
রাজধানীর অধিকাংশ এলাকাতেই সারাবছরই খোঁড়াখুঁড়ি করে চলছে বিভিন্ন সংস্থা। পাশাপাশি দেখা যায় সংশ্লিষ্ট সংস্থা গুলো রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির পর সময়মতো তা মেরামত করেনা। খোঁড়াখুঁড়ির সময় সড়কের এক বড় অংশে ফেলে রাখা হয় মাটি, ইটসহ বিভিন্ন সামগ্রী। দীর্ঘ সময় পরও সেসব সরানো হয় না। এতে করে বেড়েই চলছে নগরবাসীর ভোগান্তি। দেখা যায় খননের পর ময়লা ও মাটি স্তূপাকারে ফেলে রাখা হয় মাসের পর মাস। যদিও এই অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি নিয়ন্ত্রণের নীতিমালা প্রয়োগ করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এই নীতিমালা মানছে না কোন সংস্থাই। যে যার মতো খোঁড়াখুঁড়ি করেই চলছে। কোন উন্নয়ন কাজ চলাকালে অত্র এলাকায় বসবাসকারীদের যে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হবে তা যেন বর্তমানে নিয়মে পরিণত হয়েছে। কয়েকদিন বাদেই শুরু হবে বর্ষা মৌসুম। সূত্র বলছে, এই মুহূর্তে ঢাকায় খোঁড়াখুঁড়ি চলছে দুই সিটি কর্পোরেশনের দেড় শতাধিক রাস্তায়। এই খোঁড়াখুঁড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানজট ও ভোগান্তি। সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে সড়ক খনন ও পুনর্নির্মাণ সমন্বয় করতে রয়েছে দুই সিটির দুটি ওয়ানস্টপ সমন্বয় সেল। সেবা সংস্থাগুলো উন্নয়ন কাজের আগে ওয়ানস্টপ সমন্বয় সেলের কাছে অনুমতি নেয়। শুষ্ক মৌসুম ধরে অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেওয়া হয় অনুমতি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সর্বশেষ ওয়ানস্টপ সমন্বয় সেলের সভায় তাদের নিজস্ব ৩৪টি সড়কসহ ৮০টি সড়ক খনন ও সংস্কারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ওয়ানস্টপ সমন্বয় সেলের মার্চ মাসের সভায় ৮টি সংস্থাকে ৪৩টি সড়ক খনন ও সংস্কারের অনুমতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া ডিএসসিসি তাদের নিজস্ব সড়কের উন্নয়ন ও সংস্কারের কাজও করছে। সবমিলিয়ে দক্ষিণ সিটিতে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে এমন সড়কের সংখ্যা অন্তত ৬০টি। এর মধ্যে ভূগর্ভস্থ বৈদ্যুতিক কেবল স্থাপনের কাজে খোঁড়াখুঁড়িতে নাভিশ্বাস উঠেছে নগরবাসীর। এ কাজটি গত ৩০ এপ্রিল শেষ হওয়ার কথা থাকলেও চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজই শুরু করেছে সে মাসের শেষ দিকে। ওয়ানস্টপ সেল নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার তাগিদ দিলেও তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। যদিও ঢাকা মহানগরীর সড়ক খনন নীতিমালা-২০১৯-এ উল্লেখ রয়েছে বর্ষা মৌসুমে রাজধানীর কোনো সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি বা সড়ক কাটা যাবে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে খননকাজ শুরু করলে মূল খরচের পাঁচ গুণ জরিমানা গুনতে হবে। জরুরি প্রয়োজনে খনন করতে হলে মূল ক্ষতিপূরণসহ অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ ফি দিতে হবে। মাসের পর মাস কোনো সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি না করা, নিয়মিত পানি ছিটানো, সড়কে মালামাল মজুদ না করাসহ বিভিন্ন নিয়মকানুন নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে। নীতিমালার কোনো শর্তে ব্যত্যয় হলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে জরিমানা বা শাস্তি দেওয়ারও বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কাগজে-কলমে নীতিমালা করা হলেও তা মানছে না কোন সংস্থাই। এ প্রসঙ্গে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেন, ‘এসব প্রকল্প আগে থেকেই নেওয়া হয়ে থাকে, জুনের আগেই এসব প্রকল্পের কাজ শেষ করার তাড়া থাকে। ধাপে ধাপে কাজগুলো করতে দেরি হয়ে যায়। তবে যেসব এলাকায় জনদুর্ভোগ বেশি হচ্ছে সেসব এলাকার কাজ দ্রুত শেষ করার চেষ্টা চলছে’। তিনি আরও বলে, ‘বিভিন্ন সংস্থার উন্নয়ন কাজের জন্য সড়ক খননের অনুমতি দেওয়া হয়। সংস্থাগুলো বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে একদম শেষমুহুর্তে এসে সড়ক খোঁড়ার অনুমতি চায়। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে এসে অনেক সংস্থা টাকা জমা দিয়ে কাজ শুরু করতে চাইলেও আমরা অনুমতি দিইনি। এসব কাজ দ্রুত শেষ করতে তাদের নিয়ে সভা করার পাশাপাশি লিখিতভাবে সতর্কও করা হচ্ছে। অনেককে জরিমানাও করা হবে’। দেখা যায় ঢাকার তাঁতীবাজার থেকে বংশাল সড়কে গত বছরের জুলাইয়ে ড্রেনেজ নির্মাণের জন্য দেড় কিলোমিটারের ওই সড়কের একপাশের প্রায় অর্ধেক অংশজুড়ে শুরু হয় খোঁড়াখুঁড়ি। কেবল স্থাপনের কাজটি শেষ হওয়ার কথা গত ৩০ এপ্রিল। অথচ দেখা যায় চায়নার ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি কাজই শুরু করে এপ্রিলের শেষ দিকে। এদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে এমন সড়কের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। সময়মতো কাজ শেষ না করায় জরিমানা করেও কোনো ফল মিলছে না। সম্প্রতি দেখা যায় মতিঝিল ও টিকাটুলিতে সড়ক কেটে উন্নয়নের কাজের কারণে ভোগান্তিতে পড়ছে উক্ত এলাকার মানুষ। বিশেষ করে ইত্তেফাক মোড়ে এই ভোগান্তি যেন চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ওই সড়কে প্রতিদিন সকাল থেকে শুরু হওয়া যানজট গভীর রাতেও শেষ হচ্ছে না। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টিকাটুলি অংশ থেকে এক দিকে মতিঝিল হয়ে ফকিরাপুল পর্যন্ত ও অন্য দিকে গুলিস্তান পর্যন্ত বিস্তীর্ণ হয়ে পড়ছে যানজট। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘পূর্ব প্রস্তুতি থাকলে খুব একটা সমস্যা হয় না, কিন্তু তারা প্রস্তুতি নিতে বিলম্ব করে। তারা মে মাসের কথা বললেও আমরা বলেছি, ৩০ এপ্রিলের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে’। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ‘এ বছরে ৩০ এপ্রিলের পর সড়ক খোঁড়াখুঁড়িতে কোনো অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। যতই চাপ আসুক না কেন, এ বিষয়ে আমরা কঠোর থাকব’। এদিকে ঢাকা উত্তরে দেখা যায় সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন নতুন করে সিটি কর্পোরেশনে যুক্ত হওয়া নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের মেগা প্রকল্পের কাজে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের অবহেলার অভিযোগ রয়েছে। কাজের শর্ত অনুযায়ী এ প্রকল্পে ইটা বালু সিমেন্ট যা ব্যবহার করা হবে সব কিছুর গুণগত মান ১ নাম্বার দেওয়ার কথা থাকলেও কাজে তদারকির অভাবে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায় পরে এলাকাবাসীর দাবিতে ঠিকাদারের লোকজন কাজ বন্ধ করে দেয়। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘সেবা সংস্থাগুলোর প্রকল্প অনুমোদন ও অর্থের সংস্থান ভিন্ন ভিন্ন সময়ে হওয়ায় যখন-তখন খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করা যাচ্ছে না। আমরা দুই মেয়র আলাপ-আলোচনা সাপেক্ষে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি’। এদিকে বাবুবাজার সেতু থেকে বংশাল আলুবাজার পর্যন্ত প্রধান সড়কের প্রায় দেড় কিলোমিটারজুড়ে ড্রেনেজ নির্মাণকাজ করছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া নির্মাণকাজ আগামী ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। তবে এই ড্রেনেজ নির্মাণকাজটি ঠিকাদার মাত্র ছয় মাস আগে শুরু করেছেন। তিন লেন সড়কটির এক লেনজুড়ে ড্রেন নির্মাণে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। তবে বাকি দুই লেনের মধ্যে শুধু একটি লেনে গাড়ি চলাচল করতে পারছে। দক্ষিণবঙ্গ থেকে ঢাকার প্রবেশমুখে যানজট লেগেই আছে। ওই এলাকার ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন বলেন, ‘তাঁতীবাজার থেকে বংশাল সড়কে যাতায়াত করার কথা ভাবলেই আঁতকে ওঠেন মানুষ। খোঁড়াখুঁড়ি করে ঢিমেতালে কাজ করছেন ঠিকাদার। দোকানের সামনের সড়কটি খোঁড়া থাকায় লোহার জিনিসপত্র লোড-আনলোডে অনেক সমস্যা হচ্ছে।’ তাঁতীবাজার ট্রাফিক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ছয় মাস ধরে সড়কের একপাশে কাজ চলছে। তিন লেনের মধ্যে মাত্র এক লেন ব্যবহার করা যাচ্ছে। আর এক পাশের গাড়ির চাপ সামলাতে আরেক পাশেও যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।’ এ ছাড়া দক্ষিণ সিটির আওতাভুক্ত যাত্রাবাড়ী, রাজারবাগ, শেওড়াপাড়া, মিরপুর-২, মিরপুর-১০, উত্তরখান, দক্ষিণখান, বাড্ডা, গুলশান-তেজগাঁও লিঙ্ক রোড, বাসাবো, খিলগাঁও, ওয়াইজঘাট, সিদ্ধেশ্বরী, জুরাইন, শ্যামপুর, ধানমন্ডি এলাকার সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছে, ‘রাজধানীতে যে অপরিকল্পিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলছে, তা বন্ধ করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে প্রণীত নীতিমালা মেনে চলার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কঠোর হতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে খোঁড়াখুঁড়ি করলে ভোগান্তি বাড়ে। এক্ষেত্রে সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকাও জরুরি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সঠিক সময়ে কাজ শেষ করতে বাধ্য করতে হবে ও উক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে বছরের শুরুতেই একটি নির্দিষ্ট কর্ম পরিকল্পনা দিতে হবে। তা না হলে ভরা বর্ষায় এসব সড়কগুলো হয়ে উঠবে গলার কাঁটা। যার দায় ঢাকার দুই নগর কর্তৃপক্ষের’।