আলোচিত চিত্রনায়িকা পরীমনির সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের জেরে চাকরি খোয়ালেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গোলাম সাকলায়েন। পরীমনির সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের সময় তিনি গোয়েন্দা-গুলশান বিভাগের এডিসির দায়িত্বে ছিলেন। আলোচনা শুরুর পর প্রথমে সাকলায়েনকে ডিবি থেকে সরিয়ে মিরপুরের পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টে (পিওএম) সংযুক্ত করা হয়েছিল। পরে সেখান থেকে তাকে ঝিনাইদহ ইনসার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে বদলি করা হয়। গত ১৩ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খালা-২ শাখা থেকে উপসচিব রোকেয়া পারভিন জুঁই স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়। পরে পরীমনিকাণ্ডে বিভাগীয় মামলায় ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এবার সাকলায়েনের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনলেন মডেল ও অভিনেত্রী পিয়া জান্নাতুল। অভিযোগের বিষয়টি গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ফেসবুক পোস্টে এই অভিনেত্রী তুলে ধরেন।
পুলিশ অধিদফতরের স্মারকে বলা হয়েছে, উপর্যুক্ত বিষয় ও সূত্রোক্ত স্মারকের পরিপ্রেক্ষিতে নির্দেশক্রমে জানানো যাচ্ছে যে, গোলাম সাকলায়েন, পিপিএম (বিপি-৮৬১২১৪৭৫৫১), অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ইন-সার্ভিস ট্রে নিং সেন্টার, ঝিনাইদহ ইতিপূর্বে এডিসি, ডিবি গুলশান বিভাগ, ডিএমপি, ঢাকায় কর্মকালে নায়িকা পরীমনির সঙ্গে ঘটনাক্রমে দেখা হয় এবং যোগাযোগ শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি নায়িকা পরীমনির বাসায় নিয়মিত রাত্রি যাপন করতে শুরু করেন। পুলিশ অধিদফতরের এলআইসি শাখা কর্তৃক প্রদান করা তার ফোনের সিডিআর বিশ্লেষণ অনুযায়ী গত ০৪/০৭/২০২১ তারিখ থেকে ০৪/০৮/২০২১ তারিখ পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন সময়ে (দিনে ও রাতে) নায়িকা পরীমনির বাসায় অবস্থান করেছেন। নায়িকা পরীমনির মোবাইলের ফরেনসিক রিপোর্ট (সিআইডি কর্তৃক মামলার আলামত হিসেবে জব্দকৃত) পর্যালোচনায় দেখা যায়, তার ও পরীমনির আদান-প্রদান করা মেসেজসমূহ (২৯ জুলাই, ২০২১ তারিখ হতে ৩ আগস্ট, ২০২১ তারিখ পর্যন্ত) সামসুন্নাহার স্মৃতি ওরফে পরীমনির ফেসবুক আইডি ও গোলাম সাকলায়েন সিথিল নামে আপনার ফেসবুক মেসেঞ্জারে কথোপকথন এবং তাদের হোয়াটস্অ্যাপ নম্বরে (১১ জুলাই, ২০২১ তারিখ হতে ৪ আগস্ট, ২০২১ তারিখ পর্যন্ত) কথোপকথন সাধারণ পরিচিতি বা পেশাগত প্রয়োজনে স্থাপিত কোন সম্পর্কের নয় বরং অনৈতিক প্রেমের সম্পর্ক। সিআইডির স্মারক নং-আইটি-ফরেনসিক/১৫৭৩, তারিখ-২/৯/২০২১ মূলে গত ১ আগস্ট, ২০২১ তারিখ ভোর ৬টা থেকে ২ আগস্ট ২০২১ তারিখ রাত ৩টা পর্যন্ত রাজারবাগ মধুমতি পুলিশ অফিসার্স কোয়ার্টার্সে নায়িকা পরীমনির যাতায়াতের ধারণ করা সিসিটিভি ফুটেজের ফরেনসিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে ও সাক্ষীদের জবানবন্দি অনুযায়ী প্রতীয়মান হয় যে, গত ১ আগস্ট, ২০২১ তারিখে তার পূর্ব পরিকল্পনা ও সম্পূর্ণ জ্ঞাতসারে সাকলায়েনের স্ত্রী না থাকাবস্থায় নায়িকা পরীমনি তার রাজারবাগের সরকারি বাসায় যান এবং প্রায় ১৭ ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করে ২ আগস্ট ২০২১ রাত ০১.