সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার নিয়ে দেশের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ বাজেট পেশ করা হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য উত্থাপিত ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাবে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল, যা পরে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু সেই লক্ষ্যেও পৌঁছানো যায়নি। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এটি তার প্রথম বাজেট। আর আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের ১৬তম বাজেট। এ সময় জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপিস্থিতিতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ করা হয়।
জিডিপি নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ২০০৯-১০ অর্থবছর হতে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৭ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির এ গতি ধরে রাখার লক্ষ্যে কৃষি ও শিল্প খাতের উৎপাদন উৎসাহিত করতে যৌক্তিক সকল সহায়তা অব্যাহত রাখা হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পসমূহের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং রফতানি ও প্রবাস আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। আশা করছি, আমাদের গৃহীত এসকল নীতিকৌশলের ফলে আগামী অর্থবছরে ৬.৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে এবং মধ্যমেয়াদে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৭.২৫ শতাংশে পৌঁছাবে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেকর্ড ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল বাংলাদেশ। এরপর মহামারীকালের মধ্যেও ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী। অর্জিত হয় ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ, যা কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন।
তবে মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশে দাঁড়ায়। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয় ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্য ধরেছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। পরে তা সংশোধন করে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশে নামানো হয়। যদিও তাও অর্জন হয়নি। সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার প্রতিপাদ্যে ২০২৪-২৫ বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। বাকি দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকবে। দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ইতোমধ্যে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে কথা বলেন। এগুলোর জন্য তিনি দায়ী করেন কোভিড-পরবর্তী ‘রাশিয়া-ইউক্রেন’ যুদ্ধকে। একইসঙ্গে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে রিজার্ভ বাড়বে এবং মূল্যস্ফীতি কমবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এবার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা, যা গত অর্থবছর ছিল ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। নতুন বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয় ২ লাখ ৮৩ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা।
এদিকে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। মাত্র তিনদিন আগে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মে মাসের ভোক্তা মূল্য সূচকের (সিপিআই) হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে দেখা গেছে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ, যা ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার আরও বেড়ে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ হয়। এরই মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। বাজেট পেশের সময় মূল্যস্ফীতির লাগাম ৬ দশমিক ৫০ শতাংশে বেঁধে রাখার প্রত্যাশা করেছেন তিনি। সাড়ে ৬ শতাংশে মূল্যস্ফীতি নামিয়ে আনাকে চ্যালেঞ্জ বলছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা কঠিন হলেও কিছু পলিসি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন চলমান রাখলে কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব বলেও মত অর্থনীতিবিদদের।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকার কিছু পলিসি নিয়েছে। এসব বাস্তবায়ন করতে হবে। একদিন করলাম, পরে বসে থাকলাম। এটা করলে হবে না।সরকারের উচিত টাইট পলিসি কন্টিনিউ করা। সরকার ব্যাংকগুলোকে যে লিকুইডিটি সাপোর্ট দিচ্ছে, এটা বন্ধ করতে হবে। পলিসি রেট বাড়াতে হবে। মনিটরি পলিসি রেট সাড়ে ৮ আছে, এটা বৃদ্ধি করে সাড়ে ১০ করতে হবে। এক্সচেঞ্জ রেট বাজার অনুযায়ী করতে হবে। তাহলে মূল্যস্ফীতি কমবে। তবে সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা কঠিন। সরকার যদি এগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করে তবে সাড়ে ৬ শতাংশের কাছাকাছি যেতে পারে। বিবিএস জানায়, মে মাসে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। খাদ্যপণ্য যেন নাগালের বাইরে গেছে। বিবিএসের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পয়েন্ট টু পয়েন্টের ভিত্তিতে এক বছরের ব্যবধানে ১০০ টাকার খাদ্যপণ্যে দাম বেড়েছে ১০ টাকা ৭৬ পয়সা।
বিবিএসের তথ্যে দেখা গেছে, এপ্রিল থেকে বাড়তে বাড়তে মে মাসে খাদ্যপণ্য মূল্যবৃদ্ধির রেকর্ড গড়েছে। চাল, ডাল, তেল, লবণ, মাছ, মাংস, সবজি, মসলা ও তামাকজাতীয় পণ্যের দাম বাড়ায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। তবে যেইভাবে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে সেভাবে বাড়ছে না মজুরি। মে মাসে যেখানে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ, সেখানে মজুরি সূচকের হার ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ফলে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমানতালে বাড়ছে না আয়। আগামী অর্থবছরের (২০২৪-২৫) প্রস্তাবিত বাজেটে স্থাবর সম্পত্তি যেমন- ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য নির্দিষ্ট কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ থাকছে। এছাড়া নগদ অর্থসহ অন্যান্য পরিসম্পদের ওপর ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত অর্থ (কালো টাকা) বৈধ করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। দেশের প্রচলিত আইনে যাই থাকুক না কেন-এক্ষেত্রে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের প্রশ্ন তুলতে পারবে না। অর্থাৎ এবার বিনাপ্রশ্নে কালো টাকা সদা করার সুযোগ থাকছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, চলমান বৈশ্বিক সংকটের কারণে পরিবর্তিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখা আবশ্যক। অর্থনীতিতে কার্যকর চাহিদা সৃষ্টি এবং তা বজায় রাখার লক্ষ্যে পর্যাপ্ত সরকারি ব্যয় নির্বাহের জন্য আমাদের অধিক পরিমাণ রাজস্ব জোগান দিতে হবে। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল রাখতে হবে। তিনি বলেন, ডেটা ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস) চালু হওয়ার ফলে বিভিন্ন কোম্পানির অপ্রদর্শিত আয় ও পরিসম্পদ প্রদর্শনে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া রিটার্ন দাখিলে করদাতার অজ্ঞতাসহ অনিবার্য কিছু কারণে অর্জিত সম্পদ প্রদর্শনে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। এই অবস্থায় করদাতাদের আয়কর রিটার্নে এই ত্রুটি সংশোধনের সুযোগ দেয়া হবে। অর্থনীতির মূল স্রোতে অর্থ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে অর্থমন্ত্রী আয়কর আইনে কর প্রণোদনা সংক্রান্ত একটি অনুচ্ছেদ সংযোজনের প্রস্তাব করেছেন। এই প্রস্তাব অনুযায়ী, দেশের প্রচলিত আইনে যাই থাকুক না কেন, কোনো করদাতা স্থাবর সম্পত্তি যেমন- ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য নির্দিষ্ট করহার এবং নগদসহ অন্যান্য পরিসম্পদের ওপর ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করলে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রকারের প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না।
ব্যাংকে জমা টাকার ওপর আবগারি শুল্কের স্তর ও হারে পরিবর্তন আসছে। এতে ব্যাংকে টাকা রাখার খরচ বাড়বে। তবে পরিবর্তনের এ স্রোত ছোট আমানতকারীদের ওপর প্রভাব ফেলবে না, প্রভাব পড়বে বড় আমানতকারীদের ওপর। কারণ ব্যাংকে গ্রাহকের ১০ লাখ টাকার বেশি থাকলেই বাড়তি শুল্ক দিতে হবে। দুই অর্থবছর পর আবারও ব্যাংকে জমা টাকার ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। বর্তমানে ছয়টি স্তরে শুল্ক নেয়া হলেও প্রস্তাবিত বাজেটে এ স্তর হচ্ছে আটটি। যেখানে গ্রাহকের আমানত ১০ লাখ টাকার বেশি হলে বাড়তি অর্থ দিতে হবে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংকে থাকা টাকার ওপর আবগারি শুল্কের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছিল। কোনো ব্যাংক হিসাবে আমানতের পরিমাণ বছরে ১ লাখ টাকার বেশি হলেই আবগারি শুল্ক দিতে হয়। বর্তমানে শুল্কের স্তর ছয়টি থাকলেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে তা বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫০ টাকা ও পাঁচ লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত ৫০০ টাকা আবগারি শুল্ক রয়েছে।
বর্তমানে এক লাখ পর্যন্ত ব্যাংক হিসাবের স্থিতিতে কোনো আবগারি শুল্ক দিতে হয় না। আবার এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫০ টাকা এবং পাঁচ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ৫০০ টাকা আবগারি শুল্ক দিতে হয়। এই দুটি স্তরে কোনো পরিবর্তন আসছে না। প্রস্তাবিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ১০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত আবগারি শুল্কের যে স্তরটি রয়েছে, সেটি ভেঙে দুটি স্তর করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ১০ লাখ টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত গচ্ছিত টাকায় আগের মতোই তিন হাজার টাকা আবগারি শুল্ক থাকবে। আর ৫০ লাখ টাকা থেকে এক কোটি পর্যন্ত ৩ হাজার টাকার পরিবর্তে ৫ হাজার টাকা শুল্ক বসবে। আর এক কোটি টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত বিদ্যমান স্তরটিও ভেঙে দেয়া হচ্ছে। নতুন অর্থবছরে এক কোটি থেকে দুই কোটি পর্যন্ত ১০ হাজার টাকা, দুই কোটি থেকে পাঁচ কোটি পর্যন্ত ২০ হাজার টাকা শুল্ক দিতে হবে। বর্তমানে এক কোটি থেকে পাঁচ কোটি পর্যন্ত আমানতে আবগারি শুল্ক ১৫ হাজার টাকা। ব্যাংক হিসাবে বছরে একবার যদি স্থিতি পাঁচ কোটি টাকা অতিক্রম করে, তাহলে সেই আমানতের ওপর আবগারি শুল্কের পরিমাণ হবে ৫০ হাজার টাকা। বর্তমানে এই স্তরে ৪০ হাজার টাকা দিতে হয়।
