐতিহ্য। ঠিক তার ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছে স্থুলতা, ক্ষুধামন্দা, কর্মে অবসাদ। বাড়ছে অসুখের খরচ। তবে এসব স্বাস্থ্য ঝুঁকি মাথায় নিয়েও ফাস্টফুড ঘিরে দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে ত্রিশ লাখের বেশি। যদিও রেস্তোরাঁয় খাবারের গ্রেডিং চালুর বাস্তবায়ন চলছে ধীরগতিতে।
একজন বিক্রেতা বলেন, স্ট্রিটফুড, থাইফুড, এরাবিয়ান ফুড আছে, মানে হচ্ছে এখানে সবধরনের ফুড পাওয়া যায়।
একজন ক্রেতা বলেন, স্ট্রিটফুডগুলোর হাইজিনের ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন থাকে। এই খাবারের হেলথ ইস্যু থাকবে, তবে সেটা যদি লিমিট অনুযায়ী খাওয়া হয়, তাহলে এটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়।
ফাস্টফুডের যে জাদু পুরো দেশকে আচ্ছন্ন করেছে তার বাজিকর হলো ঢাকা। এখানে প্রথম ফাস্টফুড এসেছিল সুইচ বেকারির কাঁচঘরে। অলিম্পিয়ার হ্যাম বার্গার, ফ্রেন্স ও সুইচ বেকারির হাত ধরে এসেছিল বার্গার-হটডগ। ৪ দশক ধরে সুইচ বেকারি ব্যাবসা করে আসছে সুনামের সঙ্গে। সময়ের সাথে তাদের কাঁচঘরে তাল মিলিয়ে এসেছে নতুন নতুন ফাস্টফুড।
ফাস্টফুডের তালিকা কেবলই লম্বা হয়েছে এরপর থেকে। চারদশকে রেস্তোরার বাইরে ফাস্টফুড ডালপালা মেলেছে ফুটপাত, পার্ক, বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে। যাতে প্রলুব্ধ হয়ে ভোজন রসিক ডুবেছে মোহে। নিয়মিত অভ্যাসে আপন করে নিয়েছে অসংক্রামক ব্যাধি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলের এক গবেষণার তথ্য বলছে গ্যাস্ট্রিক, ফ্যাটি লিভার, কোলন ক্যান্সার, ডায়াবেটিসের মতো ব্যধি লাফিয়ে বাড়ছে। দেশে মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশই অসংক্রামক রোগে। বিএসএমএমইউ এর পৃথক এক গবেষণায় পাওয়া যায় ফাস্টফুডে ক্ষতিকর উপাদানের উচ্চমাত্রা।
পাশাপাশি অগ্নাশয়, পেটের জ্বালায় ঘি ঢালা ফাস্টফুডের সমান্তরালে বেড়েছে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের বাজার। ২০২১ পর্যন্ত পাঁচ বছরে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ বিক্রি বেড়েছে ১২ শতাংশ হারে। একই প্রবৃদ্ধি থাকলে বর্তমানে দেশে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের বাজার দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার।
ক্ষুধামন্দা, স্থুলতা, উচ্চ রক্তচাপ, অনিদ্রার মতো শারীরিক সমস্যা নিয়েও রাজধানীবাসি নিয়মিত মুখে তুলছে ফাস্টফুড। সময় স্বল্পতা, সহজলভ্যতার অজুহাতে ভুলতে বসেছেন দেশি ও সুষম খাবার।
একজন ভোক্তা বলেন, আমি কয়েকদিন আগেই ভারত থেকে ডাক্তার দেখিয়ে আসছি। এখন একটু সাবধানে থাকছি। কারণ আবার এই গ্যাস্ট্রিক যেন কোনো সমস্যা না করে। আগে এই ফাস্টফুডের খাবার দিয়েই নাস্তা করতাম। আবার দেখা যেত রাতের খাবার বাইরে থেকেই খেয়ে যেতাম, সেজন্য বাসায় খেতাম না।
গড়ে ওঠা বিরুপ খাদ্যভ্যাসের কারণে বছর বছর চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। গত দুই দশকে মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় বেড়েছে ৭ গুণ। যার ৬৪ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে শুধু ওষুধে। সরকার এ খাতে বরাদ্দ বাড়ালেও দেশের মোট স্বাস্থ্য ব্যায়ের দুই-তৃতীয়াংশ ব্যয় হয় ব্যক্তির নিজ খরচে। চিকিৎসা বলছেন ব্যক্তি পর্যায়ে চিকিৎসা ও ওষুধ খরচ বৃদ্ধির কারণ খাদ্যভ্যাসের পরিবর্তন। ফাস্টফুডে আসক্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু ও তরুণরা।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের গ্যাট্রোএন্টেরোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, এই ফাস্টফুডের কারণে নানা ধরনের রোগ হতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ফ্যাটি লিভার। এতে লিভারে চর্বি জমে যায়। এছাড়াও আরও কিছু অসুখ আছে যেগুলো ফাস্টফুড থেকে খুব দ্রুত হয়। এগুলো থেকে লিভার ক্যান্সার হয়ে যেতে পারে।
তবে এসব স্বাস্থ্য ঝুঁকি মাথায় নিয়েও ফাস্টফুডকে কেন্দ্র করে যে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার প্রসার ঘটেছে তাতে প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষের রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়েছে বলে দাবি করছে রেস্টুরেন্ট ওনার্স এসোসিয়েশন। ২০১০ এর পর এ সেবা খাতে ১২ লাখ নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। বিবিএস এর সবশেষ হালনাগাদ বলছে ১১ বছর ব্যবধানে দেশে রেস্টুরেন্ট সংখ্যা ২ লাখ ৭৫ হাজার থেকে ৪ লাখ ৩৬ হাজারে পৌঁছেছে। এ খাতে বছরে বিক্রি ৩৮ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপির ১ শতাংশের কিছু বেশি। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে রেস্তোরাঁয় খাবারে গ্রেডিং চালু করলেও তা সীমাবদ্ধ ভালো রেস্তোরাঁর মধ্যেই।
বাংলাদেশ রেস্তোঁরা মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের মাস্টার শেফ নেই বললেই চলে। আমাদের ট্রেডিশনাল খাবারগুলো এখন প্রোমোট করার সময় হয়ে এসেছে। এতে করে আমাদের দেশে ফাস্টফুড থেকে কিছুটা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে।
ফাস্টফুডের বিকাশের সাথে সমান তালে বাড়ছে স্থূলতা। আর যে-কোনো শিল্পোন্নত দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে স্থূলতার হার অনেক বেশি। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ৬০-এর দশকে স্থূলতার যে হার ছিল সেটা এখন বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। আর শিশুদের ক্ষেত্রে এ হার ১৯৭০-এর চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। অর্থাৎ শিশুদের মধ্যে স্থূলতার হার প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় বাড়ছে আরো দ্রুত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক ইতিহাসে আমেরিকানরাই একমাত্র জাতি যারা এত দ্রুত এত মোটা হয়েছে। সিডিসি-র সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকার প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে লিঙ্গ বর্ণ বয়স শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্বিশেষে গণহারে সবার মধ্যে স্থূলতা বাড়ছে। ১৯৯১-এ ১৫ শতাংশ বা তার বেশি স্থূলতার হার ছিল মাত্র চারটি অঙ্গরাজ্যে। আর বর্তমানে এ সংখ্যা ৩৭টি অঙ্গরাজ্য ছাড়িয়ে গেছে।
স্থূলতার এমন হঠাৎ-বৃদ্ধির পেছনে কোনো জিনগত কারণ নেই। আমেরিকানদের জিন গত কয়েক দশকে রাতারাতি পাল্টেও যায় নি। পাল্টেছে তাদের খাওয়া এবং জীবনযাত্রার ধরন। কমেছে শারীরিক পরিশ্রম, বেড়েছে খাদ্যতালিকায় চর্বিজাত ও উচ্চ ফ্যাটযুক্ত খাবারের পরিমাণ। আর এসব খাবার সব জায়গায় এমন সহজলভ্য ও সুলভ হয়েছে ফাস্টফুড-শিল্পের আগ্রাসী বিকাশের ফলে।
স্থূলতার ‘মহামারি’ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন দেশে। বিস্ময়কর ব্যাপার, সত্তরের দশকের গোড়ায় আমেরিকার চেইন ফাস্টফুড শপ ম্যাকডোনাল্ডস জাপানে তাদের শাখা চালু করে, তারপর জাপানিদের অবস্থাও হতে শুরু করে আমেরিকানদের মতোই। পরবর্তী এক দশক না পেরোতেই জাপানে ফাস্টফুড খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় দ্বিগুণ-এ। সেইসাথে দ্বিগুণ হয়ে যায় শিশুদের স্থূলতার হারও। কারণ, ফাস্টফুড একবার খাওয়া শুরু করলে ছাড়া কঠিন। দিন দিন বাড়তেই থাকে এর আসক্তি। প্রমাণ খোদ আমেরিকানরাই। ফাস্টফুডের পেছনে ১৯৭০ সালে তাদের খরচ ছিল ছয়শ কোটি ডলার। ২০০১ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার কোটি ডলারে।