৩০ মিনিটে বাসা ত্যাগ করেন। তার ও নায়িকা পরীমনির সম্পর্কের বিষয়টি বিভিন্ন অনলাইন ও প্রিন্ট মিডিয়ায়, টেলিভিশনে ও বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং যার ফলে জনমনে এ বিষয়ে নানারূপ বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনার জন্ম দেয়। এতে আরও বলা হয়, গোলাম সাকলায়েন পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হয়ে সরকারি দায়িত্বের বাইরে নায়িকা পরীমনির সঙ্গে অতিমাত্রায় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। তিনি বিবাহিত ও এক সন্তানের জনক হওয়া সত্ত্বেও পরীমনির সঙ্গে তার বিবাহ বহির্ভূত অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, পরীমনির সঙ্গে জন্মদিন উদযাপন ও নিজের সরকারি বাসভবনে নিজ স্ত্রীর অবর্তমানে সময় কাটানোর মতো ঘটনা বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে তা প্রচারিত হওয়ায় সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। উল্লেখিত অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা নম্বর ৭১/২০২২ রুজু করা হয়।
গোলাম সাকলায়েনের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩(খ) বিধি অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’ এর দায়ে অভিযোগনামা ও অভিযোগ বিবরণী জারি করা হয় (সংলাপ-ক)। অভিযুক্ত কর্মকর্তা আনীত অভিযোগের জবাব প্রদানপূর্বক ব্যক্তিগত শুনানি প্রার্থনা করেন (সংলাপ-খ)। উক্ত বিভাগীয় মামলাটি তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য জনাব হায়াত-উদ-দৌলা খাঁন, যুগ্মসচিব (প্রশাসন), জননিরাপত্তা বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলা হয় (সংলাপ-গ)। তদন্তে তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩(খ) বিধি অনুযায়ী অসদাচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে মর্মে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় (সংলাপ-ঘ)। তদন্ত প্রতিবেদন ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি পর্যালোচনাপূর্বক অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করে তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩(খ) বিধি অনুযায়ী অসদাচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় একই বিধিমালার বিধি ৪ এর উপ-বিধি ৩(ঘ) বিধিমোতাবেক গুরুদণ্ডের আওতায় কেন তাকে চাকরি থেকে বরখাস্তকরণ করা হবে না সে মর্মে ২য় কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়। অভিযুক্তের কারণ দর্শানোর নোটিশ স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানায় যথাযথ জারির প্রমাণ রয়েছে (সংলাপ-চ)। তিনি ২য় কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব দেন (সংলাপ-ছ)। জবাবে তিনি চাকরি থেকে বরখাস্তকরণ মামলার দায় থেকে অব্যাহতি প্রার্থনা করেন।
গোলাম সাকলায়েনের বিভাগীয় মামলার তদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষীদের জবানবন্দি, অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক লিখিত জবাব, মৌখিক বক্তব্য ও অন্যান্য কাগজপত্রাদি পুনরায় বিস্তারিত পর্যালোচনা করা হয়। সার্বিক পর্যালোচনান্তে ২য় কারণ দর্শানোর জবাব সন্তোষজনক বিবেচিত না হওয়ায় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩(খ) বিধি অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’ এর অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মকর্তা গোলাম সাকলায়েন, পিপিএম (বিপি-৮৬১২১৪৭৫৫১), অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টার, ঝিনাইদহ-কে একই বিধিমালার বিধি ৪ এর উপ-বিধি ৩(খ) বিধিমোতাবেক ‘গুরুদণ্ড’ হিসেবে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এমতাবস্থায় গোলাম সাকলায়েনের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩(খ) বিধি অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’ এর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় একই বিধিমালার বিধি ৪ এর উপ-বিধি ৩(খ) বিধিমোতাবেক ‘গুরুদণ্ড’ হিসেবে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়ার দণ্ডের বিষয়ে পরামর্শ দেয়ার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
