
বিদ্যমান স্বৈরাচারী ব্যবস্থা শেখ হাসিনাকে দানব বানিয়েছিল এবং ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি ঠেকাতে সংসদে উচ্চকক্ষ দরকার বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষ জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারবে?’ শীর্ষক সিডিপি জাতীয় সংলাপে বদিউল আলম এ মন্তব্য করেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) যৌথভাবে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এ সদস্য বলেন, শেখ হাসিনা কিন্তু ট্যাংকে করে ক্ষমতায় আসেননি। তিনি কিন্তু উর্দি পরে ক্ষমতায় আসেননি এবং এসে সংবিধানও বাতিল করে দেননি। শেখ হাসিনা নির্বাচনের মাধ্যমে এসেছেন, যদিও ওই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু শেখ হাসিনা কীভাবে স্বৈরাচারে পরিণত হলেন, কীভাবে দানবে পরিণত হলেন? এ স্বৈরাচারী ব্যবস্থাই তাকে দানবে পরিণত করেছে। বদিউল আলম মজুমদার জানান, সংসদের উচ্চকক্ষের মাধ্যমে জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্য হলো এ স্বৈরাচারী ব্যবস্থা বা দানবীয় ব্যবস্থার অবসান ঘটানো। অবসান না ঘটালেও কিছু চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স করা, ক্ষমতার ভারসাম্য করা। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এ ক্ষমতার ভারসাম্য। এর মাধ্যমে দায়বদ্ধতা সৃষ্টি এবং দানব সৃষ্টি হওয়া বন্ধ করা যাবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক রওনক জাহানের সভাপতিত্বে সংলাপে ইইউ রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় সদস্যসচিব আখতার হোসেন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স প্রমুখ বক্তব্য দেন। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিপীড়নের কারণে শেখ হাসিনা দানবে পরিণত হয়েছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভিশাপ আমরা দেখেছিলাম ২০০১ এবং ২০০৮ সালে। ২০০১ সালে বিএনপি ৪০ দশমিক ৯৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪০ দশমিক ১৩ শতাংশ। তখন বিএনপি ১৯৩টি ও আওয়ামী লীগ ৬২টি আসন পায়। অন্যদিকে ২০০৮ সালে নৌকায় ভোট পড়ে ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশ ও আসন পায় ২৩০টি। বিএনপি পায় ৩২ দশমিক ৫০ শতাংশ ভোট, কিন্তু আসন পায় মাত্র ৩০টি। এই যে অসামাঞ্জস্যতা, এটি বড় দুর্বলতা। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এই দানব হওয়ার প্রতিষেধক হিসেবে বা এটি ঠেকানোর জন্য উচ্চকক্ষ প্রয়োজন উল্লেখ করে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, উচ্চকক্ষের মাধ্যমে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স সৃষ্টি হতে পারে। যে কোনো আইন পাস হতে হলে তা উচ্চকক্ষে যাবে এবং এ নিয়ে উচ্চকক্ষের একটি বক্তব্য থাকবে; ফলে আমাদের দেশের অনেকগুলো নিবর্তনমূলক আইন হয়তো আরও মডারেটেড (সহনশীল) হতো। অনেক সময় নিম্নকক্ষে আবেগ এবং প্রতিহিংসাপরায়ণতার কারণে আইন প্রণীত হয়। কিন্তু উচ্চকক্ষে গেলে তা মডারেটেড হতে পারে এবং উচ্চকক্ষ এটাকে ঠেকাতে পারে। নিম্নকক্ষের কাছে মূল ক্ষমতা আইন প্রণয়নে রয়েছে এবং উচ্চকক্ষের কোনো ক্ষমতা নেই আইন প্রণয়ন ও আইন প্রস্তাব করার। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, শেখ হাসিনা দানবে পরিণত হয়েছেন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এনে এবং এর মাধ্যমে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছেন। ফলে যে সরকার যখন ক্ষমতায় থাকবে, সেই সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে এবং তার পরিণতি কী হয়েছে সেটা আমরা দেখেছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর সবগুলো নির্বাচনই জালিয়াতির, না হয় একতরফা বা বিতর্কিত নির্বাচন হয়েছে। উচ্চকক্ষ যদি থাকতো, তাহলে শেখ হাসিনার পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা প্রায় অসম্ভব হতো। যদিও তা নির্ভর করে উচ্চকক্ষ কীভাবে গঠিত হয় তার ওপর। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান জানান, কতগুলো দল প্রস্তাব করেছে উচ্চকক্ষ হবে নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে। তাহলে উচ্চকক্ষ হবে নিম্নকক্ষের একটি ডুপ্লিকেট, যা অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু যদি ভোটের অনুপাতে হয়, তাহলে উচ্চকক্ষ বাধা দিতে পারবে। এটি হলে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি হবে। যার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করতে হবে এবং সংবিধান সংশোধনের খাতিরে এটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পিআর পদ্ধতি হলে এটি একটি চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স তৈরি করবে। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আজ বলা হচ্ছে- আমরা নির্বাচন চাই। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। দুর্ভাগ্যবশত, জনগণের প্রতিনিধিরা যদি দুর্বৃত্ত হন, তাহলে তো সেই একই পুরোনো জিনিসের পুনরাবৃত্তি হবে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলাতে হবে। এসব নিয়ম-কানুন বদলানো দরকার, যাতে কাঠামো ঠিক হয়। রাজনৈতিক সংস্কৃতি না বদলালে কোনো কিছু কাজ করবে না।