
টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় আছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। গত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকায় চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্বে নিজেদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে নিজেরাই সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। মূলত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তৃণমূলে নেতায় নেতায় বাড়ছে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘাত, হামলা-পাল্টা হামলা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলটির কেন্দ্র থেকে নেয়া হচ্ছে না কোনো ধরনের ব্যবস্থা। ফলে কেন্দ্রের শিথিলতায় তৃণমূলে বাড়ছে সংঘাত। কোথাও কোথাও প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা বলছেন, দলের কেন্দ্র থেকে সংঘাত-সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে কোনো শিথিলতা নেই। দ্বাদশ নির্বাচনের পর উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়েও ভোট কারচুপি, কেন্দ্র দখল, ফলাফল ঘোষণাসহ নানা বিষয়ে অভিযোগ উঠে। শুধু তাই নয়, নির্বাচনের আগে-পরে অনেক স্থানে সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এমপি-মন্ত্রী ও স্বজনরা তাদের পছন্দের প্রার্থীদের নির্বাচিত করতে দলীয় নির্দেশনা না মেনে প্রভাব বিস্তার করছেন। বিএনপি মাঠে না থাকায় মূলত আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে এসব সংঘর্ষ ও সংঘাতের ঘটনা আরও বেড়েছে। তবে এ নিয়ে আওয়ামী লীগ চিন্তিত নয়। দলের ৮ বিভাগে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক টিম কাজ করছে। যারা এসব দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের সঙ্গে জড়িত দল তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ হিসাব করে ব্যবস্থা নেবে। তৃণমূলে সংঘাত না করতে বারবার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। তৈরি করা হচ্ছে অভিযুক্তদের তালিকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৯ জুন বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ঝিনাইদহের শৈলকুপায় আওয়ামী লীগের কর্মীকে আটকের প্রতিবাদে থানা ঘেরাও করে হামলা-ভাঙচুর চালিয়েছে তার অনুসারীরা। এরপর পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এ ঘটনায় পুলিশ, সাংবাদিকসহ অন্তত ৩০ জন আহত হন এবং গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বেশ কয়েকজন। আহতদের ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালসহ বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। তবে পুলিশ জানিয়েছে, শৈলকুপায় আওয়ামী লীগকর্মী এজাহারভুক্ত আসামি ধলহরা চন্দ্র ইউনিয়নের ধাওড়া গ্রামের মোস্তাক সিকদারকে পুলিশ গত রোববার দুপুরে আটক করে। এতে ক্ষিপ্ত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে শৈলকুপা থানা ঘেরাও করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এতে কয়েকজন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ফাঁকা গুলি ছুড়ে। এতে হামলাকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এ ঘটনায় ৫ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। গত ৮ জুন পাবনার সুজানগর উপজেলায় একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা স্ট্যান্ড দখল নিয়ে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে ২০ জন আহত হয়েছেন। গত শনিবার সকালে সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের কাদুয়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় লোকজন ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৮ সালে আবদুল ওহাব উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং শাহীনুজ্জামান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সেই থেকে দুজনের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। এলাকায় বালুমহাল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা স্ট্যান্ড এবং বাজার দখল ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ চলে আসছিল। কিছুদিন আগে প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দুজনেই চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এতে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ আরও বাড়ে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে কয়েক দফায় সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। নির্বাচনে আবদুল ওহাবের কাছে শাহীনুজ্জামান পরাজিত হন। নির্বাচনের পর আরও কয়েকটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় একে অপরের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করেন তারা। গত ৭ জুন চট্টগ্রামের আনোয়ারায় প্রস্তাবিত বাজেটকে স্বাগত জানিয়ে একই স্থানে উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের আনন্দ মিছিল ও আলোচনা সভাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে গুরুতর আহত হয়েছেন আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক এম এ মান্নান চৌধুরী ও বরুমছড়ার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যানসহ অন্তত ১৫ জন। এদের মধ্যে অধ্যাপক এম এ মান্নান চৌধুরীকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের মতে, দলীয় বিভেদ এড়াতেই স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তারপরও সংঘাত-প্রাণহানি এড়ানো যায়নি। যা দলের বিভেদ আরও বাড়াতে সহায়তা করেছে। মূলত দল দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় দলে এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে জনপ্রতিনিধি হলেই এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে রাতারাতি সম্পদের মালিক হওয়া সহজ হবে। এজন্য অনেকে যেকোনো মূল্যে জেতার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। অভ্যন্তরীণ সংঘাত বৃদ্ধির এটাই বড় কারণ। তবে সরকারি দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সহিংসতা ও প্রাণহানি নতুন নয়। বিএনপিসহ বিরোধীরা নির্বাচনে অংশ নিলেও ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাদের সংঘাত হতো।
