দেশের বিভিন্ন নদ-নদীতে প্রতিদিন ভাসছে লাশ

আপলোড সময় : ২২-১০-২০২৫ ১১:৫৯:০৪ পূর্বাহ্ন , আপডেট সময় : ২২-১০-২০২৫ ১১:৫৯:০৪ পূর্বাহ্ন
* হত্যার প্রমাণ গায়েবের গোপন গহ্বর নদী * গত দেড় বছরে ৭৫০টি মরদেহ উদ্ধার * গড়ে প্রতি মাসে ৪৩টি মরদেহ উদ্ধার * ৩০ শতাংশেরই পরিচয় শনাক্ত সম্ভব হয় না * প্রমাণ নষ্টের জন্যই খুনিরা মরদেহ ফেলেন নদীতে * মরদেহ পচে গেলে মেলে না ফিঙ্গারপ্রিন্ট নদীমাতৃক দেশের স্রোতস্বিনী নদীগুলো এখন হয়ে উঠেছে হত্যার প্রমাণ গায়েবের গোপন গহ্বর। দেশের বিভিন্ন নদ-নদী থেকে প্রতিদিন গড়ে উদ্ধার হচ্ছে একটির বেশি লাশ। এর বড় একটি অংশেরই মিলছে না পরিচয়। পানিতে দেহ পচে যায়। মাছ-পোকায় খায়। নষ্ট হয় প্রমাণ। চলতি বছর নদীতে লাশের মিছিল বড় হয়েছে গত বছরের চেয়ে। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও থেকে আসছে মরদেহ উদ্ধারের খবর। গত ২৩ আগস্ট বুড়িগঙ্গা নদীর বুকে উদ্ধার করা হয় এক নারী ও এক শিশুর নিথর দেহ। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বলছে-তাদের জীবনের বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল শ্বাসরোধ করে, এরপর নদীতে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়, যেন তারা কোনো মূল্যহীন বস্তু! এ ঘটনায় সদরঘাট নৌ-থানায় দায়ের হয়েছে একটি হত্যা মামলা। কিন্তু সপ্তাহ কেটে গেলেও তারা কারা সে প্রশ্নের উত্তর অজানা। মরদেহ দুটি পড়ে থাকলেও এখন পর্যন্ত কেউ দাবিও করেনি, খোঁজও নেয়নি। আঙুলের ছাপ মুছে গেছে পানিতে, তাই পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। পুলিশ বলছে, মরদেহ দুটির ডিএনএ সংরণ করা হয়েছে। কেউ যদি কখনো এসে বলে এই তো, এ আমার মা, বা এ আমার সন্তান, তবে সেই ডিএনএ মেলানো হবে নিখুঁতভাবে। পাশাপাশি রাজধানীসহ বিভিন্ন থানায় করা নিখোঁজ ডায়েরির তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হচ্ছে নিহত নারী ও শিশুর পরিচয়। প্রতিদিন নতুন নতুন খবরের ভিড়ে হারিয়ে যায় এমন অনেক করুণ গল্প। নৌ-পুলিশ জানায়, নদী থেকে উদ্ধার মরদেহ শনাক্ত করতে প্রায়ই পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়। এটি একটি নিয়মিত চ্যালেঞ্জ। পুলিশ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত গ্রেফতার এড়াতে অপরাধীরা মরদেহ নদীতে ফেলে দেয়। চলতি বছর প্রতি মাসে নৌ-পুলিশ গড়ে ৪৩টি মরদেহ উদ্ধার করে। গত বছর প্রতি মাসে এ সংখ্যা ছিল ৩৬টি। নৌ-পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশজুড়ে অন্তত ৩০১ নারী-পুরুষ ও শিশুর মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জে সর্বোচ্চ সংখ্যক, ৩৪টি মরদেহ পাওয়া গেছে। এর পরের অবস্থানে রয়েছে ঢাকা ৩২টি। এর মধ্যে ২০৯ জনের পরিচয় জানা গেলেও ৯২ জন এখনো অজ্ঞাতপরিচয়। গত বছর নদী থেকে অন্তত ৪৪০টি মরদেহ উদ্ধার হয়েছিল, যার মধ্যে ১৪১ জনের পরিচয় এখনো শনাক্ত হয়নি। মরদেহ উদ্ধারের পর এ বছর বিভিন্ন থানায় অন্তত ৪১টি হত্যা মামলা হয়েছে। গত বছর ৫৩টি মামলা হয়েছিল। নৌ-পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে, মরদেহের অবস্থা ও পারিপার্শ্বিক প্রমাণসাপেক্ষে সন্দেহজনক মনে হলে তারা হত্যা মামলা করেন। তবে হত্যার প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। গত ২৮ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের শীতল্যায় একটি মস্তকহীন মরদেহ পাওয়া যায়। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সহায়তায় আঙুলের ছাপ মিলিয়ে দেখা যায়, নিহত ব্যক্তির নাম হাবিব (২৭)। তিনি সোনারগাঁ উপজেলার মধ্য কাঁচপুর এলাকার বাসিন্দা। কাঁচপুর নৌ-ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) আব্দুল মামুদ বলেন, এটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড। নিহত ব্যক্তির পরিচয় যেন শনাক্ত করা সম্ভব না হয়, সে উদ্দেশ্যে হত্যাকারীরা শিরচ্ছেদের পর মাথা অন্যত্র লুকিয়ে রাখে। লাশটি বেশি পচে না যাওয়ায় এবং দ্রুত ভেসে ওঠায় পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তারা আরও বলেন, পানিতে দেহ পচে যায়, প্রমাণ নষ্ট হয়ে যায়। কখনো কখনো মাছের কামড় বা জাহাজের আঘাতে সৃষ্ট তের কারণে তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ফরেনসিক চিকিৎসকরা বিভ্রান্ত হন। প্রাথমিক তদন্তে হত্যা মনে না হলে মরদেহ উদ্ধারের পর পুলিশ সাধারণত অস্বাভাবিক মৃত্যুর (ইউডি) মামলা করে। তদন্তে বা ময়নাতদন্তে হত্যার প্রমাণ পাওয়া গেলে পরে সেটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। অপরাধ বিশ্লেষক টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, অপরাধীরা প্রমাণ নষ্ট করতে ও আইনের চোখ ফাঁকি দিতে হত্যার পর মরদেহ ফেলার জন্য নদী ও রেলপথ বেছে নেয়। মূলত সংঘবদ্ধ অপরাধের ক্ষেত্রে এ রকম ঘটে। অপরাধীরা হত্যার আগেই নির্ধারণ করে নদী এলাকার কোথায় মরদেহ ফেলা হবে। তিনি বলেন, অনেক মরদেহ পাওয়া যায় যেগুলো অনেক বেশি পচে গেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তির ঠিকানা থেকে অনেক দূরের এলাকায় মরদেহ ফেলে দেয় অপরাধীরা। কখনো কখনো মরদেহ ভাসতে ভাসতে অনেক দূরে চলে যায়, পরে পরিবার খোঁজ না পায়। ফলে অজ্ঞাতপরিচয় থেকে যায়, তদন্তে অগ্রগতি হয় না এবং পরিবার ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়। নৌ-পুলিশ ঢাকা অঞ্চলের পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, নদী থেকে কোনো মরদেহ পেলে আশপাশে কেউ চেনে কি না তা খোঁজ করা হয়। শনাক্ত না হলে পার্শ্ববর্তী থানাগুলোতে খোঁজ নেওয়া হয় নিখোঁজের কোনো জিডি রয়েছে কি না। তবুও শনাক্ত না হলে তৃতীয় ধাপে পিবিআই অথবা সিআইডিতে খবর দেওয়া হয়। তিনি বলেন, পিবিআই অথবা সিআইডির টিম এসে ফিঙ্গারপ্রিন্ট (আঙুলের ছাপ) নেয়। মরদেহের হাত-পায়ে যদি পচন না ধরে সেক্ষেত্রে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়া যায়। পচন ধরলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়া যায় না। ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়া গেলে এনআইডি সার্ভারের সঙ্গে ম্যাচ করে দেখা হয় মরদেহের নামে এনআইডি সার্ভারে ম্যাচ করে কি না। এছাড়া নিহতের পরনের পোশাকের পকেটে মানিব্যাগ, মোবাইল অথবা কোনো আইডি কার্ড রয়েছে কি না তা খোঁজ করা হয়। পুলিশ সুপার বলেন, এরপরেও যদি পরিচয় শনাক্ত করা না যায় সেক্ষেত্রে হাসপাতালের মর্গে ফ্রিজিং করে রাখা হয়। মর্গে রাখাও সময়সাপেক্ষ। যখন কোনোভাবেই মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করা যায় না তখন বেওয়ারিশ লাশ দাফন সংস্থা আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর মধ্যে মৃত ব্যক্তির ধর্ম শনাক্ত করা গেলে সেই ধর্মীয় রীতিতে দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়। আবদুল্লাহ আল মামুন আরও বলেন, মরদেহ দাফনের জন্য আঞ্জুমান মফিদুলের কাছে হস্তান্তরের আগে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে রাখা হয়। কারণ যদি কোনো স্বজন দাবি করেন তখন আদালতের অনুমতি নিয়ে ডিএনএ নমুনা ম্যাচ করা হয়। নারায়ণগঞ্জ নৌ-পুলিশের পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন বলেন, চারদিন ধরে পানিতে কোনো মরদেহ থাকলে পচে যায়। তখন আর ফিঙ্গারপ্রিন্ট আসে না। শীতকালে মরদেহ পচতে সময় লাগে। আবার গরমের সময় দু-তিনদিনেই পচে যেতে পারে। ডাটাবেজে যাদের এনআইডি রয়েছে তাদের সহজেই শনাক্ত করা যায়। কিন্তু যেগুলো ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়া সম্ভব হয় না সেগুলো অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে দাফন করতে হয়। নৌ-পুলিশ প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি কুসুম দেওয়ান বলেন, নদী থেকে মরদেহ উদ্ধার হলে পরিচয় শনাক্ত করাই তদন্ত এগিয়ে নেওয়া ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক ক্ষেত্রে মরদেহ পচে যাওয়ায় শনাক্ত করা যায় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে মরদেহ এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ভেসে যায় কিংবা প্রমাণ নষ্ট করতে অপরাধীরা অন্য কোথাও হত্যার পর মরদেহ নদীতে ফেলে দেয়। প্রতিটি মামলায় পরিচয় শনাক্ত করতে নৌ-পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করে।

সম্পাদকীয় :

সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি : সৈয়দ এম. আলতাফ হোসাইন।

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক : সৈয়দ মোঃ আতিকুল হাসান।

নির্বাহী সম্পাদক আশীষ কুমার সেন।

ফোন : ৪৯৩৫৭৭৩০ (বার্তা), ৮৩১৫৬৪৯ (বাণিজ্যিক), ফ্যাক্স; ৮৮-০২-৮৩১৪১৭৪

অফিস :

প্রকাশক কর্তৃক রোমাক্স লিমিটেড, তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে মুদ্রিত।

সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : খলিল ম্যানশন (৩য়, ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলা), ১৪৯/এ, ডিআইটি এক্সটেনশন এভিনিউ, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত।

ই-মেইল : [email protected], ওয়েবসাইট : www.dainikjanata.net