অপরদিকে, সাকলায়েনের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনলেন মডেল ও অভিনেত্রী পিয়া জান্নাতুল। অভিযোগের বিষয়টি গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ফেসবুক পোস্টে এই অভিনেত্রী তুলে ধরেন। তিনি লেখেন, এই সেই ব্যক্তি (গোলাম সাকলায়েন), আব্বার এফআর টাওয়ার মামলায় যিনি ডিবি থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। প্রায় ৬-৭ দিন আমি আর আম্মা প্রতিদিনই আব্বাকে দেখতে ডিবি অফিসে যেতাম। এই সেই ব্যক্তি যিনি প্রতারণামূলকভাবে এবং জোরপূর্বক সিআরপিসি-এর ১৬৪ ধারার অধীনে জবানবন্দির জন্য জোরপূর্বক আব্বার সম্মতি নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। পিয়া আরও লেখেন, আমি আব্বাকে সম্মতি না দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম, কারণ তিনি এ ঘটনায় মোটেও জড়িত ছিলেন না। কিন্তু আমি ডিবি অফিসে পৌঁছার আগেই তিনি (সাকলায়েন) আব্বার কাছ থেকে লিখিত বক্তব্য নিয়ে পরের দিন আদালতে জমা দেন। এসব বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য তিনি আমার ওপর ক্ষিপ্ত হন এবং আব্বাকে আর আমাকে চুপ থাকতে বলেন। অথচ তার জানা ছিল না, আমি চুপ থাকার জন্য জন্মগ্রহণ করিনি।
এই অভিনেত্রী আরও লেখেন, যেদিন তিনি এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের জন্য জমির মালিক হিসেবে আব্বাকে গ্রেফতার করেছিলেন, আব্বা তখন এতটাই অসুস্থ ছিলেন যে তাকে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। তখন আব্বার বয়স ছিল ৭৭ বছরের বেশি! সাকলায়েন সম্পর্কে পিয়া বলেন, ‘আমার দেখা মতে, এই জনাব সাকলায়েন লোকটি অত্যন্ত তীক্ষè, প্রতিভাবান এবং ধূর্ত। কিন্তু একটা ভুল তার সবকিছু তছনছ করে দিল! যদিও আমরা মানুষের অপকর্মের জন্য তাদের ক্ষমা করে দিই, কিন্তু প্রকৃতি এবং সর্বশক্তিমান সব সময় রয়েছেন সঠিক বিচার করার জন্য।
অপর একটি সূত্র জানায়, ৩০তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে প্রথম হয়েছিলেন তিনি। যোগ দেয়ার পর পুলিশ একাডেমিতে বুনিয়াদী প্রশিক্ষণেও হয়েছিলেন সেরা, পেয়েছিলেন বেস্ট প্রবেশনারি অ্যাওয়ার্ড, বেস্ট অ্যাকাডেমিক এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড। পেশাগত দক্ষতা বাড়িয়ে নিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাস্টার্স অব পুলিশ সায়েন্সেও হয়েছিলেন প্রথম। পেশাগত দক্ষতার জন্য তিনি যে আরও অনেক পুরস্কার পাবেন, সেটিও ছিল অনুমিত। সর্বশেষ সাহসিকতা ও দক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে যে পদক বিতরণ করা হয়েছে, তাতেও স্বাভাবিকভাবেই ছিল তার নাম। পেয়েছেন রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পিপিএম পদকও গ্রহণ করেন গোলাম সাকলায়েন। ডিএমপির গোয়েন্দা (উত্তর) শাখার অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হিসেবেও কর্মরত ছিলেন।
পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) সূত্রে জানা গেছে, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও বন্দুকযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ কাজ ও অসীম সাহসিকতার জন্যই তাকে এসব পদক দেয়া হয়। সাকলায়েনের স্ত্রীও প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। পরীমণির সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময়কালে (২০২১ জুলাই) ঢাকার পার্শ্ববর্তী একটি জেলায় তার স্ত্রী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাদের একটি সন্তানও রয়েছে।
