জ্বালানির অভাবে দেশের ১৩৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ১৫টির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি কারিগরি ত্রুটিতে অচল রয়েছে আরও পাঁচটি কেন্দ্র। এছাড়া, কিছু কেন্দ্র সক্ষমতার তুলনায় কম উৎপাদনে চলছে। ফলে দেশের বিদ্যুৎ ব্যবহারের একটি বড় অংশ আমদানি করা বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে। প্রাকৃতিক গ্যাস ছাড়াও ফার্নেস তেলভিত্তিক প্রায় ১০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। তেল সংকটের কারণে উৎপাদন কমিয়েছে আরও ১৮টি কেন্দ্র। ফলস্বরূপ, সামগ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার একটি বড় অংশ থমকে আছে জ্বালানি ঘাটতিতে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাধারণত প্রাকৃতিক গ্যাস, ফার্নেস অয়েল, কয়লা, এলএনজি ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। দেশের অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাসভিত্তিক। তবে, প্রাকৃতিক গ্যাসের অভাবে বর্তমানে সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে ১৫টি কেন্দ্রের উৎপাদন। সেগুলো হলো ঘোড়াশাল রিপাওয়ারড ইউনিট ৪ (৪১০ মেগাওয়াট), ঘোড়াশাল ইউনিট ৫ (২১০ মেগাওয়াট), ঘোড়াশাল ইউনিট ৭ (৩৬৫ মেগাওয়াট), ঘোড়াশাল (১০৮ মেগাওয়াট), টঙ্গী (৮০ মেগাওয়াট), সিদ্ধিরগঞ্জ (১২০ মেগাওয়াট), মেঘনাঘাট (৩৩৫ মেগাওয়াট), মেঘনাঘাট (৫৮৩ মেগাওয়াট), মেঘনাঘাট জেরা (৭১৮ মেগাওয়াট), চিটাগং (৪২০ মেগাওয়াট), কর্ণফুলী পাওয়ার লিমিটেড (১১০ মেগাওয়াট), আশুগঞ্জ (৪৫০ মেগাওয়াট), ফেঞ্চুগঞ্জ (৯৭ মেগাওয়াট), বাঘাবাড়ী (৭১ মেগাওয়াট) ও সিরাজগঞ্জ ইউনিট ২-৩ (২২৫ মেগাওয়াট)।
মোট কথা, গ্যাসের অভাবে সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। দেশের দৈনিক গড় বিদ্যুৎ চাহিদা প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে এই চাহিদার ১৬ শতাংশ পূরণ করা হচ্ছে আমদানি করা বিদ্যুতের মাধ্যমে। বর্তমানে বাংলাদেশ ভারত ও নেপাল থেকে মোট ২,৬৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে। এর উৎসগুলো হলো ভেড়ামারা থেকে ১,০০০ মেগাওয়াট, ত্রিপুরা থেকে ১৬০ মেগাওয়াট, আদানি পাওয়ার থেকে ১,৪৯৬ মেগাওয়াট এবং নেপাল থেকে ১৪ মেগাওয়াট।
এছাড়া, পিডিবির দৈনিক উৎপাদনের হিসাব অনুযায়ী, জ্বালানি তেলভিত্তিক ১০টি কেন্দ্রের উৎপাদনও সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। সেগুলো হলো, রূপসা (১০৫ মেগাওয়াট), মধুমতী (১০০ মেগাওয়াট), চৌমুহনী (১১৩ মেগাওয়াট), সাইদপুর (১৫০ মেগাওয়াট), সাইদপুর (২০ মেগাওয়াট), গাগনগর (১০২ মেগাওয়াট), মেঘনাঘাট (১০৪ মেগাওয়াট), পতেঙ্গা (৫০ মেগাওয়াট), শিকলবাহা (১০৫ মেগাওয়াট), কর্ণফুলী পাওয়ার লিমিটেড (১০০ মেগাওয়াট)।
তেলভিত্তিক আরও কয়েকটি কেন্দ্রের উৎপাদন কম ছিল। যদিও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে সরকার প্রয়োজন অনুসারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে এবং প্রয়োজন ছাড়া যথাসম্ভব কম উৎপাদন করার চেষ্টা করে।
অন্যদিকে, কারিগরি কারণে উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে আরও পাঁচটি কেন্দ্রের। সেগুলো হলো, শিকলবাহা (১০৫ মেগাওয়াট), আশুগঞ্জ (২২৫ মেগাওয়াট), শাহজিবাজার (৩৩০ মেগাওয়াট), বাঘাবাড়ী (১০০ মেগাওয়াট) ও বড়পুকুরিয়া (২৭৫ মেগাওয়াট)। প্রাকৃতিক গ্যাস বাদে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ফার্নেস অয়েল, এলএনজি এবং ক্ষেত্রবিশেষে কয়লাও আমদানি করতে হয়। ফলস্বরূপ, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ার অনেকটাই আমদানির ওপর নির্ভরশীল।
চাহিদা অনুযায়ী এই কেন্দ্রগুলো পুরোদমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। বিশেষ করে, আদানির বিদ্যুতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা অনেক বেশি। এই কেন্দ্র থেকে সরবরাহ বন্ধ থাকলে দেশজুড়ে এবং উল্লেখযোগ্যভাবে উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক লোডশেডিং দেখা দেয়।
সঠিক পরিকল্পনা থাকলে সমপরিমাণ প্রচেষ্টা দেশে দিয়েই যথেষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত, তাহলে আর আমদানি করতে হতো না। তাই ভবিষ্যতে যে সরকার আসবে, তাদের উচিত এ বিষয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
ক্রমাগত আমদানি বিদ্যুৎ ক্রয়ের পরিমাণও বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের শুরুতে আমদানি বিদ্যুৎ ক্রয়ে দৈনিক খরচ হতো ১৭ কোটি টাকা, যা এপ্রিল মাসে বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ কোটি টাকা এবং চলতি অক্টোবর মাসে তা গড়ে ৩০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
জ্বালানি খাতের আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) তথ্যমতে, ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত দেশে মোট বিদ্যুৎ ব্যবহারে আমদানি বিদ্যুতের পরিমাণ ৪০ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ৬২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট বিদ্যুতের ব্যবহার ছিল ৭১ হাজার ৪১৯ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা, যার মধ্যে আমদানি করা বিদ্যুতের পরিমাণ ৩৯ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮০ হাজার ৪২৩ মিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুতের ব্যবহার হয়েছে, যার মধ্যে আমদানি করা বিদ্যুতের পরিমাণ ৫০ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৫ হাজার ৬০৭ মিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুতের মধ্যে ৫৫ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৮৮ হাজার ৪৫০ মিলিয়ন কিলোওয়াটের ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় এক লাখ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের মধ্যে প্রায় ৬২ শতাংশ বিদ্যুতই আমদানি করা বিদ্যুৎ। জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যুৎ খাতের এই আমদানিনির্ভরতা আর্থিক বোঝা বাড়ানোর পাশাপাশি জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি করছে। আমদানিনির্ভরতা কমাতে সরকারের সঠিক পলিসি তৈরি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর গুরুত্ব দেয়া ছাড়া বিকল্প নেই।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, বিদ্যুৎ আমদানি করতে হচ্ছে কারণ, আমরা ঠিকমতো জ্বালানি সরবরাহ করতে পারছি না। এই আমদানির পরিকল্পনা কিন্তু আগের সরকারের করা। এখন যে ইনপুটটা আমরা দিচ্ছি, সেখান থেকে যদি বিদ্যুৎটা না নিই, তাহলে আমাদেরই লোকসান হবে।
জ্বালানির ঘাটতি নিরসনে কাজ চলছে। তবে, আমদানি বিদ্যুৎ বাড়ানোর এখন কোনো পরিকল্পনা নেই বিদ্যুৎ সচিব ফারজানা মমতাজ। তিনি আরও বলেন, ‘সঠিক পরিকল্পনা থাকলে সমপরিমাণ প্রচেষ্টা দেশে দিয়েই যথেষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত, তাহলে আর আমদানি করতে হতো না। তাই ভবিষ্যতে যে সরকার আসবে, তাদের উচিত এ বিষয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বাংলাদেশ অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে এ খাতের ভূমিকা সামান্যই। বর্তমানে ১৩টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে গড়ে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। বায়ু শক্তিভিত্তিক দুটি কেন্দ্র (কক্সবাজার ৬০ মেগাওয়াট ও সিরাজগঞ্জ ২ মেগাওয়াট) থেকে কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে না।
‘বিদ্যুতের ব্যবহার বেশি দেখানোর জন্য একের পর এক কেন্দ্র বানানো হয়েছে’ ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি- ২০২৫’ অনুযায়ী, সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে মোট বিদ্যুতের চাহিদার ২০ শতাংশ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ পূরণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এর অংশ হিসেবে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে তিন হাজার মেগাওয়াট ছাদ সৌরবিদ্যুৎ (রুফটপ সোলার) উৎপাদনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।
তবে, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাব্যতা নিয়ে আইইইএফএ-এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে তিন হাজার মেগাওয়াট রুফটপ সোলার উৎপাদনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কঠিন হতে পারে। কারণ, ২০০৮ সালের জুন থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ মাত্র ২৪৫ মেগাওয়াট রুফটপ সোলার উৎপাদনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পেরেছে।