এদিকে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এ ধরনের ঘটনাগুলো নতুন কিছু নয়। দল থেকে সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করছি যেন সহিংসতা, মারামারির মতো বিষয়গুলো পরিহার করা যায়। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান বলেন, দ্বাদশ নির্বাচনে কোনো ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। তবে উপজেলা নির্বাচনে যেন সংঘাত-সহিংসতা না হয় এজন্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে বার্তা দেয়া হয়েছে। যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দল ব্যবস্থা নেবে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, দলের তৃণমূলে যাতে এসব দ্বন্দ্ব ও সংঘাত না বাড়ে তার জন্য আওয়ামী লীগের ৮ বিভাগে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক টিম কাজ করছে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম দাবি করেন, অন্য সময়ের চেয়ে এবার সংঘাতে প্রাণহানি কম হয়েছে। যা হয়েছে সেটাও কাম্য নয়। তবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজ্জামেল হক বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কিছু সংঘাত-সংঘর্ষ হয়। তারপরও উপজেলা নির্বাচনের আরো দুই ধাপ বাকি রয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যাতে সংঘাত-সংঘর্ষ না বাড়ে, এ জন্য দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কাজ করছেন।
ছোটখাটো সংঘাত প্রায় সব সময় হয়: স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ছোটখাটো সংঘাত হয়েছে প্রায় সব সময়ই। তবে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে যশোর, কুষ্টিয়া, কক্সবাজার, গোপালগঞ্জ, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিরাজগঞ্জে। এই সাত জেলায় হত্যাকাণ্ডের এসব ঘটনায় আসামির সংখ্যা ১৭২। ১৯ জন গ্রেফতার হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মূলহোতা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। এখন জনপ্রতিনিধি হওয়া বা কোনো দলীয় পদ পাওয়া খুবই লাভজনক ব্যবসা। ফলে যেকোনো মূল্যে সবাই জিততে চান। তবে বিরোধী দলবিহীন এ নির্বাচনে ভোটারদের উৎসাহ ছিল না বললেই চলে। উপজেলা নির্বাচনের ইতিহাসে এবার ভোট পড়েছে সবচেয়ে কম। তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ২০১৫ সাল থেকে দলীয় প্রতীক দেয়া শুরু হয়। সেই থেকে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিভেদ প্রকট হতে থাকে। বিরোধী দলগুলো গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়াতে নিজ দলের নেতাদের স্বতন্ত্র ভোট করার সুযোগ দেয় আওয়ামী লীগ। এর ফলে আরেক দফা দলীয় কোন্দল বেড়েছে। তবে বেসরকারি সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য অনুসারে, ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোট গ্রহণের এক সপ্তাহ পর পর্যন্ত সহিংসতায় অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছিলেন। আহত হন প্রায় ২ হাজার ২০০ জন। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুসারে, এবার উপজেলা নির্বাচনের দিন থেকে পরবর্তী ১০ দিনে ভোটকেন্দ্রিক সংঘাতে সাতজন নিহত হয়েছেন। তাদের সবাই সরকারি দলের নেতাকর্মী সমর্থক। জাতীয় নির্বাচনের ঠিক চার মাস পর শুরু হয় ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। মাসব্যাপী চলা নির্বাচন শেষ হয়েছে ৯ জুন। বিরোধী দলের বর্জনের কারণে দলীয় মনোনয়ন না দিয়ে প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দেয় আওয়ামী লীগ। ফলে প্রতিটি উপজেলায় দলের একাধিক নেতা একে অপরের বিরুদ্ধে প্রার্থী হন। তবে নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, চার ধাপের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল সর্বোচ্চ ৩৭ দশমিক ৫৭ এবং সর্বনিম্ন ৩৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ। গত দেড় দশকে এবারই উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটের হার সবচেয়ে কম।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, ২০১৮ সাল থেকে গত মার্চ পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ সংঘাতে আওয়ামী লীগের ১৯১ জন মারা গেছেন। তাদের কেউ কেউ মারা গেছেন নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে। অনেকে মারা গেছেন নির্বাচনী সহিংসতায়। আসকের হিসাবে, দেশের নির্বাচনী সহিংসতায় প্রাণহানির শীর্ষে ২০১৬ সাল। ওই বছর ১৭৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। প্রায় সবাই মারা যান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সহিংসতায়। তবে এইচআরএসএসএ’র তথ্যমতে, গত বছর ৯৩৩টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। নিহত হন ৯৬ জন। আহতের সংখ্যা ৯ হাজার ২৫৮। এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচনে এখন ভোটারের কাছে কোনো আকর্ষণ নেই। মূল আকর্ষণ প্রার্থীদের। কারণ এখন জনপ্রতিনিধি হওয়া বা কোনো দলীয় পদ পাওয়া খুবই লাভজনক ব্যবসা। ফলে যেকোনো মূল্যে সবাই জিততে চান। এজন্য নিজ দল বা অন্য দল যে-ই প্রতিপক্ষ হিসেবে সামনে আসে ঘায়েল করার চেষ্টা চলে।