
* এখনো চলছে পরিবর্তন পরিমার্জনের কাজ
* পাঠ্যবইয়ের কনটেন্ট পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি
* ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনও মেলেনি এখনো
এখনো চলছে পরিবর্তন-পরিমার্জনের কাজ। পাঠ্যবইয়ের কনটেন্ট পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি। এছাড়া ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনও মেলেনি এখনো। সব মিলিয়ে বছরের প্রায় ১০ মাস পার হলেও মাধ্যমিক স্তরের বিনামূল্যের নতুন পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ এখনও শুরু হয়নি। এতে আগামী ১ জানুয়ারি মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই পৌঁছানো নিয়ে বড় ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে ।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপার কাজ এখনো শুরু না হওয়ার পেছনের দায় এনসিটিবির নয় মন্ত্রণালয়ের। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, এ বছর বই ছাপানোর কাজের প্রক্রিয়া আগেভাগেই শুরু করেছিল এনসিটিবি। নভেম্বরের মধ্যে সব বই মাঠ পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যও নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ সময়ে মাধ্যমিকের তিন শ্রেণির (ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম) পাঠ্যবইয়ের দরপত্র বাতিল হয়ে যাওয়া এবং নবম-দশম শ্রেণির কার্যাদেশ যথাসময়ে অনুমোদন না হওয়ায় সে পরিকল্পনা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। সেই সঙ্গে এখনো বিভিন্ন শ্রেণির অনেক বিষয়ের বইয়ের কনটেন্টও চূড়ান্ত হয়নি। সবমিলিয়ে এনসিটিবি এখনো অন্ধকারে রয়ে গেছে। আর এ কারণে এনসিটিবির শীর্ষ কর্তারাও মিডিয়ার মুখোমুখি হচ্ছেন না।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, আগের বছরের অভিজ্ঞতায় এবার জুলাই-আগস্টে বই ছাপার কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। সেখানে এখনো আমাদের সঙ্গে মাধ্যমিকের চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। ফলে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য কর্মকর্তা গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলছেন না। চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্বে) প্রফেসর রবিউল কবীর চৌধুরীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনসিটিবির এক কর্মকর্তা বলেন, যেহেতু বই ছাপা নিয়ে এখনো জটিলতা কাটেনি। তাই গণমাধ্যমের কাছে বক্তব্য দিতে অনানুষ্ঠানিকভাবে নিষেধ করা হয়েছে, তাই এনসিটিবির কেউ কথা বলছেন না।
এনসিটিবির শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, জানুয়ারিতে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া নিয়ে শঙ্কাও রয়েছে। কেননা, বছরের প্রায় ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো পাঠ্যবইয়ের ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন পাওয়া যায়নি। অনুমোদন পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তিনামা সইসহ নানা প্রক্রিয়া শেষ হয়ে ছাপার কাজ শুরু হতে আরো মাসখানেক সময় লাগবে। এতে জানুয়ারিতে সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই তুলে দেওয়া কতটা সম্ভব হবে, তা এখনই বলা দুরূহ।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ের সংখ্যা চার কোটি ৪৩ লাখ ২১ হাজার ৯০৬টি, সপ্তম শ্রেণির চার কোটি ১৫ লাখ ৮৪ হাজার ৬৯২ এবং অষ্টম শ্রেণির চার কোটি দুই লাখ ৩৪ হাজার ৬৯৮। এর মধ্যে ২৮০টি লটের মধ্যে ১১ কোটির বেশি বই ছাপানোর দরপত্র বাতিল হওয়ার পর তা দ্বিতীয় দফার প্রক্রিয়া শেষে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির একজন সদস্য বলেন, এই তিন শ্রেণির পাঠ্যবই মুদ্রণে পুনরায় দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে, দ্রুত অনুমোদন পাওয়া গেলে আশা করা যায় যথাসময়েই শিক্ষার্থীদের হাতে বই দিতে পারব।
এদিকে এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণির বই ছাপানোর কাজ শেষ, অনেক বই ইতোমধ্যে উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ফলে প্রাথমিকের বই যথাসময়েই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে পারবে সংস্থাটি। তবে বছরের শুরুতে সারা দেশে মাধ্যমিকের বই পৌঁছানো নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