সাধারণত জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে কোনো ব্যাংক হিসাবে আমানতের পরিমাণ একবার এক লাখ টাকা বা তার ওপরের স্তরগুলোর সীমা স্পর্শ করলেই নির্দিষ্ট হারে আবগারি শুল্ক দিতে হয়। একাধিকবার স্পর্শ করলেও একবারই আবগারি শুল্ক কাটা হয় ওই গ্রাহকের হিসাব থেকে। আর কোনো হিসাবে এক লাখ টাকার কম থাকলে আবগারি শুল্ক কাটা হয় না। স্বাস্থ্য সেবা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪১ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৩৮ হাজার ৫১ কোটি টাকা। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় ২ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দের প্রস্তাব করছি। পাশাপাশি চিকিৎসা বিজ্ঞানের মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার গুরুত্ব বিবেচনায় ‘সমন্বিত স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিললে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি। তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য সেবা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণের অব্যাহত অগ্রগতি বজায় রাখার নিমিত্ত আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪১ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৩৮ হাজার ৫১ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর উত্থাপিত প্রস্তাবিত বাজেটের আকার সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’ প্রতিপাদ্যে এই বাজেট বিদায়ী ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। টাকার অংকে ৩৫ হাজার ২১৫ কোটি টাকা বেশি। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটের আকার সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা।
নতুন বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ধরা হয়েছে দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরে ছিল ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। নতুন বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে দুই লাখ ৮৩ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ লাখ ৪৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরে ছিল পাঁচ লাখ কোটি টাকা। নতুন বাজেটে জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। টাকার অংকে ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরে যা ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। পরে তা কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হয়। বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। মোট বরাদ্দের বৈদেশিক ঋণ বা অনুদান লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ কোটি টাকা। তবে এবারও উন্নয়ন বাজেটে পরিবহন ও বিদ্যুৎখাতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ দুই খাতে তুলনামূলকভাবে অর্থ বরাদ্দও থাকছে বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে এডিপিতে এক অর্থবছরের ব্যবধানে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়ছে ১৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সরকার নতুন উন্নয়ন বাজেটে পরিবহন ও বিদ্যুৎ খাত সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত এডিপির আকার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মূল এডিপি অপেক্ষা দুই হাজার কোটি টাকা বা দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি এবং সংশোধিত এডিপি অপেক্ষা ২০ হাজার কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ বেশি। এছাড়া ১০টি উন্নয়ন সহায়তা খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ৯ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা/করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পসমূহের অনুকূলে প্রস্তাবিত বরাদ্দ ১৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা/করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নসহ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত এডিপির মোট আকার দাঁড়ায় দুই লাখ ৭৮ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা।
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। নতুন অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ঋণ নেবে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের চেয়ে যা ৫ হাজার ১০৫ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী (২০২৪-২৫) অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার বেড়েছে ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মূল বাজেট ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের সংস্থান হবে দেশি-বিদেশি ঋণ থেকে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার বাড়লেও ঘাটতির পরিমাণ কমছে। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি কম ধরা হচ্ছে ৫ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। অনুদান ছাড়া বাজেট ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। তবে অনুদানসহ সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়াবে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা অনুদান পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে। আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা ঠিক করেছে সরকার। যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা কম। চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্য ঠিক করা আছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। এর আগের (২০২২-২৩) অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