জীবনের একটা পর্যায়ে এসে এমন সাফল্য আর স্বীকৃতি একের পর এক ধরা দিলেও গোলাম সাকলায়েনের জীবনের উত্থানের পথ এতটা মসৃণ ছিল না। রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় পদ্মার পাড়ে মোক্তারপুর গ্রামে জন্ম নেয়া সাকলায়েনের বেড়ে ওঠার গল্পটাও ছিল সংগ্রাম মুখর। মেধা আর পরিশ্রমে অবশ্য সব প্রতিকূলতা জয় করেই আজকের এই অবস্থানে এসে পৌঁছেছেন সাকলায়েন।
পিপিএম পদক পাওয়া গোলাম সাকলায়েন ২০০১ সালে সারদা সরকারি পাইলট অ্যাকাডেমি হাই স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ ৪ দশমিক ৬৩ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন এসএসসি পরীক্ষায়। জিপিএ ৫ না পাওয়ার আক্ষেপটা ছিল। কিন্তু তার গ্রামের জন্য এটিই ছিল অভাবনীয় ফল। পরে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজে। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছে সাকলায়েনকে। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া সাকলায়েনের বাবা ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার মেরুদণ্ডের সমস্যা থাকায় চিকিৎসার পেছনে খরচ হতো অনেক অর্থ। সাকলায়েনকে তাই রাজশাহীতে মেসে রেখে পড়ানোর সামর্থ্য ছিল না পরিবারের। প্রতিদিন ৫০ কিলোমিটার সাইকেলে করে চারঘাট থেকে রাজশাহী এসে কলেজে ক্লাস করতেন তিনি।
সবমিলিয়ে এইচএসসির ফলটাও আশানুরূপ ছিল না, পেয়েছিলেন জিপিএ ৩ দশমিক ৮০। এরপর ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। ভর্তি পরীক্ষায় এ বিভাগে প্রথম হয়েছিলেন তিনি। এরপর একটি বিশ্ববিদ্যালয় কোচিং সেন্টারে সাধারণ জ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পাশাপাশি শুরু করেন টিউশনি। নিজে কখনো প্রাইভেট পড়ার সুযোগ না পেলেও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ছয় বছর পড়িয়েছেন গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষদের সন্তানদের, বিনামূল্যে কিনে দিয়েছেন বই। তার পড়ানো প্রায় ৫০০ ছেলেমেয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছেন।
সাকলায়েন চতুর্থ বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষার পর ফল পাওয়ার আগেই ‘অবতীর্ণ’ বা ‘অ্যাপিয়ার্ড’ হিসেবে আবেদন করেন ৩০তম বিসিএসে। কিছু না বুঝেই প্রথম চয়েজ দিয়েছিলেন পুলিশ ক্যাডার। পরবর্তীতে প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় পাস করেন সাকলায়েন। ৩০তম বিসিএসের কার্যক্রম যখন চলছে, এরই মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের পরীক্ষায় প্রথম হন সাকলায়েন। একই সঙ্গে পরীক্ষা দিয়ে সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবেও টিকে যান, যোগ দেন সেই চাকরিতে। পোস্টিং হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে। সে অবস্থায় অংশ নেন ৩০তম বিসিএসের ভাইভা পরীক্ষায়। কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন সে পরীক্ষায়।
এরপর শুরু সারদা পুলিশ একাডেমিতে বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ। মন দিয়েই নিয়েছেন প্রশিক্ষণ, মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে যোগ্যতা প্রমাণ করে তাতে হয়েছেন প্রথম। বেস্ট প্রবেশনারি অ্যাওয়ার্ডের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করে পরে পেয়েছেন বেস্ট অ্যাকাডেমিক এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড। বিভাগের সবার পরামর্শে পেশাগত দক্ষতার তাত্ত্বিক জ্ঞান বাড়িয়ে নিতেই একসময় ফের ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, পুলিশ সায়েন্সে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে। তাতেও প্রথম হন তিনি।