এ প্রসঙ্গে ইজাজ হোসেন বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা থাকলে এতদিনে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হতো। কিন্তু সরকার পরিকল্পনা করে রাখলেও তা বাস্তবায়ন (এক্সিকিউট) করতে পারেনি। সার্বিক বিষয়ে বিদ্যুৎ সচিব ফারজানা মমতাজ বলেন, জ্বালানির ঘাটতি নিরসনে কাজ চলছে। তবে, আমদানি বিদ্যুৎ বাড়ানোর এখন কোনো পরিকল্পনা নেই।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাধারণত প্রাকৃতিক গ্যাস, ফার্নেস অয়েল, কয়লা, এলএনজি ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। দেশের অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাসভিত্তিক। তবে, প্রাকৃতিক গ্যাসের অভাবে বর্তমানে সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে ১৫টি কেন্দ্রের উৎপাদন। সেগুলো হলো ঘোড়াশাল রিপাওয়ারড ইউনিট ৪ (৪১০ মেগাওয়াট), ঘোড়াশাল ইউনিট ৫ (২১০ মেগাওয়াট), ঘোড়াশাল ইউনিট ৭ (৩৬৫ মেগাওয়াট), ঘোড়াশাল (১০৮ মেগাওয়াট), টঙ্গী (৮০ মেগাওয়াট), সিদ্ধিরগঞ্জ (১২০ মেগাওয়াট), মেঘনাঘাট (৩৩৫ মেগাওয়াট), মেঘনাঘাট (৫৮৩ মেগাওয়াট), মেঘনাঘাট জেরা (৭১৮ মেগাওয়াট), চিটাগং (৪২০ মেগাওয়াট), কর্ণফুলী পাওয়ার লিমিটেড (১১০ মেগাওয়াট), আশুগঞ্জ (৪৫০ মেগাওয়াট), ফেঞ্চুগঞ্জ (৯৭ মেগাওয়াট), বাঘাবাড়ী (৭১ মেগাওয়াট) ও সিরাজগঞ্জ ইউনিট ২-৩ (২২৫ মেগাওয়াট)।
মোট কথা, গ্যাসের অভাবে সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। দেশের দৈনিক গড় বিদ্যুৎ চাহিদা প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে এই চাহিদার ১৬ শতাংশ পূরণ করা হচ্ছে আমদানি করা বিদ্যুতের মাধ্যমে। বর্তমানে বাংলাদেশ ভারত ও নেপাল থেকে মোট ২,৬৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে। এর উৎসগুলো হলো ভেড়ামারা থেকে ১,০০০ মেগাওয়াট, ত্রিপুরা থেকে ১৬০ মেগাওয়াট, আদানি পাওয়ার থেকে ১,৪৯৬ মেগাওয়াট এবং নেপাল থেকে ১৪ মেগাওয়াট।
এছাড়া, পিডিবির দৈনিক উৎপাদনের হিসাব অনুযায়ী, জ্বালানি তেলভিত্তিক ১০টি কেন্দ্রের উৎপাদনও সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। সেগুলো হলো, রূপসা (১০৫ মেগাওয়াট), মধুমতী (১০০ মেগাওয়াট), চৌমুহনী (১১৩ মেগাওয়াট), সাইদপুর (১৫০ মেগাওয়াট), সাইদপুর (২০ মেগাওয়াট), গাগনগর (১০২ মেগাওয়াট), মেঘনাঘাট (১০৪ মেগাওয়াট), পতেঙ্গা (৫০ মেগাওয়াট), শিকলবাহা (১০৫ মেগাওয়াট), কর্ণফুলী পাওয়ার লিমিটেড (১০০ মেগাওয়াট)।
তেলভিত্তিক আরও কয়েকটি কেন্দ্রের উৎপাদন কম ছিল। যদিও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে সরকার প্রয়োজন অনুসারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে এবং প্রয়োজন ছাড়া যথাসম্ভব কম উৎপাদন করার চেষ্টা করে।
অন্যদিকে, কারিগরি কারণে উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে আরও পাঁচটি কেন্দ্রের। সেগুলো হলো, শিকলবাহা (১০৫ মেগাওয়াট), আশুগঞ্জ (২২৫ মেগাওয়াট), শাহজিবাজার (৩৩০ মেগাওয়াট), বাঘাবাড়ী (১০০ মেগাওয়াট) ও বড়পুকুরিয়া (২৭৫ মেগাওয়াট)। প্রাকৃতিক গ্যাস বাদে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ফার্নেস অয়েল, এলএনজি এবং ক্ষেত্রবিশেষে কয়লাও আমদানি করতে হয়। ফলস্বরূপ, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ার অনেকটাই আমদানির ওপর নির্ভরশীল।
চাহিদা অনুযায়ী এই কেন্দ্রগুলো পুরোদমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। বিশেষ করে, আদানির বিদ্যুতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা অনেক বেশি। এই কেন্দ্র থেকে সরবরাহ বন্ধ থাকলে দেশজুড়ে এবং উল্লেখযোগ্যভাবে উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক লোডশেডিং দেখা দেয়।
সঠিক পরিকল্পনা থাকলে সমপরিমাণ প্রচেষ্টা দেশে দিয়েই যথেষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত, তাহলে আর আমদানি করতে হতো না। তাই ভবিষ্যতে যে সরকার আসবে, তাদের উচিত এ বিষয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
ক্রমাগত আমদানি বিদ্যুৎ ক্রয়ের পরিমাণও বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের শুরুতে আমদানি বিদ্যুৎ ক্রয়ে দৈনিক খরচ হতো ১৭ কোটি টাকা, যা এপ্রিল মাসে বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ কোটি টাকা এবং চলতি অক্টোবর মাসে তা গড়ে ৩০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
জ্বালানি খাতের আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) তথ্যমতে, ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত দেশে মোট বিদ্যুৎ ব্যবহারে আমদানি বিদ্যুতের পরিমাণ ৪০ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ৬২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট বিদ্যুতের ব্যবহার ছিল ৭১ হাজার ৪১৯ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা, যার মধ্যে আমদানি করা বিদ্যুতের পরিমাণ ৩৯ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮০ হাজার ৪২৩ মিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুতের ব্যবহার হয়েছে, যার মধ্যে আমদানি করা বিদ্যুতের পরিমাণ ৫০ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৫ হাজার ৬০৭ মিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুতের মধ্যে ৫৫ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৮৮ হাজার ৪৫০ মিলিয়ন কিলোওয়াটের ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় এক লাখ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের মধ্যে প্রায় ৬২ শতাংশ বিদ্যুতই আমদানি করা বিদ্যুৎ। জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যুৎ খাতের এই আমদানিনির্ভরতা আর্থিক বোঝা বাড়ানোর পাশাপাশি জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি করছে। আমদানিনির্ভরতা কমাতে সরকারের সঠিক পলিসি তৈরি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর গুরুত্ব দেয়া ছাড়া বিকল্প নেই।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, বিদ্যুৎ আমদানি করতে হচ্ছে কারণ, আমরা ঠিকমতো জ্বালানি সরবরাহ করতে পারছি না। এই আমদানির পরিকল্পনা কিন্তু আগের সরকারের করা। এখন যে ইনপুটটা আমরা দিচ্ছি, সেখান থেকে যদি বিদ্যুৎটা না নিই, তাহলে আমাদেরই লোকসান হবে।
জ্বালানির ঘাটতি নিরসনে কাজ চলছে। তবে, আমদানি বিদ্যুৎ বাড়ানোর এখন কোনো পরিকল্পনা নেই বিদ্যুৎ সচিব ফারজানা মমতাজ। তিনি আরও বলেন, ‘সঠিক পরিকল্পনা থাকলে সমপরিমাণ প্রচেষ্টা দেশে দিয়েই যথেষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত, তাহলে আর আমদানি করতে হতো না। তাই ভবিষ্যতে যে সরকার আসবে, তাদের উচিত এ বিষয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বাংলাদেশ অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে এ খাতের ভূমিকা সামান্যই। বর্তমানে ১৩টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে গড়ে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। বায়ু শক্তিভিত্তিক দুটি কেন্দ্র (কক্সবাজার ৬০ মেগাওয়াট ও সিরাজগঞ্জ ২ মেগাওয়াট) থেকে কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে না।
‘বিদ্যুতের ব্যবহার বেশি দেখানোর জন্য একের পর এক কেন্দ্র বানানো হয়েছে’ ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি- ২০২৫’ অনুযায়ী, সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে মোট বিদ্যুতের চাহিদার ২০ শতাংশ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ পূরণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এর অংশ হিসেবে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে তিন হাজার মেগাওয়াট ছাদ সৌরবিদ্যুৎ (রুফটপ সোলার) উৎপাদনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।
তবে, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাব্যতা নিয়ে আইইইএফএ-এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে তিন হাজার মেগাওয়াট রুফটপ সোলার উৎপাদনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কঠিন হতে পারে। কারণ, ২০০৮ সালের জুন থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ মাত্র ২৪৫ মেগাওয়াট রুফটপ সোলার উৎপাদনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পেরেছে।
এ প্রসঙ্গে ইজাজ হোসেন বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা থাকলে এতদিনে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হতো। কিন্তু সরকার পরিকল্পনা করে রাখলেও তা বাস্তবায়ন (এক্সিকিউট) করতে পারেনি। সার্বিক বিষয়ে বিদ্যুৎ সচিব ফারজানা মমতাজ বলেন, জ্বালানির ঘাটতি নিরসনে কাজ চলছে। তবে, আমদানি বিদ্যুৎ বাড়ানোর এখন কোনো পরিকল্পনা নেই।