জিডিপি নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ২০০৯-১০ অর্থবছর হতে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৭ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির এ গতি ধরে রাখার লক্ষ্যে কৃষি ও শিল্প খাতের উৎপাদন উৎসাহিত করতে যৌক্তিক সকল সহায়তা অব্যাহত রাখা হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পসমূহের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং রফতানি ও প্রবাস আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। আশা করছি, আমাদের গৃহীত এসকল নীতিকৌশলের ফলে আগামী অর্থবছরে ৬.৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে এবং মধ্যমেয়াদে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৭.২৫ শতাংশে পৌঁছাবে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেকর্ড ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল বাংলাদেশ। এরপর মহামারীকালের মধ্যেও ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী। অর্জিত হয় ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ, যা কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন।
তবে মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশে দাঁড়ায়। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয় ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্য ধরেছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। পরে তা সংশোধন করে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশে নামানো হয়। যদিও তাও অর্জন হয়নি। সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার প্রতিপাদ্যে ২০২৪-২৫ বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। বাকি দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকবে। দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ইতোমধ্যে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে কথা বলেন। এগুলোর জন্য তিনি দায়ী করেন কোভিড-পরবর্তী ‘রাশিয়া-ইউক্রেন’ যুদ্ধকে। একইসঙ্গে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে রিজার্ভ বাড়বে এবং মূল্যস্ফীতি কমবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এবার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা, যা গত অর্থবছর ছিল ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। নতুন বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয় ২ লাখ ৮৩ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা।
এদিকে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। মাত্র তিনদিন আগে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মে মাসের ভোক্তা মূল্য সূচকের (সিপিআই) হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে দেখা গেছে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ, যা ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার আরও বেড়ে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ হয়। এরই মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। বাজেট পেশের সময় মূল্যস্ফীতির লাগাম ৬ দশমিক ৫০ শতাংশে বেঁধে রাখার প্রত্যাশা করেছেন তিনি। সাড়ে ৬ শতাংশে মূল্যস্ফীতি নামিয়ে আনাকে চ্যালেঞ্জ বলছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা কঠিন হলেও কিছু পলিসি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন চলমান রাখলে কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব বলেও মত অর্থনীতিবিদদের।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকার কিছু পলিসি নিয়েছে। এসব বাস্তবায়ন করতে হবে। একদিন করলাম, পরে বসে থাকলাম। এটা করলে হবে না।সরকারের উচিত টাইট পলিসি কন্টিনিউ করা। সরকার ব্যাংকগুলোকে যে লিকুইডিটি সাপোর্ট দিচ্ছে, এটা বন্ধ করতে হবে। পলিসি রেট বাড়াতে হবে। মনিটরি পলিসি রেট সাড়ে ৮ আছে, এটা বৃদ্ধি করে সাড়ে ১০ করতে হবে। এক্সচেঞ্জ রেট বাজার অনুযায়ী করতে হবে। তাহলে মূল্যস্ফীতি কমবে। তবে সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা কঠিন। সরকার যদি এগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করে তবে সাড়ে ৬ শতাংশের কাছাকাছি যেতে পারে। বিবিএস জানায়, মে মাসে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। খাদ্যপণ্য যেন নাগালের বাইরে গেছে। বিবিএসের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পয়েন্ট টু পয়েন্টের ভিত্তিতে এক বছরের ব্যবধানে ১০০ টাকার খাদ্যপণ্যে দাম বেড়েছে ১০ টাকা ৭৬ পয়সা।
বিবিএসের তথ্যে দেখা গেছে, এপ্রিল থেকে বাড়তে বাড়তে মে মাসে খাদ্যপণ্য মূল্যবৃদ্ধির রেকর্ড গড়েছে। চাল, ডাল, তেল, লবণ, মাছ, মাংস, সবজি, মসলা ও তামাকজাতীয় পণ্যের দাম বাড়ায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। তবে যেইভাবে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে সেভাবে বাড়ছে না মজুরি। মে মাসে যেখানে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ, সেখানে মজুরি সূচকের হার ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ফলে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমানতালে বাড়ছে না আয়। আগামী অর্থবছরের (২০২৪-২৫) প্রস্তাবিত বাজেটে স্থাবর সম্পত্তি যেমন- ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য নির্দিষ্ট কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ থাকছে। এছাড়া নগদ অর্থসহ অন্যান্য পরিসম্পদের ওপর ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত অর্থ (কালো টাকা) বৈধ করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। দেশের প্রচলিত আইনে যাই থাকুক না কেন-এক্ষেত্রে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের প্রশ্ন তুলতে পারবে না। অর্থাৎ এবার বিনাপ্রশ্নে কালো টাকা সদা করার সুযোগ থাকছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, চলমান বৈশ্বিক সংকটের কারণে পরিবর্তিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখা আবশ্যক। অর্থনীতিতে কার্যকর চাহিদা সৃষ্টি এবং তা বজায় রাখার লক্ষ্যে পর্যাপ্ত সরকারি ব্যয় নির্বাহের জন্য আমাদের অধিক পরিমাণ রাজস্ব জোগান দিতে হবে। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল রাখতে হবে। তিনি বলেন, ডেটা ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস) চালু হওয়ার ফলে বিভিন্ন কোম্পানির অপ্রদর্শিত আয় ও পরিসম্পদ প্রদর্শনে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া রিটার্ন দাখিলে করদাতার অজ্ঞতাসহ অনিবার্য কিছু কারণে অর্জিত সম্পদ প্রদর্শনে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। এই অবস্থায় করদাতাদের আয়কর রিটার্নে এই ত্রুটি সংশোধনের সুযোগ দেয়া হবে। অর্থনীতির মূল স্রোতে অর্থ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে অর্থমন্ত্রী আয়কর আইনে কর প্রণোদনা সংক্রান্ত একটি অনুচ্ছেদ সংযোজনের প্রস্তাব করেছেন। এই প্রস্তাব অনুযায়ী, দেশের প্রচলিত আইনে যাই থাকুক না কেন, কোনো করদাতা স্থাবর সম্পত্তি যেমন- ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য নির্দিষ্ট করহার এবং নগদসহ অন্যান্য পরিসম্পদের ওপর ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করলে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রকারের প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না।
ব্যাংকে জমা টাকার ওপর আবগারি শুল্কের স্তর ও হারে পরিবর্তন আসছে। এতে ব্যাংকে টাকা রাখার খরচ বাড়বে। তবে পরিবর্তনের এ স্রোত ছোট আমানতকারীদের ওপর প্রভাব ফেলবে না, প্রভাব পড়বে বড় আমানতকারীদের ওপর। কারণ ব্যাংকে গ্রাহকের ১০ লাখ টাকার বেশি থাকলেই বাড়তি শুল্ক দিতে হবে। দুই অর্থবছর পর আবারও ব্যাংকে জমা টাকার ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। বর্তমানে ছয়টি স্তরে শুল্ক নেয়া হলেও প্রস্তাবিত বাজেটে এ স্তর হচ্ছে আটটি। যেখানে গ্রাহকের আমানত ১০ লাখ টাকার বেশি হলে বাড়তি অর্থ দিতে হবে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংকে থাকা টাকার ওপর আবগারি শুল্কের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছিল। কোনো ব্যাংক হিসাবে আমানতের পরিমাণ বছরে ১ লাখ টাকার বেশি হলেই আবগারি শুল্ক দিতে হয়। বর্তমানে শুল্কের স্তর ছয়টি থাকলেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে তা বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫০ টাকা ও পাঁচ লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত ৫০০ টাকা আবগারি শুল্ক রয়েছে।
বর্তমানে এক লাখ পর্যন্ত ব্যাংক হিসাবের স্থিতিতে কোনো আবগারি শুল্ক দিতে হয় না। আবার এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫০ টাকা এবং পাঁচ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ৫০০ টাকা আবগারি শুল্ক দিতে হয়। এই দুটি স্তরে কোনো পরিবর্তন আসছে না। প্রস্তাবিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ১০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত আবগারি শুল্কের যে স্তরটি রয়েছে, সেটি ভেঙে দুটি স্তর করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ১০ লাখ টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত গচ্ছিত টাকায় আগের মতোই তিন হাজার টাকা আবগারি শুল্ক থাকবে। আর ৫০ লাখ টাকা থেকে এক কোটি পর্যন্ত ৩ হাজার টাকার পরিবর্তে ৫ হাজার টাকা শুল্ক বসবে। আর এক কোটি টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত বিদ্যমান স্তরটিও ভেঙে দেয়া হচ্ছে। নতুন অর্থবছরে এক কোটি থেকে দুই কোটি পর্যন্ত ১০ হাজার টাকা, দুই কোটি থেকে পাঁচ কোটি পর্যন্ত ২০ হাজার টাকা শুল্ক দিতে হবে। বর্তমানে এক কোটি থেকে পাঁচ কোটি পর্যন্ত আমানতে আবগারি শুল্ক ১৫ হাজার টাকা। ব্যাংক হিসাবে বছরে একবার যদি স্থিতি পাঁচ কোটি টাকা অতিক্রম করে, তাহলে সেই আমানতের ওপর আবগারি শুল্কের পরিমাণ হবে ৫০ হাজার টাকা। বর্তমানে এই স্তরে ৪০ হাজার টাকা দিতে হয়।
সাধারণত জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে কোনো ব্যাংক হিসাবে আমানতের পরিমাণ একবার এক লাখ টাকা বা তার ওপরের স্তরগুলোর সীমা স্পর্শ করলেই নির্দিষ্ট হারে আবগারি শুল্ক দিতে হয়। একাধিকবার স্পর্শ করলেও একবারই আবগারি শুল্ক কাটা হয় ওই গ্রাহকের হিসাব থেকে। আর কোনো হিসাবে এক লাখ টাকার কম থাকলে আবগারি শুল্ক কাটা হয় না। স্বাস্থ্য সেবা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪১ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৩৮ হাজার ৫১ কোটি টাকা। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় ২ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দের প্রস্তাব করছি। পাশাপাশি চিকিৎসা বিজ্ঞানের মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার গুরুত্ব বিবেচনায় ‘সমন্বিত স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিললে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি। তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য সেবা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণের অব্যাহত অগ্রগতি বজায় রাখার নিমিত্ত আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪১ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৩৮ হাজার ৫১ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর উত্থাপিত প্রস্তাবিত বাজেটের আকার সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’ প্রতিপাদ্যে এই বাজেট বিদায়ী ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। টাকার অংকে ৩৫ হাজার ২১৫ কোটি টাকা বেশি। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটের আকার সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা।
নতুন বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ধরা হয়েছে দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরে ছিল ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। নতুন বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে দুই লাখ ৮৩ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ লাখ ৪৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরে ছিল পাঁচ লাখ কোটি টাকা। নতুন বাজেটে জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। টাকার অংকে ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরে যা ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। পরে তা কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হয়। বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। মোট বরাদ্দের বৈদেশিক ঋণ বা অনুদান লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ কোটি টাকা। তবে এবারও উন্নয়ন বাজেটে পরিবহন ও বিদ্যুৎখাতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ দুই খাতে তুলনামূলকভাবে অর্থ বরাদ্দও থাকছে বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে এডিপিতে এক অর্থবছরের ব্যবধানে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়ছে ১৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সরকার নতুন উন্নয়ন বাজেটে পরিবহন ও বিদ্যুৎ খাত সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত এডিপির আকার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মূল এডিপি অপেক্ষা দুই হাজার কোটি টাকা বা দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি এবং সংশোধিত এডিপি অপেক্ষা ২০ হাজার কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ বেশি। এছাড়া ১০টি উন্নয়ন সহায়তা খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ৯ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা/করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পসমূহের অনুকূলে প্রস্তাবিত বরাদ্দ ১৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা/করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নসহ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত এডিপির মোট আকার দাঁড়ায় দুই লাখ ৭৮ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা।
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। নতুন অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ঋণ নেবে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের চেয়ে যা ৫ হাজার ১০৫ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী (২০২৪-২৫) অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার বেড়েছে ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মূল বাজেট ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের সংস্থান হবে দেশি-বিদেশি ঋণ থেকে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার বাড়লেও ঘাটতির পরিমাণ কমছে। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি কম ধরা হচ্ছে ৫ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। অনুদান ছাড়া বাজেট ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। তবে অনুদানসহ সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়াবে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা অনুদান পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে। আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা ঠিক করেছে সরকার। যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা কম। চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্য ঠিক করা আছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। এর আগের (২০২২-২৩) অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা।