মেগা প্রকল্পে বাড়তি ব্যয়ের অভিযোগ

নেই নিরীক্ষার উদ্যোগ

আপলোড সময় : ২৫-০৮-২০২৫ ১০:৩১:৩৮ পূর্বাহ্ন , আপডেট সময় : ২৫-০৮-২০২৫ ১০:৩১:৩৮ পূর্বাহ্ন
দেশে মেগা প্রকল্পগুলোতে বাড়তি ব্যয়ের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে এক বছরেও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক নিরীক্ষার উদ্যোগ নেয়নি। যদিও দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরতে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর শ্বেতপত্র কমিটি এবং অর্থনৈতিক কৌশল পুননির্ধারণে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। তাদের প্রতিবেদনে বিগত সরকার বাস্তবায়িত ৮টি মেগা প্রকল্পে প্রারম্ভিক ব্যয়ের তুলনায় ৭ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার বা ৯১ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয়ের কথা বলা হয়েছে। মূলত দুর্বল পরিকল্পনা, বাস্তবায়নে বিলম্ব এবং দুর্নীতিই হচ্ছে ব্যয় বৃদ্ধির প্রধান কারণ। তবে পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। দেশের বেসরকারি ব্যাংক খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে যেমন আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়েছে, তেমনি মেগা প্রকল্পের বাড়তি ব্যয় নিয়েও আন্তর্জাতিক নিরীক্ষার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। খাতসংশ্লিষ্ট এবং অর্থনীতিবিদদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত শ্বেতপত্র কমিটি ও টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে আমলে নেয়া আটটি প্রকল্প হলো পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, যমুনা রেলওয়ে সেতু, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, এমআরটি লাইন-৬ (উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল), বিআরটি-৩ (বিমানবন্দর-গাজীপুর বাস র?্যাপিড ট্রানজিট) এবং হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল। ওই আট প্রকল্পের শুরুর দিকে ১১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বা ১৩ লাখ ৭০ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল। কিন্তু নির্মাণ শেষে তা বেড়ে ১৮ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার বা, ২ লাখ ২৮ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। অর্থাৎ প্রারম্ভিক ব্যয়ের চেয়ে বেশি খরচ হয়েছে ৬৮ শতাংশ বা ৯১ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প নিয়ে মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয় একটি বিশেষ নিরীক্ষা করেছে। তবে সরকারি ওই প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে প্রায়ই। সেজন্যই মেগা প্রকল্পগুলোর নিরীক্ষায় খাতসংশ্লিষ্টরা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়োগের পরামর্শ দিচ্ছেন। তাদের মতে, যেহেতু সব মেগা প্রকল্প বিদেশী পরামর্শক ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে, তাই ওসব প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুটপাটের তদন্তেও আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ জরুরি। সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু ছিলো বিগত সরকারের আমলে বাস্তবায়িত সবচেয়ে আলোচিত প্রকল্প। ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রকল্পটির অনুমোদন দেন। তখন ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে প্রকল্পটি সংশোধন করে নির্মাণ ব্যয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটিতে উন্নীত করে। পরবর্তীতে আরো একাধিকবার সংশোধনের পর ব্যয় বেড়ে প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। প্রারম্ভিক ব্যয় থেকে প্রকল্পটির চূড়ান্ত ব্যয় ২২১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৪ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা প্রারম্ভিক ব্যয়ে শুরু হওয়া প্রকল্পটি ৪৭ হাজার ৯২ কোটি টাকায় শেষ হয়েছে। একইভাবে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ৪৫ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে। ৩৭ হাজার ৮২০ কোটি টাকায় শুরু হওয়া প্রকল্পটি ৫৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকায় শেষ হয়। নকশাগত জটিলতা, কেনাকাটায় বিলম্বকে ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়েছে। তাছাড়া বিগত ২০১৬ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন হওয়া যমুনা রেল সেতুতে ৭৩ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে। ১০ হাজার ৭৮৪ কোটি ৮০ লাখ টাকায় শুরু হওয়া প্রকল্পটি ১৮ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকায় শেষ হয়। বিলম্বিত বাস্তবায়নের কারণে মূল্য সমন্বয় এবং দরপত্র প্রতিযোগিতামূলক না হওয়াকে ব্যয় বৃদ্ধির কারণ। আর ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পে ৩১ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে। ওই প্রকল্পটি ১৩ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকায় শুরু হয়েছিল। কিন্তু শেষ হওয়ার পর ব্যয় বেড়ে ১৭ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। নকশা পরিবর্তন, অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয়কে বৃদ্ধির কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। তাছাড়া কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় বেড়েছে ২২ শতাংশ। ওই প্রকল্পটি ১২০০ কোটি টাকায় শুরু হয়েছিল। কিন্তু শেষ হওয়ার পর ব্যয় বেড়ে ১৪ হাজার ৬৪০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে দেখানো হয়। আর উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পটি ২৫ হাজার ৬২০ কোটি টাকায় শুরু হলে ৪০ হাজার ২৬০ কোটি টাকা খরচ করে শেষ হচ্ছে। ব্যয় বৃদ্ধির হার ৫৭ শতাংশ। বিলম্বিত নির্মাণকাজের কারণে মূল্য সমন্বয় এবং জমি অধিগ্রহণে জটিলতার কারণে প্রকল্পটির ব্যয় বাড়ে বলে জানানো হয়েছে। তাছাড়া নির্মাণ কাজে চলা অব্যবস্থাপনা আর জনদুর্ভোগের কারণে বিমানবন্দর-গাজীপুর বাস র?্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল। প্রকল্পটি ৫ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকায় শুরু হলেও এখন নির্মাণ ব্যয় ৭ হাজার ৭৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। দুর্বল পরিকল্পনা আর অপ্রতুল ব্যবস্থাপনাকে ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ৩২ শতাংশ ব্যয় বাড়লেও এখনো প্রকল্পটি শেষ হয়নি। ফলে প্রকল্পের সুফল নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। আর শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পটি ১৫ হাজার ৮৬০ কোটি টাকায়শুরু হয়েছিল। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার পর ব্যয় ২৬ হাজার ৮৪০ কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। ব্যয় বৃদ্ধির হার ৬৯ শতাংশ। প্রকল্পটির ব্যয় বাড়ার কারণ হিসেবে নকশা পরিবর্তন, কেনাকাটায় দীর্ঘসূত্রতাকে দেখানো হয়েছে। সূত্র আরো জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে উল্লিখিত আট প্রকল্পই নয়, বিগত সরকারের আমলে বাস্তবায়িত অন্যান্য বড় প্রকল্পকেও মানসম্পন্ন নিরীক্ষার আওতায় আনা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে শুধু দায় নির্ধারণই নয়, ভবিষ্যতের বড় প্রকল্পগুলোয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। কারণ ?বাংলাদেশে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় প্রচুর সম্পদ নষ্ট হয়। ঋণদাতা সংস্থার সঙ্গে যথাযথ চুক্তি না করতে পারা, দরপত্রের কাগজপত্র সঠিকভাবে তৈরি করতে না পারা, জমি অধিগ্রহণে বিলম্ব, ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতাসহ নানা কারণে এদেশে প্রকল্প বাস্তবায়নে অতিরিক্ত ব্যয় হয়। আবার নানা খাতে দুর্নীতি-অনিয়মও হয়। এসব সমস্যা বন্ধ করতে চাইলে প্রকল্পভিত্তিক নিরীক্ষা করা প্রয়োজন। আইএমইডি (পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ) এ ধরনের কিছু নিরীক্ষা করলেও সেগুলোকে খুব একটা গ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরা হয় না। যদি প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সম্পদের অপচয়, অনিয়ম-দুর্নীতি কমিয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে অন্যান্য দেশের মতো কাজ করতে হয়, তাহলে প্রতিটি কাজের পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। আর কোনো তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে এ পুনর্মূল্যায়নের কাজটি গ্রহণযোগ্য করতে হবে। এদিকে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মেহেদী হাসান জানান, দেশের মেগা প্রকল্পগুলোয় নিরীক্ষা করা সম্ভব। দেশের অবকাঠামো প্রকল্পগুলো বিদেশী ঋুনির্ভর। যে দেশের ঋণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাজগুলো ওই দেশের ঠিকাদাররাই করে থাকে। ফলে ওসব প্রকল্পের কেনাকাটার একটা বড় অংশ ঋণদাতা দেশ বা অন্য কোনো দেশে হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে মেগা প্রকল্পগুলোর নিরীক্ষা করতে হলে তা বিশেষায়িত নিরীক্ষা হতে হবে। যেমন অবকাঠামো নির্মাণে যে উপকরণ ব্যবহৃত হয়েছে, সেটির গুণগত মান চুক্তিতে কেমন ছিল আর বাস্তবে কেমন হয়েছে। ওই উপকরণ যে দামে কেনা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তার প্রকৃত দাম আসলেই সেটা কিনা, একই ধরনের প্রকল্পে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কেমন ব্যয় হয়েছে- এমন বিভিন্ন খাত, উপখাত বিশ্লেষণ করে নিরীক্ষাটি করতে হবে। যেহেতু ওসব প্রকল্পে বিদেশী ঋণ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জড়িত এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের প্রয়োজন রয়েছে, তাই ওই ধরনের বিশেষ নিরীক্ষায় স্বনামধন্য বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করানো হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে। অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানান, দেশের মেগা প্রকল্পগুলোয় তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে মানসম্পন্ন নিরীক্ষা করানোর কোনো উদ্যোগ আপাতত নেই। তবে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে দুদক কাজ করছে। আলাদা করে কোনো নিরীক্ষা বা তদন্তের পরিকল্পনা আপাতত সরকারের নেই।

সম্পাদকীয় :

সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি : সৈয়দ এম. আলতাফ হোসাইন।

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক : সৈয়দ মোঃ আতিকুল হাসান।

নির্বাহী সম্পাদক আশীষ কুমার সেন।

ফোন : ৪৯৩৫৭৭৩০ (বার্তা), ৮৩১৫৬৪৯ (বাণিজ্যিক), ফ্যাক্স; ৮৮-০২-৮৩১৪১৭৪

অফিস :

প্রকাশক কর্তৃক রোমাক্স লিমিটেড, তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে মুদ্রিত।

সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : খলিল ম্যানশন (৩য়, ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলা), ১৪৯/এ, ডিআইটি এক্সটেনশন এভিনিউ, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত।

ই-মেইল : [email protected], ওয়েবসাইট : www.dainikjanata.net