আগ্রাসী রূপে ডেঙ্গু

আপলোড সময় : ২২-১০-২০২৫ ০৪:৪৭:৩৮ অপরাহ্ন , আপডেট সময় : ২২-১০-২০২৫ ০৪:৪৭:৩৮ অপরাহ্ন
* সংক্রমণ বেড়েছে ৮১ শতাংশ,আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ২৫৩ * জানুয়ারি থেকে ২১ অক্টোবর পর্যন্ত হাসপাতালে মোট ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে ৬১ হাজার ৬০৫ জন * হাসপাতালগুলোর নোংরা পরিবেশ,জমে থাকা পানি এবং ডাবের খোসা অপসারণ না করায় ডেঙ্গু রোগ ছড়াচ্ছে দিন যতই যাচ্ছে, ক্রমেই আগ্রাসী রূপ ধারণ করছে এডিশ মশা বাহিত রোগ ডেঙ্গু। চলতি বছরের প্রায় দশ মাসে এডিশ মশা কেড়ে নিয়েছে ২৫৩টি তাজা প্রাণ। গত বছরের তূলনায় সংক্রমণ বেড়েছে ৮১ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। তারমধ্যে কেবল সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মারা গেছে ৬৫ জন। এতে নগরবাসির মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। তবে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, হাসপাতালগুলোর নোংরা পরিবেশ, এডিশ মশার প্রধান আবাসস্থল জমে থাকা পানি এবং ডাবের খোসা অপসারণ না করায় চিকিৎসাকেন্দ্র থেকেই অধিক গতিতে রোগ ছড়াচ্ছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভাগুলোর দিকেই যাচ্ছে অভিযোগের আঙুল। ডেঙ্গুর এই ভয়াবহতায় সারাদেশে মারাত্মক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার একদিনে সর্বোচ্চ ৪ জনের মৃত্যু সংবাদও দেখেছেন দেশবাসী। যদিও বাসা-বাড়িতে মারা যাওয়া অনেকের হিসাবই যুক্ত হচ্ছে না সরকারি খাতায়। এরআগে একদিনে ১২ জনের মৃত্যু দেখেছে দেশবাসী। একই সময়ে রোগটি নিয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ৮১৪ জন। এ নিয়ে চলতি বছরে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৬১ হাজার ৬০৫ জন। গতকাল মঙ্গলবার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে ডেঙ্গুবিষয়ক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সারাদেশে চলতি বছরে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ২৫০ পার হলো। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া চারজনের মধ্যে তিনজনই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা। অন্যজন বরিশাল বিভাগের। আরও বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে নতুন আক্রান্তদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১২৬ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১১৪ জন, ঢাকা বিভাগে ১২৪ জন, ঢাকা উত্তর সিটিতে ১৭০ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ১০৭ জন, খুলনা বিভাগে ৪১ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৬ জন, রাজশাহী বিভাগে ৪০ জন, রংপুর বিভাগে ৪১ জন এবং সিলেট বিভাগে ৫ জন রোগী রয়েছেন। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৮১৯ জন ডেঙ্গু রোগী। এ নিয়ে চলতি বছরে মোট ছাড়পত্র পেয়েছেন ৫৮ হাজার ৫২১ জন। তবে তথ্য বলছে, প্রায় প্রতি মাসেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর নতুন রেকর্ড হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ এতটাই বেড়েছে যে ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তার ওপর প্রায়দিনই থেমে থেমে বৃষ্টি, হাসপাতালগুলোর ভেতর ও চারপাশের নোংরা পরিবেশ; রোগী এবং তাদের স্বজন এবং চিকিৎসক-নার্সদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে ডেঙ্গু। রাজধানীর বড় বড় হাসপাতালগুলো রোগীর চাপ সইতে না পেরে বাড়িয়ে দিয়েছে মৃত্যুঝুঁকি। স্বয়ং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর স্বীকার করেছে, হাসপাতালগুলো অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে না পারায় এবার মৃত্যুর হার তুলনামূলক বেশি হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, হাসপাতালগুলোর চারপাশে যদি জলাবদ্ধতা, নোংরা পরিবেশ এবং আবর্জনার স্তূপ জমে থাকে, তা হলে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঠেকানো কতটা সম্ভব,এমন প্রশ্নও নেহায়েত কম নয়। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত দেশে মোট ৬১ হাজার ৬০৫ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ সময় ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ২৫৩ জন। বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আতিকুর রহমান জানিয়েছেন, ডেঙ্গু এখন সারা বছরই হচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হলে এর প্রভাব বাড়ছে। তিনি বলেন, মশা নিরোধক ব্যবহার এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। তবে কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর চৌধুরী বলেছেন, মশানিধনে শুধুমাত্র জরিমানা বা সচেতনতা যথেষ্ট নয়। সঠিক জরিপ এবং দক্ষ জনবল দিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। জানা