
বর্ষা ও বন্যায় বিষধর সাপের আনাগোনা বাড়ে এবং মানুষের বাসস্থানে তাদের আনাগোনা বৃদ্ধির ফলে সাপের কামড়ের ঘটনাও বাড়ে। তবে বাংলাদেশে পাঁচ কারণে সাপের কামড়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে-অ্যান্টিভেনমের অভাব, চিকিৎসার অপ্রতুলতা, কুসংস্কার, প্রাকৃতিক কারণ, আবাসস্থল ধ্বংস। বিশেষ করে প্রান্তিক ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে বিষাক্ত সাপের অ্যান্টিভেনম (প্রতিষেধক) এর সংকট এবং সাপ সম্পর্কে সঠিক চিকিৎসার বিকল্প হিসেবে কুসংস্কারের উপস্থিতি বন্ধ করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে হাসপাতালে সাপের ছোবল খেয়ে চিকিৎসা নিতে আসা ২৪ হাজার ৪৩২ জনের মধ্যে ১১৮ জন মারা গেছেন। পরিসংখ্যান আরও বলছে, সাপের ছোবলের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে বরিশালে, তবে মৃত্যুর হার বেশি পদ্মাপাড়ের বৃহত্তর ফরিদপুর ও রাজশাহীতে, যেখানে বিষধর সাপ বেশি দেখা যায়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে, গত বছর সাপের কামড়ে মারা যাওয়া রোগীদের অধিকাংশকেই প্রথমে ওঝা বা বৈদ্যর কাছে নেওয়া হয়েছিল। দ্রুত সময়ের মধ্যে আধুনিক চিকিৎসা নিলে এদের মধ্যে ৯০ শতাংশ রোগীকেই বাঁচানো যেত। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ২০২১ সালের পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর ৪ লাখেরও বেশি মানুষ সাপের ছোবলের শিকার হন, যার মধ্যে প্রায় ৯৬ হাজার ৫০০টি বিষধর সাপের ছোবল। এই বিষধর সাপের ছোবলে বছরে সাড়ে ৭ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনো ছয় প্রজাতির বিষধর সাপের বসবাস আমাদের চারপাশে। সেসব বিষধর সাপের কামড়ের শিকার হন দেশের প্রায় সাড়ে ৯৬ হাজার মানুষ। যার মধ্যে মৃত্যু হয় বছরে সাড়ে ৭ হাজারের বেশি মানুষের। আর এক দিনে সাপের কামড়ে মারা যায় গড়ে ২০ জন। বিশ্বে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ প্রজাতির সাপ রয়েছে। আর বাংলাদেশে আছে ৯০ প্রজাতির সাপ। এসবের মধ্যে ৫ শতাংশ বিষধর। এগুলোর মধ্যে অন্যতম রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া, কিং কোবরা বা শঙ্খচূড়, নায়া নায়া (কোবরা বা গোখরা প্রজাতির সাপ), কেউটে, ক্রেইট বা শঙ্খিনী ও নায়া কাউচিয়া। এর মধ্যে রাসেলস ভাইপার সবচেয়ে বিষাক্ত। এ সাপটি ১০০ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। গত ১০-১২ বছর আগে থেকে আবার এ সাপের দেখা মিলছে। বর্তমানে ২৭টি জেলায় এর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব, দেরিতে হাসপাতালে যাওয়া, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সরকারি হাসপাতালগুলোতে অ্যান্টিভেনম না থাকা এবং অ্যান্টিভেনম থাকলেও তা ব্যবহারে চিকিৎসকদের অনীহা, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের অভাব-এসব কারণে সাপে কাটা রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, বিষধর সাপের ছোবলের লক্ষণ হলো-দংশিত স্থান ফুলে যাওয়া, রক্তপাত, রোগী তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া, প্রস্রাব কমে যাওয়া বা কালো হওয়া। তারা বলেন, সাপে কাটা ব্যক্তিকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে এবং কোনো রকম ঝাড়ফুঁক বা কুসংস্কারের পেছনে সময় নষ্ট করা যাবে না।
জানা গেছে, দেশে নিজস্বভাবে উৎপাদিত কোনো অ্যান্টিভেনম নেই এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও এর তীব্র সংকট রয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে সাপে কাটা রোগীদের জন্য কার্যকর চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, যা মৃত্যুর হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। সাপের কামড় নিয়ে নানা ধরনের কুসংস্কার প্রচলিত আছে, যার ফলে সঠিক চিকিৎসা পেতে দেরি হয় বা চিকিৎসা গ্রহণ থেকে মানুষ বিরত থাকে। বর্ষা ও বন্যার কারণে সাপের আনাগোনা বাড়ে, ফলে লোকালয়ে বিষধর সাপ ঢুকে পড়ার ঘটনা বৃদ্ধি পায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বনাঞ্চল ও কৃষিজমি কমে আসছে, যা সাপের আশ্রয়স্থল ধ্বংস করছে এবং মানুষ ও সাপের মধ্যে সংঘাত বাড়াচ্ছে। তবে দেশে সাপের কামড়ে মৃত্যুর সংখ্যা কমাতে সম্ভাব্য সমাধান হচ্ছে-অ্যান্টিভেনম উৎপাদন, স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়ন এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। সংশ্লিষ্ট্ররা বলছেন, দেশীয় বিষধর সাপের জন্য উপযোগী অ্যান্টিভেনম দেশেই উৎপাদন করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রান্তিক পর্যায়ে, বিশেষ করে ইউনিয়ন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে সাপের কামড়ের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অ্যান্টিভেনম ও সরঞ্জাম নিশ্চিত করতে হবে। সাপের কামড় থেকে বাঁচতে প্রয়োজনীয় করণীয় এবং কুসংস্কার পরিহার করে সঠিক চিকিৎসার গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। সর্বশেষ ২৮ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে সাপের কামড়ে খলিল মৃধা (৫৫) নামের একজনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি বোয়ালমারী উপজেলার সাতৈর ইউনিয়নের মোহনপুর গ্রামের ইনতাজ মৃধার ছেলে। ২৮ সেপ্টেম্বর বাড়ির পার্শ্ববর্তী একটি মাঠ থেকে ছাগল আনতে গেলে এ ঘটনা ঘটে। তবে হাসপাতাল ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, খলিল মৃধাকে রোববার বেলা এগারোটার দিকে বাড়ির পাশের একটি মাঠ থেকে বিষধর সাপে কামড় দেয়। ঘন্টাখানেক পরে স্বজনরা বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা রোগীর লক্ষণ ও কিছু পরীক্ষার পর নিশ্চিত হন সাপটি বিষধর। এরপর বেলা ১টার দিকে তাকে সাপের বিষের প্রতিষেধক (এন্টিভেনম) দেয়া হয়। কিন্তু মিনিট খানেকের মধ্যেই রোগীর মৃত্যু ঘটে। এরআগে ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় সাপে কাটা ৬ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন প্রমাণস্বরূপ বিষধর সাপও নিয়ে হাসপাতালে চলে আসেন। ঘটনাটি জানাজানি হতেই পুরো এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ২৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে উঠানে কাজ করার সময় জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার চারোল ইউনিয়নের মইনুল ইসলামের পায়ে কামড় দেয় সাপটি। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর চিকিৎসকেরা তাকে তাৎক্ষণিকভাবে অ্যান্টিভেনম দেন। একদিনের চিকিৎসা শেষে বর্তমানে তিনি সুস্থ আছেন। মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা মইনুল ইসলাম বলেন, দুপুরে উঠানে কাজ করছিলাম। এসময় হঠাৎ একটি সাপ এসে পায়ে কামড় দেয়। বিষের ভয়াবহতা বুঝতে পেরে পরিবারের সদস্যরা দ্রুত আমাকে ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। যেন ডাক্তাররা সহজে বুঝতে পারেন, কোন সাপ কামড়েছে। ২৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক ডা. ফুয়াদ বলেন, কেবল মইনুল ইসলাম নন, গত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একই হাসপাতালে আরও পাঁচজন সাপে কাটার রোগী ভর্তি হয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই ঠাকুরগাঁও সদর,বালিয়াডাঙ্গী ও রানীশংকৈল উপজেলার বাসিন্দা। বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকে জেলাজুড়ে সাপের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। ২৬ সেপ্টেম্বর মাদারীপুরে বিষাক্ত সাপের কামড়ে লিমি আক্তার (১৩) নামে এক মাদ্রাসাছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার রাত ৯টার দিকে মাদারীপুর ২৫০ শয্যা জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে তার মৃত্যু হয়। লিমি ডাসার উপজেলার পূর্ব বালিগ্রামের আনোয়ার হোসেনের মেয়ে এবং স্থানীয় একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিলো। এরআগে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার জুনিয়াদহ গ্রামের নিজ ঘরে সাপের কামড়ে শিকার হয় ৮ বছরের শিশু আব্দুল্লাহ। এই ঘটনার পরপরই ওঝা ডেকে বিষ ঝাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কয়েক ঘন্টায়ও কোন সুফল না পাওয়ায় রাত ১টার দিকে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে নিয়ে যান শিশুটির স্বজনরা। জেলা সদর হাসপাতালে সাপে কাটা রোগির ওষুধ (এন্টিভেনম) নেই। এমনকি স্থানীয় ফার্মেসিগুলোতে অনেক খোঁজাখুজির পরেও এন্টিভেম পাওয়া যায়নি। অবশেষে সবার সামনেই রাত সাড়ে ৩টার দিকে ওষুধের অভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু ঘটে শিশু আব্দুল্লাহর। কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে এন্টিভেনমের এ সংকট দীর্ঘদিনের। বিগত তিন মাসে এই হাসপাতালে সাপে কাটা অন্তত ৫-৬ জন রোগীর মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। গত ৫ সেপ্টেম্বর রাত ৯টার দিকে টাঙ্গাইল জেলার সখীপুরের রাকিবকে (৩০) সাপে কাটে। ঘটনার পরপরই সখীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। কিন্তু সেখানে ভ্যাকসিন পাওয়া যায়নি। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রেহেনা পারভীন রুমি জানান, বর্তমানে অ্যান্টিভেনম মজুত নেই। আগে ডিজি হেলথ থেকে যে ভ্যাকসিন বরাদ্দ দেয়া হতো, তা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। পরবর্তীতে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে মেলে এন্টিভেনম। সারা রাত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পর অবশেষ সুস্থ হয়ে ওঠেন রাকিব। শুধু ফরিদপুরের বোয়ালমারী কিংবা কুষ্টিয়া নয়, সাপে কাটা রোগির ওষুধ না পাওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। গত এক মাসে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে সাপে কাটার চিকিৎসা নিতে আসা কয়েক জন রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা জানা গেছে তাদের অনেকেই সাপের কামড়ের চিকিৎসায় কার্যকরী অ্যান্টিভেনম উপজেলায় না পেয়ে জেলা সদরে এবং সেখানে না পেয়ে ঢামেকে এসেছেন। তারা বলছেন, কাছাকাছি অ্যান্টিভেনম না থাকায় বাধ্য হয়ে রোগীর স্বজনদের ছুটতে হয় ঢাকা কিংবা বিভাগীয় শহরে। সেখানে পৌঁছাতে এতটা দেরি হয়ে যায় যে, শেষ পর্যন্ত সাপের কামড়ে আহত অনেককে বাঁচানো যায় না।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ জানান, সাপের ছোবলের ঘটনা বেশি ঘটে বর্ষাকালে, অর্থাৎ জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে। আর সাপের প্রজনন মৌসুম ‘অক্টোবর’ মাসে। দেশে এই দুই সময়ে সাপের ছোবলের ঘটনা বেড়ে যায়। তিনি বলেন, আমাদের দেশে ব্যবহৃত অ্যান্টিভেনমগুলো শত বছরের পুরোনো প্রযুক্তিতে তৈরি এবং দক্ষিণ ভারতের চার ধরনের সাপ থেকে সংগৃহীত বিষে তৈরি হওয়ায় সব ধরনের সাপের বিষের বিরুদ্ধে এটি কার্যকর নয়। অ্যান্টিভেনম প্রয়োগের পরও ২০ থেকে ২২ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (এনসিডিসি) লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. সৈয়দ জাকির হোসেন বলেন, দেশে অ্যান্টিভেনমের কোনো সংকট নেই। বছরে ৭০ হাজার ডোজ অ্যান্টিভেনমের প্রয়োজন হলেও, বাস্তবে ২৫ হাজারের বেশি ব্যবহৃত হয় না, কারণ মানুষ চিকিৎসকের কাছে আসে না। তিনি জানান, সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার ১০ হাজার ভায়াল অ্যান্টিভেনম কিনেছে, আর ১০ হাজার ভায়াল দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সর্বশেষ গত দুই মাসে আড়াই হাজার ভায়াল সরবরাহ করা হয়েছে সরকারি হাসপাতালে। বর্তমানে মজুত রয়েছে ৬৫০ ভায়াল।