দেশে এডিস মশাজনিত রোগ ডেঙ্গুর সংক্রমণ দিনকে দিন ভয়াবহ রুপ ধারন করেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া তথ্য বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ৬৯ জন রোগী। গত মঙ্গলবার ২৪ ঘণ্টায় আরও ৫ জনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৩০২ জনের। সবমিলিয়ে ৭৫ হাজার ৯৯২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাসের সাথে এ বছরের তুলনা করলে দেখা যায়, ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে ৫৩ শতাংশ। মৃত্যুর হার বেড়েছে ১৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এতে শঙ্কা প্রকাশ করে সরকারের বিরুদ্ধে সমন্বয়হীনতার অভিযোগ করছেন নাগরিক সমাজ।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন এবং ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুবরণ করেছেন ৫৭৫ জন। এর আগে ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট এক হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয় এবং ওই বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন মোট তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। ফলে জনমনে এক ধরনের উদ্বেগও তৈরি হয়েছে। তবে কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, অক্টোবর মাস ডেঙ্গু সংক্রমণের সবচেয়ে উপযোগী সময়। তবে চলতি নভেম্বর মাস থেকে প্রতিদিনই সংক্রমণ আরও বাড়বে। কিন্তু এমন আতঙ্ক ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার বিভাগ বা তার সংস্থা সিটি করপোরেশন কী ভূমিকা রাখছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু মূলত বর্ষাকালের রোগ। বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বাড়ে অগাস্ট মাসে। কিন্তু ২০২১ সাল থেকে এই দৃশ্যের পরিবর্তন হতে শুরু করে। এখন সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয় অক্টোবর মাসে। এবারও এ মাসে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধির শঙ্কার কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ক্লাইমেট চেঞ্জ বা জলবায়ু পরির্তনের ফলে এ বছর গত কয়েক সপ্তাহের ব্যাপক পরিমাণে বৃষ্টিপাতের কারণে অক্টোবরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়বে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে মশক ব্যবস্থাপনা সিস্টেমে এ বছর একটু চেইন অব কমাণ্ডটা আমরা দুর্বল দেখি। আরেকটা কারণ হচ্ছে ডেঙ্গুর রোগী যখন বাড়ে তখন এটাকে এপিডেমোলজিকেল ট্রায়াঙ্গেলকে ব্রেক বা ভাঙতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ এই ট্রায়াঙ্গেল থামাতে পারছে না, একইসাথে সেক্টর ব্যবস্থাপনাও করা যাচ্ছে না। ফলে ডেঙ্গুর ব্যাপক সংক্রমণ বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি। এডিস মশার লার্ভা বা শূককীটের ঘনত্ব পরিমাপের স্বীকৃত পদ্ধতি হলো ‘ব্রুটো ইনডেক্স (বিআই)’। এই ইনডেক্স অনুযায়ী, কোনো স্থানে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব ২০ এর উপরে থাকলে এপিডেমোলজিকেল তত্ত্ব অনুযায়ী সেই স্থানে এই মশাবাহিত রোগ ছড়ায়। বাংলাদেশের প্রায় ৬৪ জেলাতেই ডেঙ্গুর প্রকোপ রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১০ জেলায় গত কয়েক মাসে সংক্রমণের হার বেশি। এই জেলাগুলো হলো ঢাকা, বরিশাল, বরগুনা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পটুয়াখালী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, গাজীপুর এবং পিরোজপুর। এই জেলাগুলোতে ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর ওপরে রয়েছে। কোনো কোনো জেলায় এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব ৭০ বা ৮০ ও পাওয়া যায় বলে জানান কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেই এই মশার ঘনত্ব ২০ এর ওপরে বলে জানান তিনি। এর আগে, গত জুন মাসের তথ্য ঘাঁটলে দেখা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোশেরশনের ১৩ টি স্থানকে ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
এদিকে, কুমিল্লার সিভিল সার্জন আলী নূর মোহাম্মদ বশীর আহমেদ অবশ্য দাবি করেন, গত এক মাসে এই জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কোনো মৃত্যুর ঘটনা নেই। এছাড়া ডেঙ্গু সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে চলে এসছে। একটা সময়ে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলায় তিনটা গ্রামে খুব বেশি ছিল। গ্রামগুলার নাম হচ্ছে শাহপাড়া, সবজীকান্দি, ডোনার চর। ওইটা মোটামুটি কন্ট্রোলে চলে আসছে। এখন সারা বাংলাদেশের মতোই আবার কুমিল্লাতেও কিছু কিছু আছে। তিনি জানান, ডেঙ্গুর রোগী আছে, চিকিৎসাও চলছে। পর্যাপ্ত পরিমাণে ডেঙ্গুর ওষুধ আছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। গত মাসে এই জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৫৩০ জন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে এখনও চিকিৎসাধীন রয়েছেন। যদিও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়াও বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত একটি টাস্কফোর্স কাজ করে যাচ্ছে। সামনের মাসগুলোতে এ উদ্যোগ আরো বাড়বে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার কথা স্বীকার করে এটি সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান এই উপদেষ্টা। এরই মধ্যে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা দুইশ ছাড়ানোর কথা জানেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি। আসিফ মাহমুদ বলেন,অনেক সময় আমাদের যেই সিদ্ধান্ত হয় সেটা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা ক্ষেত্রেই দফতর ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আসলে দেখা যায়। আমরা সেটা সলভ করার চেষ্টা করছি। সমস্যা সমাধানে জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ডেঙ্গুর মতো কাজগুলো তাই মন্ত্রণালয়ের দক্ষ ব্যক্তিদের দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং ‘অলরেডি উদ্যোগ নিয়েছি’ জানান তিনি। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধির বিষয়টি সরকারের নজরে রয়েছে বলে জানান স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ যারা স্টেক হোল্ডার আছে তাদের নিয়ে আমাদের একটা টাস্কফোর্স আছে। সর্বশেষ মিটিং এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী টাস্কফোর্স কাজও করে যাচ্ছে। যেহেতু এই সময়টাতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে আমার ইতোমধ্যেই ইন্টারনালি সংস্থাগুলোর মধ্যে কথা হয়েছে। এই কমিটির বৈঠক এই সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে বলে জানান তিনি। ডেঙ্গুর স্থায়ী সমাধানের জন্য এডিস মশার লার্ভা ও মশক নিধনের জন্য পৃথিবীতে কার্যকরী যেসব ব্যবস্থা রয়েছে সেগুলো নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কাজ করছেন বলেও জানান স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ।
গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি, অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুমের ডেঙ্গু ড্যাশবোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় পাঁচজন, উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় তিনজন এবং খুলনা ও বরিশাল বিভাগে একজন করে মারা গেছেন। এতে বলা হয়েছে, গত একদিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০৬৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১২৮ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৯৯ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে) ২১৯ জন, ঢাকা উত্তর সিটিতে ২৫১ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ১৫২ জন, খুলনা বিভাগে ৬৮ জন (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে), ময়মনসিংহ বিভাগে ৭০ জন (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে), রাজশাহী বিভাগে ৩৪ জন (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে), রংপুর বিভাগে ৪৩ জন (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে) এবং সিলেট বিভাগে ৫ জন (সিটি করপোরেশনের বাইরে) নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন। গত একদিনে সারা দেশে ৯৫৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ছাড়পত্র পেয়েছেন ৭১ হাজার ৪৮৭ জন। এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৭৫ হাজার ৯৯২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৩০২ জনের।
এদিকে, চলতি বছরের নভেম্বরে ডেঙ্গু আক্রান্তের হিসাব পাল্টে দিয়েছে যেন সব চিত্র। এ মাসের শুরুতেই এক দিনে সর্বোচ্চ ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে। প্রতিদিনই আক্রান্ত হচ্ছে নতুন নতুন রোগী। হাসপাতালে ভর্তিদের মধ্যে কেউ কেউ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও বেশির ভাগই কাতরাচ্ছে জ্বরে। সিটি করপোরেশন লোক দেখানো পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করলেও কার্যত মশা নিয়ন্ত্রণ কিছুই হচ্ছে না বলে অভিযোগ নগরবাসীর। তবে সিটি করপোরেশন বলছে, নগরবাসীর অসচেতনতার কারণেই অনেক চেষ্টায়ও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা। ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভিন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন,আমরা কীটনাশক প্রয়োগের আগে আইইডিসিআর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও নিজেদের পরীক্ষায় ৯৫ শতাংশ কার্যকারিতা নিশ্চিত হই। রোগীর তালিকা অনুযায়ী ফগিং করা হয়। তবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়েও নানা জটিলতায় ভুগছেন অনেকেই। রাজধানীর মহাখালীর বাসিন্দা রিতা দেবনাথ তাদেরই একজন। গর্ভের ছয় মাসের মাথায় অক্টোবরের মাঝামাঝিতে আক্রান্ত হন ডেঙ্গুতে। রাজধানীর হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে প্রায় দুই সপ্তাহ চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হলেও এখনো শারীরিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। তিনি বলেন, একে তো গর্ভাবস্থা, তার ওপর ডেঙ্গু। এর প্রভাবে তখনই শরীরে খুব চুলকানি হয়েছিল। কিন্তু গর্ভের সন্তানের নিরাপত্তার জন্য ডাক্তার কোনো ওষুধ ব্যবহার করতে মানা করেন। এই অবস্থা এখনো আছে। শুধু তাই নয়, খাবারে অনীহা, শারীরিক দুর্বলতা তো রয়েছেই। এমন রোগ যেন কারোই না হয়। একই কথা জানান ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়া করা ৩ মাস বয়সী শিশুসন্তান আফাদের বাবা আহমেদুল হক।