তবে জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) সদস্য আমান সুলাইমান বলেন, বছরের প্রায় ১০ মাস পার হলেও মাধ্যমিক স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার কাজ শুরু না হওয়ার পেছনে এনসিটিবির চেয়ারম্যানই বড় সমস্যা। তিনিসহ আরো অনেকে যারা বড় পদে বসে আছেন তারা তো ফ্যাসিবাদের দোসর, ফলে এসব কাজ যথাসময়ে হোক সেটা তারা মনেপ্রাণে চান না। অজ্ঞাত কারণে তারা মূলত অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চান। এছাড়া পাঠ্যবই ছাপার প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে অনিয়ম-দুর্নীতির খবরও পাই, কিন্তু এসব বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেই।
এনসিসিসির এই সদস্যের এসব অভিযোগের কিছু প্রমাণও মিলেছে। সম্প্রতি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) পাঠ্যবই মুদ্রণে অনিয়ম ও সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে অভিযান পরিচালনা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রাথমিকভাবে এসব অনিয়মের সত্যতা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
গত ৭ অক্টোবর দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে একটি এনফোর্সমেন্ট টিম এনসিটিবি কার্যালয়ে এ অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানের সময় অভিযোগ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফর পরিদর্শন করা হয় এবং এনসিটিবি থেকে প্রাসঙ্গিক রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়। দুদকের উপপরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম অভিযান সম্পর্কে গণমাধ্যমকে বলেন, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যবই মুদ্রণে একাধিক অনিয়ম ঘটেছে। বিশেষ করে নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার, মুদ্রণ মানের ঘাটতি, বাঁধাই ত্রুটি এবং কিছু মুদ্রণ প্রেস মালিকের সঙ্গে অসাধু যোগসাজশের মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাতের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে।
দুদকের এই কর্মকর্তা আরো জানান, অভিযান শেষে দুদক টিম এনসিটিবি থেকে সংগৃহীত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনার জন্য নিয়ে যায়। এসব তথ্য বিশ্লেষণ শেষে কমিশনের কাছে বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
এনসিটিবির সংশ্লিষ্টরা জানান, চলতি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে তিন মাসেরও বেশি সময় লেগেছিল। ফলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ শিক্ষা বিভাগ ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। সঠিক সময়ে বই না পাওয়ায় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া ভুলে ভরা বইয়ে নানা তথ্য-উপাত্ত নিয়েও বছরজুড়ে ব্যাপক বিতর্ক দেখা দেয়।
এবারও নতুন বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া নিয়ে সন্দিহান এনসিটিবির কর্মকর্তারা। তাদের ভাষ্যমতে, লক্ষ্যপূরণে চলতি বছরের ৫ মে প্রথম দরপত্র আহ্বান করা হলেও তা বাতিল হয়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের দ্বিতীয় দফা দরপত্রের প্রক্রিয়া শেষে সব বই ছাপিয়ে বছরের শুরুতে সব শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছে দেওয়া অনেকটাই কঠিন হবে। যেহেতু এখনো মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পায়নি এনসিটিবি।
এনসিটিবির তথ্যানুযায়ী, ২০২৬ সালের নতুন শিক্ষাবর্ষের বিনামূল্যে বিতরণের জন্য প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই প্রায় আট কোটি ৪৯ লাখ ২৫ হাজার এবং মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ২১ কোটি ৪০ লাখ বইয়ের চাহিদা রয়েছে। আগের বছরের তুলনায় এবার মোট বইয়ের সংখ্যা কিছুটা কম। দরপত্রের প্রক্রিয়া শেষ করে মূল্যায়নের কাজও সম্পন্ন করেছিল এনসিটিবি। কিন্তু ১৯ আগস্ট ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এই তিন শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপানোর দরপত্র বাতিল করা হয়। এতেই সব প্রক্রিয়া থমকে যায়।
অবশ্য এর ব্যাখ্যায় সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, বই ছাপানোর ক্ষেত্রে অনিয়ম ঠেকাতে আরো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এর আগে যারা যারা পেয়েছিল, তাদের বইয়ের মান কেমন ছিল, কাগজ কেমন ছিল এবং কারা একাধিকবার পাচ্ছে, মনোপলি হচ্ছে কি না-আমরা এগুলো খতিয়ে দেখছি। সে কারণে তালিকা আরেকটু যাচাই-বাছাই কর হচ্ছে। তিনি বলেন, অনিয়মের সংবাদ আমরা মাঝে মধ্যে পাই, ঠিকমতো কাজ করে না। একজন একটি অর্ডার নিয়ে বাকিগুলোও নিয়ে নেয়, এসব অভিযোগ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।