যায়, রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ আরও কয়েকটি হাসপাতালে বিশেষ ইউনিট রয়েছে। হাসপাতালগুলোর আশপাশে পড়ে আছে ডাবের খোসা আর ময়লার ভাগাড়। আর এসব হাসপাতালেই প্রতিনিয়ত চিকিৎসা নিতে আসেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের রোগীরা। এদের অনেকেই মশারি ব্যবহার করেন না। ফলে রোগীর আলাদা বা বিশেষ যত্ন না নিলে পূর্ণাঙ্গ মশা একজন সুস্থ মানুষকেও কামড়ায়। পরবর্তীতে ওই মানুষটাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এ জন্য হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের অধিক যত্নের সঙ্গে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়। বাইরের আক্রান্তরা এভাবে আসতে থাকলে ঢাকায় খুব দ্রুতই রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, হাসপাতালের সামনে জমে থাকা নোংরা পানি ও খোলা নালা থেকে ছড়িয়ে পড়া দুর্গন্ধের কারণে ওদিকে যাওয়াই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। নিয়মিত মশক নিধন বা ড্রেন পরিষ্কারের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ছে না। একটি হাসপাতালে গড়ে এক হাজারেরও বেশি রোগী ভর্তি থাকলেও পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অপ্রতুল। কর্মীরা সারাদিন ওয়ার্ডের ভেতরেই ব্যস্ত থাকেন, বাইরের ড্রেনেজ বা হাসপাতালের আঙিনা পরিষ্কার করার সময় পান না। অথচ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। অথচ হাসপাতালের বাইরের পরিবেশ অত্যন্ত নাজুক। মশা কমানোর কোনো কার্যকর ব্যবস্থা দেখা যায় না। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় তাদের ঝুঁকির মাত্রা খুব বেশি। জানা যায়, এডিস মশা নিধনে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ‘থেরাপি’ ব্যবহার করেছে। মশা শনাক্তে ব্যবহার করা হয়েছে ড্রোন। পানিতে ছাড়া হয়েছে ব্যাঙ, হাঁস, তেলাপিয়া ও গাপ্পি মাছ। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। যথাযথ তদারকির অভাবে মশক নিধন ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রমের গতি শ্লথ হয়ে পড়ায় পরিস্থিতি এখন রীতিমতো নাজুক। হাসপাতালে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এ বছরের ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এখনই ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে উৎস শনাক্ত করে এডিস মশার বিস্তার রোধ করতে হবে। প্রজননস্থল নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে আগামীতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলেও তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তবে হাসপাতালগুলোয় পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে উল্লেখ করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক বিভাগের পরিচালক ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সংখ্যা সীমিত, অথচ রোগীর চাপ দিন দিন বাড়ছে। একটি হাসপাতালে গড়ে এক হাজারেরও বেশি রোগী ভর্তি থাকলেও পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অপ্রতুল। কর্মীরা সারাদিন ওয়ার্ডের ভেতরেই ব্যস্ত থাকেন, বাইরের ড্রেনেজ বা হাসপাতালের আঙিনা পরিষ্কার করার সময় পান না। তিনি বলেন, প্রতি বছর বাজেটে চাদর, কম্বল ও মশারির জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা হয়। নিয়মিতভাবে হাসপাতালগুলোতে এসব সরঞ্জাম পৌঁছে দেওয়া হয়। প্রতিটি রোগীকে আলাদাভাবে মশারি সরবরাহ করার নীতি রয়েছে। তবে, বাস্তবে অনেক রোগী গরমের কারণে বা ভিড়ের মধ্যে অস্বস্তি বোধ করায় মশারি ব্যবহার করতে চান না। ফলে ওয়ার্ডে মশারির উপস্থিতি থাকলেও তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হয় না বলে জানান তিনি। উল্লেখ্য, দেশে এক বছরে সর্বোচ্চ রোগী ভর্তি হয়েছিল ২০২৩ সালে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। ২০২৪ সালে ভর্তি ১ লাখ ১ হাজার ২১১ জন, ২০২২ সালে ৬২ হাজার ৩৮২ জন, ২০২১ সালে ২৮ হাজার ৪২৯ জন, ২০২০ সালে ১৪০৫ জন এবং ২০১৯ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন।

সম্পাদকীয় :

সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি : সৈয়দ এম. আলতাফ হোসাইন।

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক : সৈয়দ মোঃ আতিকুল হাসান।

নির্বাহী সম্পাদক আশীষ কুমার সেন।

ফোন : ৪৯৩৫৭৭৩০ (বার্তা), ৮৩১৫৬৪৯ (বাণিজ্যিক), ফ্যাক্স; ৮৮-০২-৮৩১৪১৭৪

অফিস :

প্রকাশক কর্তৃক রোমাক্স লিমিটেড, তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে মুদ্রিত।

সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : খলিল ম্যানশন (৩য়, ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলা), ১৪৯/এ, ডিআইটি এক্সটেনশন এভিনিউ, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত।

ই-মেইল : [email protected], ওয়েবসাইট : www.dainikjanata.net