চীনের একটি প্রবাদ-‘হার্ডওয়ার্ক সাপোর্টেড বাই গুড ইনটেনশন মেকস মিরাকল’। এই প্রবাদটিকেই অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়েছিলেন গোলাম সাকলায়েন শিথিল। কিন্তু সমালোচিত অভিনেত্রী পরীমণির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে পড়ে ডিবি থেকে ডিএমপির পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টে (দাঙ্গা দমন বিভাগ, পশ্চিম) বদলি হন এ পুলিশ কর্মকর্তা। এছাড়া সাকলায়েনের বিরুদ্ধে করা হয় তদন্ত কমিটি। দীর্ঘ তদন্তে ঘটনার সত্যতা ও তার আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য সন্তোষজনক না হওয়ায় তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
পুলিশ অধিদফতরের স্মারকে বলা হয়েছে, উপর্যুক্ত বিষয় ও সূত্রোক্ত স্মারকের পরিপ্রেক্ষিতে নির্দেশক্রমে জানানো যাচ্ছে যে, গোলাম সাকলায়েন, পিপিএম (বিপি-৮৬১২১৪৭৫৫১), অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ইন-সার্ভিস ট্রে নিং সেন্টার, ঝিনাইদহ ইতিপূর্বে এডিসি, ডিবি গুলশান বিভাগ, ডিএমপি, ঢাকায় কর্মকালে নায়িকা পরীমনির সঙ্গে ঘটনাক্রমে দেখা হয় এবং যোগাযোগ শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি নায়িকা পরীমনির বাসায় নিয়মিত রাত্রি যাপন করতে শুরু করেন। পুলিশ অধিদফতরের এলআইসি শাখা কর্তৃক প্রদান করা তার ফোনের সিডিআর বিশ্লেষণ অনুযায়ী গত ০৪/০৭/২০২১ তারিখ থেকে ০৪/০৮/২০২১ তারিখ পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন সময়ে (দিনে ও রাতে) নায়িকা পরীমনির বাসায় অবস্থান করেছেন। নায়িকা পরীমনির মোবাইলের ফরেনসিক রিপোর্ট (সিআইডি কর্তৃক মামলার আলামত হিসেবে জব্দকৃত) পর্যালোচনায় দেখা যায়, তার ও পরীমনির আদান-প্রদান করা মেসেজসমূহ (২৯ জুলাই, ২০২১ তারিখ হতে ৩ আগস্ট, ২০২১ তারিখ পর্যন্ত) সামসুন্নাহার স্মৃতি ওরফে পরীমনির ফেসবুক আইডি ও গোলাম সাকলায়েন সিথিল নামে আপনার ফেসবুক মেসেঞ্জারে কথোপকথন এবং তাদের হোয়াটস্অ্যাপ নম্বরে (১১ জুলাই, ২০২১ তারিখ হতে ৪ আগস্ট, ২০২১ তারিখ পর্যন্ত) কথোপকথন সাধারণ পরিচিতি বা পেশাগত প্রয়োজনে স্থাপিত কোন সম্পর্কের নয় বরং অনৈতিক প্রেমের সম্পর্ক। সিআইডির স্মারক নং-আইটি-ফরেনসিক/১৫৭৩, তারিখ-২/৯/২০২১ মূলে গত ১ আগস্ট, ২০২১ তারিখ ভোর ৬টা থেকে ২ আগস্ট ২০২১ তারিখ রাত ৩টা পর্যন্ত রাজারবাগ মধুমতি পুলিশ অফিসার্স কোয়ার্টার্সে নায়িকা পরীমনির যাতায়াতের ধারণ করা সিসিটিভি ফুটেজের ফরেনসিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে ও সাক্ষীদের জবানবন্দি অনুযায়ী প্রতীয়মান হয় যে, গত ১ আগস্ট, ২০২১ তারিখে তার পূর্ব পরিকল্পনা ও সম্পূর্ণ জ্ঞাতসারে সাকলায়েনের স্ত্রী না থাকাবস্থায় নায়িকা পরীমনি তার রাজারবাগের সরকারি বাসায় যান এবং প্রায় ১৭ ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করে ২ আগস্ট ২০২১ রাত ০১.৩০ মিনিটে বাসা ত্যাগ করেন। তার ও নায়িকা পরীমনির সম্পর্কের বিষয়টি বিভিন্ন অনলাইন ও প্রিন্ট মিডিয়ায়, টেলিভিশনে ও বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং যার ফলে জনমনে এ বিষয়ে নানারূপ বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনার জন্ম দেয়। এতে আরও বলা হয়, গোলাম সাকলায়েন পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হয়ে সরকারি দায়িত্বের বাইরে নায়িকা পরীমনির সঙ্গে অতিমাত্রায় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। তিনি বিবাহিত ও এক সন্তানের জনক হওয়া সত্ত্বেও পরীমনির সঙ্গে তার বিবাহ বহির্ভূত অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, পরীমনির সঙ্গে জন্মদিন উদযাপন ও নিজের সরকারি বাসভবনে নিজ স্ত্রীর অবর্তমানে সময় কাটানোর মতো ঘটনা বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে তা প্রচারিত হওয়ায় সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। উল্লেখিত অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা নম্বর ৭১/২০২২ রুজু করা হয়।
গোলাম সাকলায়েনের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩(খ) বিধি অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’ এর দায়ে অভিযোগনামা ও অভিযোগ বিবরণী জারি করা হয় (সংলাপ-ক)। অভিযুক্ত কর্মকর্তা আনীত অভিযোগের জবাব প্রদানপূর্বক ব্যক্তিগত শুনানি প্রার্থনা করেন (সংলাপ-খ)। উক্ত বিভাগীয় মামলাটি তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য জনাব হায়াত-উদ-দৌলা খাঁন, যুগ্মসচিব (প্রশাসন), জননিরাপত্তা বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলা হয় (সংলাপ-গ)। তদন্তে তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩(খ) বিধি অনুযায়ী অসদাচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে মর্মে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় (সংলাপ-ঘ)। তদন্ত প্রতিবেদন ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি পর্যালোচনাপূর্বক অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করে তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩(খ) বিধি অনুযায়ী অসদাচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় একই বিধিমালার বিধি ৪ এর উপ-বিধি ৩(ঘ) বিধিমোতাবেক গুরুদণ্ডের আওতায় কেন তাকে চাকরি থেকে বরখাস্তকরণ করা হবে না সে মর্মে ২য় কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়। অভিযুক্তের কারণ দর্শানোর নোটিশ স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানায় যথাযথ জারির প্রমাণ রয়েছে (সংলাপ-চ)। তিনি ২য় কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব দেন (সংলাপ-ছ)। জবাবে তিনি চাকরি থেকে বরখাস্তকরণ মামলার দায় থেকে অব্যাহতি প্রার্থনা করেন।
গোলাম সাকলায়েনের বিভাগীয় মামলার তদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষীদের জবানবন্দি, অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক লিখিত জবাব, মৌখিক বক্তব্য ও অন্যান্য কাগজপত্রাদি পুনরায় বিস্তারিত পর্যালোচনা করা হয়। সার্বিক পর্যালোচনান্তে ২য় কারণ দর্শানোর জবাব সন্তোষজনক বিবেচিত না হওয়ায় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩(খ) বিধি অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’ এর অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মকর্তা গোলাম সাকলায়েন, পিপিএম (বিপি-৮৬১২১৪৭৫৫১), অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টার, ঝিনাইদহ-কে একই বিধিমালার বিধি ৪ এর উপ-বিধি ৩(খ) বিধিমোতাবেক ‘গুরুদণ্ড’ হিসেবে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এমতাবস্থায় গোলাম সাকলায়েনের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩(খ) বিধি অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’ এর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় একই বিধিমালার বিধি ৪ এর উপ-বিধি ৩(খ) বিধিমোতাবেক ‘গুরুদণ্ড’ হিসেবে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়ার দণ্ডের বিষয়ে পরামর্শ দেয়ার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
অপরদিকে, সাকলায়েনের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনলেন মডেল ও অভিনেত্রী পিয়া জান্নাতুল। অভিযোগের বিষয়টি গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ফেসবুক পোস্টে এই অভিনেত্রী তুলে ধরেন। তিনি লেখেন, এই সেই ব্যক্তি (গোলাম সাকলায়েন), আব্বার এফআর টাওয়ার মামলায় যিনি ডিবি থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। প্রায় ৬-৭ দিন আমি আর আম্মা প্রতিদিনই আব্বাকে দেখতে ডিবি অফিসে যেতাম। এই সেই ব্যক্তি যিনি প্রতারণামূলকভাবে এবং জোরপূর্বক সিআরপিসি-এর ১৬৪ ধারার অধীনে জবানবন্দির জন্য জোরপূর্বক আব্বার সম্মতি নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। পিয়া আরও লেখেন, আমি আব্বাকে সম্মতি না দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম, কারণ তিনি এ ঘটনায় মোটেও জড়িত ছিলেন না। কিন্তু আমি ডিবি অফিসে পৌঁছার আগেই তিনি (সাকলায়েন) আব্বার কাছ থেকে লিখিত বক্তব্য নিয়ে পরের দিন আদালতে জমা দেন। এসব বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য তিনি আমার ওপর ক্ষিপ্ত হন এবং আব্বাকে আর আমাকে চুপ থাকতে বলেন। অথচ তার জানা ছিল না, আমি চুপ থাকার জন্য জন্মগ্রহণ করিনি।
এই অভিনেত্রী আরও লেখেন, যেদিন তিনি এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের জন্য জমির মালিক হিসেবে আব্বাকে গ্রেফতার করেছিলেন, আব্বা তখন এতটাই অসুস্থ ছিলেন যে তাকে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। তখন আব্বার বয়স ছিল ৭৭ বছরের বেশি! সাকলায়েন সম্পর্কে পিয়া বলেন, ‘আমার দেখা মতে, এই জনাব সাকলায়েন লোকটি অত্যন্ত তীক্ষè, প্রতিভাবান এবং ধূর্ত। কিন্তু একটা ভুল তার সবকিছু তছনছ করে দিল! যদিও আমরা মানুষের অপকর্মের জন্য তাদের ক্ষমা করে দিই, কিন্তু প্রকৃতি এবং সর্বশক্তিমান সব সময় রয়েছেন সঠিক বিচার করার জন্য।
অপর একটি সূত্র জানায়, ৩০তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে প্রথম হয়েছিলেন তিনি। যোগ দেয়ার পর পুলিশ একাডেমিতে বুনিয়াদী প্রশিক্ষণেও হয়েছিলেন সেরা, পেয়েছিলেন বেস্ট প্রবেশনারি অ্যাওয়ার্ড, বেস্ট অ্যাকাডেমিক এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড। পেশাগত দক্ষতা বাড়িয়ে নিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাস্টার্স অব পুলিশ সায়েন্সেও হয়েছিলেন প্রথম। পেশাগত দক্ষতার জন্য তিনি যে আরও অনেক পুরস্কার পাবেন, সেটিও ছিল অনুমিত। সর্বশেষ সাহসিকতা ও দক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে যে পদক বিতরণ করা হয়েছে, তাতেও স্বাভাবিকভাবেই ছিল তার নাম। পেয়েছেন রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পিপিএম পদকও গ্রহণ করেন গোলাম সাকলায়েন। ডিএমপির গোয়েন্দা (উত্তর) শাখার অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হিসেবেও কর্মরত ছিলেন।
পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) সূত্রে জানা গেছে, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও বন্দুকযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ কাজ ও অসীম সাহসিকতার জন্যই তাকে এসব পদক দেয়া হয়। সাকলায়েনের স্ত্রীও প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। পরীমণির সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময়কালে (২০২১ জুলাই) ঢাকার পার্শ্ববর্তী একটি জেলায় তার স্ত্রী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাদের একটি সন্তানও রয়েছে।
জীবনের একটা পর্যায়ে এসে এমন সাফল্য আর স্বীকৃতি একের পর এক ধরা দিলেও গোলাম সাকলায়েনের জীবনের উত্থানের পথ এতটা মসৃণ ছিল না। রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় পদ্মার পাড়ে মোক্তারপুর গ্রামে জন্ম নেয়া সাকলায়েনের বেড়ে ওঠার গল্পটাও ছিল সংগ্রাম মুখর। মেধা আর পরিশ্রমে অবশ্য সব প্রতিকূলতা জয় করেই আজকের এই অবস্থানে এসে পৌঁছেছেন সাকলায়েন।
পিপিএম পদক পাওয়া গোলাম সাকলায়েন ২০০১ সালে সারদা সরকারি পাইলট অ্যাকাডেমি হাই স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ ৪ দশমিক ৬৩ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন এসএসসি পরীক্ষায়। জিপিএ ৫ না পাওয়ার আক্ষেপটা ছিল। কিন্তু তার গ্রামের জন্য এটিই ছিল অভাবনীয় ফল। পরে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজে। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছে সাকলায়েনকে। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া সাকলায়েনের বাবা ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার মেরুদণ্ডের সমস্যা থাকায় চিকিৎসার পেছনে খরচ হতো অনেক অর্থ। সাকলায়েনকে তাই রাজশাহীতে মেসে রেখে পড়ানোর সামর্থ্য ছিল না পরিবারের। প্রতিদিন ৫০ কিলোমিটার সাইকেলে করে চারঘাট থেকে রাজশাহী এসে কলেজে ক্লাস করতেন তিনি।
সবমিলিয়ে এইচএসসির ফলটাও আশানুরূপ ছিল না, পেয়েছিলেন জিপিএ ৩ দশমিক ৮০। এরপর ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। ভর্তি পরীক্ষায় এ বিভাগে প্রথম হয়েছিলেন তিনি। এরপর একটি বিশ্ববিদ্যালয় কোচিং সেন্টারে সাধারণ জ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পাশাপাশি শুরু করেন টিউশনি। নিজে কখনো প্রাইভেট পড়ার সুযোগ না পেলেও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ছয় বছর পড়িয়েছেন গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষদের সন্তানদের, বিনামূল্যে কিনে দিয়েছেন বই। তার পড়ানো প্রায় ৫০০ ছেলেমেয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছেন।
সাকলায়েন চতুর্থ বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষার পর ফল পাওয়ার আগেই ‘অবতীর্ণ’ বা ‘অ্যাপিয়ার্ড’ হিসেবে আবেদন করেন ৩০তম বিসিএসে। কিছু না বুঝেই প্রথম চয়েজ দিয়েছিলেন পুলিশ ক্যাডার। পরবর্তীতে প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় পাস করেন সাকলায়েন। ৩০তম বিসিএসের কার্যক্রম যখন চলছে, এরই মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের পরীক্ষায় প্রথম হন সাকলায়েন। একই সঙ্গে পরীক্ষা দিয়ে সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবেও টিকে যান, যোগ দেন সেই চাকরিতে। পোস্টিং হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে। সে অবস্থায় অংশ নেন ৩০তম বিসিএসের ভাইভা পরীক্ষায়। কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন সে পরীক্ষায়।
এরপর শুরু সারদা পুলিশ একাডেমিতে বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ। মন দিয়েই নিয়েছেন প্রশিক্ষণ, মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে যোগ্যতা প্রমাণ করে তাতে হয়েছেন প্রথম। বেস্ট প্রবেশনারি অ্যাওয়ার্ডের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করে পরে পেয়েছেন বেস্ট অ্যাকাডেমিক এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড। বিভাগের সবার পরামর্শে পেশাগত দক্ষতার তাত্ত্বিক জ্ঞান বাড়িয়ে নিতেই একসময় ফের ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, পুলিশ সায়েন্সে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে। তাতেও প্রথম হন তিনি।
চীনের একটি প্রবাদ-‘হার্ডওয়ার্ক সাপোর্টেড বাই গুড ইনটেনশন মেকস মিরাকল’। এই প্রবাদটিকেই অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়েছিলেন গোলাম সাকলায়েন শিথিল। কিন্তু সমালোচিত অভিনেত্রী পরীমণির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে পড়ে ডিবি থেকে ডিএমপির পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টে (দাঙ্গা দমন বিভাগ, পশ্চিম) বদলি হন এ পুলিশ কর্মকর্তা। এছাড়া সাকলায়েনের বিরুদ্ধে করা হয় তদন্ত কমিটি। দীর্ঘ তদন্তে ঘটনার সত্যতা ও তার আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য সন্তোষজনক না হওয়ায় তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।