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে হাসপাতালে সাপের ছোবল খেয়ে চিকিৎসা নিতে আসা ২৪ হাজার ৪৩২ জনের মধ্যে ১১৮ জন মারা গেছেন। পরিসংখ্যান আরও বলছে, সাপের ছোবলের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে বরিশালে, তবে মৃত্যুর হার বেশি পদ্মাপাড়ের বৃহত্তর ফরিদপুর ও রাজশাহীতে, যেখানে বিষধর সাপ বেশি দেখা যায়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে, গত বছর সাপের কামড়ে মারা যাওয়া রোগীদের অধিকাংশকেই প্রথমে ওঝা বা বৈদ্যর কাছে নেওয়া হয়েছিল। দ্রুত সময়ের মধ্যে আধুনিক চিকিৎসা নিলে এদের মধ্যে ৯০ শতাংশ রোগীকেই বাঁচানো যেত। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ২০২১ সালের পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর ৪ লাখেরও বেশি মানুষ সাপের ছোবলের শিকার হন, যার মধ্যে প্রায় ৯৬ হাজার ৫০০টি বিষধর সাপের ছোবল। এই বিষধর সাপের ছোবলে বছরে সাড়ে ৭ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনো ছয় প্রজাতির বিষধর সাপের বসবাস আমাদের চারপাশে। সেসব বিষধর সাপের কামড়ের শিকার হন দেশের প্রায় সাড়ে ৯৬ হাজার মানুষ। যার মধ্যে মৃত্যু হয় বছরে সাড়ে ৭ হাজারের বেশি মানুষের। আর এক দিনে সাপের কামড়ে মারা যায় গড়ে ২০ জন। বিশ্বে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ প্রজাতির সাপ রয়েছে। আর বাংলাদেশে আছে ৯০ প্রজাতির সাপ। এসবের মধ্যে ৫ শতাংশ বিষধর। এগুলোর মধ্যে অন্যতম রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া, কিং কোবরা বা শঙ্খচূড়, নায়া নায়া (কোবরা বা গোখরা প্রজাতির সাপ), কেউটে, ক্রেইট বা শঙ্খিনী ও নায়া কাউচিয়া। এর মধ্যে রাসেলস ভাইপার সবচেয়ে বিষাক্ত। এ সাপটি ১০০ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। গত ১০-১২ বছর আগে থেকে আবার এ সাপের দেখা মিলছে। বর্তমানে ২৭টি জেলায় এর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব, দেরিতে হাসপাতালে যাওয়া, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সরকারি হাসপাতালগুলোতে অ্যান্টিভেনম না থাকা এবং অ্যান্টিভেনম থাকলেও তা ব্যবহারে চিকিৎসকদের অনীহা, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের অভাব-এসব কারণে সাপে কাটা রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, বিষধর সাপের ছোবলের লক্ষণ হলো-দংশিত স্থান ফুলে যাওয়া, রক্তপাত, রোগী তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া, প্রস্রাব কমে যাওয়া বা কালো হওয়া। তারা বলেন, সাপে কাটা ব্যক্তিকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে এবং কোনো রকম ঝাড়ফুঁক বা কুসংস্কারের পেছনে সময় নষ্ট করা যাবে না।
জানা গেছে, দেশে নিজস্বভাবে উৎপাদিত কোনো অ্যান্টিভেনম নেই এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও এর তীব্র সংকট রয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে সাপে কাটা রোগীদের জন্য কার্যকর চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, যা মৃত্যুর হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। সাপের কামড় নিয়ে নানা ধরনের কুসংস্কার প্রচলিত আছে, যার ফলে সঠিক চিকিৎসা পেতে দেরি হয় বা চিকিৎসা গ্রহণ থেকে মানুষ বিরত থাকে। বর্ষা ও বন্যার কারণে সাপের আনাগোনা বাড়ে, ফলে লোকালয়ে বিষধর সাপ ঢুকে পড়ার ঘটনা বৃদ্ধি পায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বনাঞ্চল ও কৃষিজমি কমে আসছে, যা সাপের আশ্রয়স্থল ধ্বংস করছে এবং মানুষ ও সাপের মধ্যে সংঘাত বাড়াচ্ছে। তবে দেশে সাপের কামড়ে মৃত্যুর সংখ্যা কমাতে সম্ভাব্য সমাধান হচ্ছে-অ্যান্টিভেনম উৎপাদন, স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়ন এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। সংশ্লিষ্ট্ররা বলছেন, দেশীয় বিষধর সাপের জন্য উপযোগী অ্যান্টিভেনম দেশেই উৎপাদন করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রান্তিক পর্যায়ে, বিশেষ করে ইউনিয়ন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে সাপের কামড়ের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অ্যান্টিভেনম ও সরঞ্জাম নিশ্চিত করতে হবে। সাপের কামড় থেকে বাঁচতে প্রয়োজনীয় করণীয় এবং কুসংস্কার পরিহার করে সঠিক চিকিৎসার গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। সর্বশেষ ২৮ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে সাপের কামড়ে খলিল মৃধা (৫৫) নামের একজনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি বোয়ালমারী উপজেলার সাতৈর ইউনিয়নের মোহনপুর গ্রামের ইনতাজ মৃধার ছেলে। ২৮ সেপ্টেম্বর বাড়ির পার্শ্ববর্তী একটি মাঠ থেকে ছাগল আনতে গেলে এ ঘটনা ঘটে। তবে হাসপাতাল ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, খলিল মৃধাকে রোববার বেলা এগারোটার দিকে বাড়ির পাশের একটি মাঠ থেকে বিষধর সাপে কামড় দেয়। ঘন্টাখানেক পরে স্বজনরা বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা রোগীর লক্ষণ ও কিছু পরীক্ষার পর নিশ্চিত হন সাপটি বিষধর। এরপর বেলা ১টার দিকে তাকে সাপের বিষের প্রতিষেধক (এন্টিভেনম) দেয়া হয়। কিন্তু মিনিট খানেকের মধ্যেই রোগীর মৃত্যু ঘটে। এরআগে ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় সাপে কাটা ৬ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন প্রমাণস্বরূপ বিষধর সাপও নিয়ে হাসপাতালে চলে আসেন। ঘটনাটি জানাজানি হতেই পুরো এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ২৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে উঠানে কাজ করার সময় জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার চারোল ইউনিয়নের মইনুল ইসলামের পায়ে কামড় দেয় সাপটি। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর চিকিৎসকেরা তাকে তাৎক্ষণিকভাবে অ্যান্টিভেনম দেন। একদিনের চিকিৎসা শেষে বর্তমানে তিনি সুস্থ আছেন। মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা মইনুল ইসলাম বলেন, দুপুরে উঠানে কাজ করছিলাম। এসময় হঠাৎ একটি সাপ এসে পায়ে কামড় দেয়। বিষের ভয়াবহতা বুঝতে পেরে পরিবারের সদস্যরা দ্রুত আমাকে ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। যেন ডাক্তাররা সহজে বুঝতে পারেন, কোন সাপ কামড়েছে। ২৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক ডা. ফুয়াদ বলেন, কেবল মইনুল ইসলাম নন, গত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একই হাসপাতালে আরও পাঁচজন সাপে কাটার রোগী ভর্তি হয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই ঠাকুরগাঁও সদর,বালিয়াডাঙ্গী ও রানীশংকৈল উপজেলার বাসিন্দা। বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকে জেলাজুড়ে সাপের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। ২৬ সেপ্টেম্বর মাদারীপুরে বিষাক্ত সাপের কামড়ে লিমি আক্তার (১৩) নামে এক মাদ্রাসাছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার রাত ৯টার দিকে মাদারীপুর ২৫০ শয্যা জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে তার মৃত্যু হয়। লিমি ডাসার উপজেলার পূর্ব বালিগ্রামের আনোয়ার হোসেনের মেয়ে এবং স্থানীয় একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিলো। এরআগে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার জুনিয়াদহ গ্রামের নিজ ঘরে সাপের কামড়ে শিকার হয় ৮ বছরের শিশু আব্দুল্লাহ। এই ঘটনার পরপরই ওঝা ডেকে বিষ ঝাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কয়েক ঘন্টায়ও কোন সুফল না পাওয়ায় রাত ১টার দিকে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে নিয়ে যান শিশুটির স্বজনরা। জেলা সদর হাসপাতালে সাপে কাটা রোগির ওষুধ (এন্টিভেনম) নেই। এমনকি স্থানীয় ফার্মেসিগুলোতে অনেক খোঁজাখুজির পরেও এন্টিভেম পাওয়া যায়নি। অবশেষে সবার সামনেই রাত সাড়ে ৩টার দিকে ওষুধের অভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু ঘটে শিশু আব্দুল্লাহর। কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে এন্টিভেনমের এ সংকট দীর্ঘদিনের। বিগত তিন মাসে এই হাসপাতালে সাপে কাটা অন্তত ৫-৬ জন রোগীর মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। গত ৫ সেপ্টেম্বর রাত ৯টার দিকে টাঙ্গাইল জেলার সখীপুরের রাকিবকে (৩০) সাপে কাটে। ঘটনার পরপরই সখীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। কিন্তু সেখানে ভ্যাকসিন পাওয়া যায়নি। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রেহেনা পারভীন রুমি জানান, বর্তমানে অ্যান্টিভেনম মজুত নেই। আগে ডিজি হেলথ থেকে যে ভ্যাকসিন বরাদ্দ দেয়া হতো, তা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। পরবর্তীতে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে মেলে এন্টিভেনম। সারা রাত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পর অবশেষ সুস্থ হয়ে ওঠেন রাকিব। শুধু ফরিদপুরের বোয়ালমারী কিংবা কুষ্টিয়া নয়, সাপে কাটা রোগির ওষুধ না পাওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। গত এক মাসে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে সাপে কাটার চিকিৎসা নিতে আসা কয়েক জন রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা জানা গেছে তাদের অনেকেই সাপের কামড়ের চিকিৎসায় কার্যকরী অ্যান্টিভেনম উপজেলায় না পেয়ে জেলা সদরে এবং সেখানে না পেয়ে ঢামেকে এসেছেন। তারা বলছেন, কাছাকাছি অ্যান্টিভেনম না থাকায় বাধ্য হয়ে রোগীর স্বজনদের ছুটতে হয় ঢাকা কিংবা বিভাগীয় শহরে। সেখানে পৌঁছাতে এতটা দেরি হয়ে যায় যে, শেষ পর্যন্ত সাপের কামড়ে আহত অনেককে বাঁচানো যায় না।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ জানান, সাপের ছোবলের ঘটনা বেশি ঘটে বর্ষাকালে, অর্থাৎ জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে। আর সাপের প্রজনন মৌসুম ‘অক্টোবর’ মাসে। দেশে এই দুই সময়ে সাপের ছোবলের ঘটনা বেড়ে যায়। তিনি বলেন, আমাদের দেশে ব্যবহৃত অ্যান্টিভেনমগুলো শত বছরের পুরোনো প্রযুক্তিতে তৈরি এবং দক্ষিণ ভারতের চার ধরনের সাপ থেকে সংগৃহীত বিষে তৈরি হওয়ায় সব ধরনের সাপের বিষের বিরুদ্ধে এটি কার্যকর নয়। অ্যান্টিভেনম প্রয়োগের পরও ২০ থেকে ২২ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (এনসিডিসি) লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. সৈয়দ জাকির হোসেন বলেন, দেশে অ্যান্টিভেনমের কোনো সংকট নেই। বছরে ৭০ হাজার ডোজ অ্যান্টিভেনমের প্রয়োজন হলেও, বাস্তবে ২৫ হাজারের বেশি ব্যবহৃত হয় না, কারণ মানুষ চিকিৎসকের কাছে আসে না। তিনি জানান, সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার ১০ হাজার ভায়াল অ্যান্টিভেনম কিনেছে, আর ১০ হাজার ভায়াল দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সর্বশেষ গত দুই মাসে আড়াই হাজার ভায়াল সরবরাহ করা হয়েছে সরকারি হাসপাতালে। বর্তমানে মজুত রয়েছে ৬৫০ ভায়াল।