কফি ও কাজুবাদাম চাষে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

আপলোড সময় : ২৩-০৮-২০২৫ ১২:১৭:০৫ পূর্বাহ্ন , আপডেট সময় : ২৩-০৮-২০২৫ ১২:১৭:০৫ পূর্বাহ্ন

বাংলাদেশে কফি ও কাজুবাদাম চাষ এখন আর স্রেফ গবেষণার বিষয় নয়, বরং ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে উচ্চমূল্যের বাণিজ্যিক কৃষি খাতে। সরকারের উদ্যোগ, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধান এবং কৃষকের আগ্রহ- সবকিছু মিলিয়ে এই দুই রপ্তানিযোগ্য ফসল এখন দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন তারকা। জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বনজ পরিবেশ, টাঙ্গাইলের মধুপুর গড় কিংবা উত্তরের শীতল অঞ্চলে এখন পরীক্ষামূলকভাবে কফি চাষ হচ্ছে। রোবাস্টা জাতটি এই দেশের আবহাওয়ার জন্য সবচেয়ে উপযোগী হিসেবে বিবেচিত। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে কফি চাষের জন্য ১০ হাজার হেক্টর জমি নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও, কৃষকদের দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে চারা, চাষের প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্র। আন্তঃফসল হিসেবে আনারস, গোলমরিচ এবং পেঁপের মতো ফসলের সঙ্গে কফি চাষের সফলতা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত। কৃষি গবেষকরা বলছেন, কফি চাষে কম খরচে উচ্চ মুনাফা সম্ভব, এবং প্রাকৃতিক বন পরিবেশকে রক্ষা করে এই ফসলটি চাষ করা যায়, যা পরিবেশবান্ধব কৃষির দিকেও বড় পদক্ষেপ। এদিকে, কাজুবাদামে বৈশ্বিক বাজারে স্থান করে নেওয়ার সুযোগও রয়েছে। বাংলাদেশে এখন বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ছাড়াও চট্টগ্রাম, সিলেট, ