* আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারি * পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ * গ্রেফতার আতঙ্কে অনেকে বাড়িছাড়া * গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতেও অনেকের মধ্যে অস্বস্তি

আতঙ্কে গুঁইমারার পাহাড়িরা

আপলোড সময় : ১১-১০-২০২৫ ১২:৩৯:২৯ অপরাহ্ন , আপডেট সময় : ১১-১০-২০২৫ ১২:৩৯:২৯ অপরাহ্ন
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি
থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে খাগড়াছড়ির গুইমারায়। চলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারি। পাহাড়ি জনগোষ্টীর মধ্যে ক্ষোভ, গ্রেফতার আতঙ্কে অনেকে বাড়িছাড়া। এক মারমা কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ-অবরোধ এবং সহিংসতায় তিন জনের মৃত্যুর ঘটনার দুই সপ্তাহ পর সরেজমিন গুইমারা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
সরেজমিনে খাগড়াছড়ি ও গুইমারা উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, পাহাড়িদের অবরোধ এবং প্রশাসনের ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করার পর জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। যদিও গুইমারা রামসু বাজারে হামলা অগ্নিসংযোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মারমা সম্প্রদায় এবং স্থানীয় পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ আছে। গুইমারায় উপজেলায় দেখা যায়, সহিংসতার ১০ দিন পরেও সেখানে কড়া পাহারায় যৌথ বাহিনী। অবরোধ এবং ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হলেও স্থানীয়দের মধ্যে ভয় আতঙ্ক কাজ করছে। গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতেও অনেকের মধ্যে অস্বস্তি দেখা যায়।
গত ২৩ শে সেপ্টেম্বর পাহাড়ি স্কুলছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়ি সদর ও গুইমারা উপজেলায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যা কয়েকদিন ধরে চলে।
খাগড়াছড়িতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও গুইমারা এলাকায় অবরোধকারীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনী ও স্থানীয় বাঙালিদের মুখোমুখি অবস্থার সৃষ্টি হয়। ২৭শে সেপ্টেম্বর দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় এবং ২৮ শে সেপ্টেম্বর গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন তিনজন মারমা যুবক। এছাড়া গুলিতে ও হামলায় আহত হন অনেকেই।
২৮ শে সেপ্টেম্বর গুলিতে নিহত থোইচিং মারমার বাবা হোলাচাই মারমার বক্তব্যেও আতঙ্কের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। গুলিতে ছেলের মৃত্যুর বিচার নিয়ে তিনি বলেন, কোনো মামলা তিনি করবেন না।
তার ভাষায়, মামলা করলে আরো হয়রানির শিকার হতে হবে। তিনি চান পাহাড়ে আর যেন কোনো পিতা সন্তান হারা না হয়।
ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে মেডিকেল রিপোর্ট প্রকাশের পর ভুক্তভোগীর পরিবার এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ হতাশা, গুলিবর্ষণ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান, ষড়যন্ত্রের অভিযোগ, পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত মিলিয়ে খাগড়াছড়ির সাম্প্রতিক ঘটনা জটিল সমীকরণ তৈরি হয়েছে।
২৩শে সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সদরে পাহাড়ি একজন স্কুলছাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ সামনে আসে। শিশুটির পরিবারের পক্ষ থেকে বাঙালি তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে সদর থানায় মামলা করে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই জেলায় ‘জুম্ম ছাত্র জনতা’র ব্যানারে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়। পরে ঘটনাপ্রবাহ সংঘাতে মোড় নেয়।
এরই মধ্যে ওই স্কুলছাত্রীর শারীরিক পরীক্ষায় ‘ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি’ উল্লেখ করে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয় সিভিল সার্জন কার্যালয়ে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিজেই ‘ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি’ বলে ব্রিফিংয়ে উল্লেখ করেন। এই মেডিকেল রিপোর্ট প্রকাশের বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এবং পরিবারের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। ওই স্কুল ছাত্রীর বাড়িতে গেলে তার বাবা বলেন, “বিরক্ত লাগে, কাজেও যাইতে পারি নাই।” তিনি জানান, মেয়ের কোচিং ও স্কুলে যাওয়া আপাতত বন্ধ। ওই দিনের কথা কেউ বললে সে কান্নাকাটি করে।
 
মেডিকেল রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত না পাওয়ার যে খবর জানা যাচ্ছে, সে প্রসঙ্গে মেয়েটির বাবা বলেন, “রিপোর্টটা এখন নেগেটিভ যখন পাইছে আমাদের আর করার কিছু নাই। বিচার তো সবই প্রশাসনের উপরে। আমরা তো বিচার চাইছিলাম, না দিলে আমার করার কিছু নাই।” মেয়েকে উদ্ধারের পর গোসল করিয়ে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল উল্লেখ করে ভুক্তভোগীর পিতা বলেন, “এটা ভুল হইছে আরকি। আমরা জানি না তো এইগুলো।”
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও নারী উন্নয়নকর্মী শেফালিকা ত্রিপুরা পাহাড়ে ধর্ষণের অভিযোগের তদন্ত, বিচার এবং নারীর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, “কখনো আমরা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে ন্যায়বিচার পাচ্ছি না। ইভটিজিংয়ের কমিটি বা কোর্টে আমরা ন্যায়বিচার পাচ্ছি না। সবসময় পজিটিভ (ডাক্তারি পরীক্ষা) খুব কম পাওয়া যাচ্ছে। এইটাও সন্ধ্যায় হয়েছে। সকালে মেয়েটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কোর্টেও হাজির করা হয়েছে। তারপরও নেগেটিভ।” এবারের ভিকটিমের ডাক্তারি পরীক্ষার আলামত নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করেছিলেন বলেও জানান শেফালিকা ত্রিপুরা।
“তারা যখন বলছে গোসল করানো হইছে, আমি বললাম যে আপনারা তো গোসল করাইয়া ভুল করছেন। গোসল না করাইয়া থাকতেন, তাহলে এটা আলামতের বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারতো।”
“আমি বলছিলাম যে যেহেতু গোছল করিয়েছেন কাপড়-চোপড় কোথায় এখন। বলে যে থানায়, তাও ভিজা। আমি বললাম যে আমাদের মধ্যে যদি একটু সন্দিহান থাকে তাহলে আপনারা আবেদন করতে পারেন বাদীর পক্ষ থেকে ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে নিয়ে যাবার জন্য চিটাগং মেডিকেলে। ওইখানে ১৬ দিন পরেও তাদের টেস্টে আলামত পাওয়া যায়।”
“আরএমওকে (সরকারি হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক) বললাম যে আপনারা ওকে করে দিলে তারা নিয়ে যেতে পারে। তারা নিয়ে যায় নাই,” বলেন শেফালিকা ত্রিপুরা।
খাগড়াছড়ি জেলার পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল বলেন, গত এক বছরে খাগড়ছড়িতে ৩৫টি ধর্ষণের অভিযোগ এসেছে। ২৮টি বাঙালিদের মধ্যে। আর চারটি পাহাড়িদের বিরুদ্ধে পাহাড়িদের এবং চারটি বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাহাড়িদের অভিযোগ।
সবশেষ ঘটনার তদন্তের বিষয়ে পুলিশ সুপার বলেন, “মেডিকেল রিপোর্টের বাইরে আমরা ডিএনএ স্যাম্পল নেওয়া আছে। সেটা আমরা ঢাকা সিআইডিতে অলরেডি প্রেরণ করেছি। এর বাইরে যেটা হতে পারে যে অভিযুক্ত তারও আমরা ডিএনএ স্যাম্পল কালেকশন করে বিজ্ঞ আদালতের অনুমতি নিয়ে পরীক্ষা করবো।”
তিনজনের মধ্যে অজ্ঞাত বাকি দুজন অভিযুক্তকে আটকের ব্যাপারে কোনো তথ্য প্রমাণ নেই, তবে চেষ্টা অব্যাহত আছে বলে দাবি করেন খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল।
ধর্ষণের অভিযোগে একজনকে আটকের পর অন্যান্য অভিযুক্তদের আটক এবং শাস্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে ২৭শে সেপ্টেম্বরের খাগড়াছড়ি শহরে এক পর্যায়ে পাহাড়ি-বাঙালি মুখোমুখী অবস্থার সৃষ্টি হয়।
ওইদিন স্বনির্ভর বাজারে বাঙালি বেশকটি দোকানে ভাঙচুর হয়। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় ২৮শে সেপ্টেম্বর গুইমারা উপজেলায়। সেখানে ১৪৪ ধারা ভেঙে পাহাড়িদের প্রতিবাদ বিক্ষোভ প্রাণঘাতী সংঘাতে রূপ নেয়। সেনাবাহিনী ও পাহাড়িদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
একপর্যায়ে গুইমারায় মারমা অধ্যুষিত রামসু বাজারে হামলা-অগ্নিসংযোগে পুড়ে ছাই হয়ে যায় অর্ধশতাধিক দোকানপাট ও ৩০টির মতো বসতঘর। হলুদ গুদামসহ, সরকারি অফিসেও হামলার শিকার হয়। সেদিন গুইমারায় গুলিতে তিনজন মারমা যুবক নিহত হন এবং গুলিবিদ্ধসহ আহত হয় প্রায় ২০ জন। একই দিনে সেনাবাহিনী ও পুলিশের ১৫জনের মতো সদস্য আহত হন। খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন এবং পাহাড়ি বাঙালি সম্প্রীতি বজায় রাখার বিষয়ে তারা তৎপর রয়েছেন।
 

সম্পাদকীয় :

সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি : সৈয়দ এম. আলতাফ হোসাইন।

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক : সৈয়দ মোঃ আতিকুল হাসান।

নির্বাহী সম্পাদক আশীষ কুমার সেন।

ফোন : ৪৯৩৫৭৭৩০ (বার্তা), ৮৩১৫৬৪৯ (বাণিজ্যিক), ফ্যাক্স; ৮৮-০২-৮৩১৪১৭৪

অফিস :

প্রকাশক কর্তৃক রোমাক্স লিমিটেড, তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে মুদ্রিত।

সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : খলিল ম্যানশন (৩য়, ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলা), ১৪৯/এ, ডিআইটি এক্সটেনশন এভিনিউ, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত।

ই-মেইল : [email protected], ওয়েবসাইট : www.dainikjanata.net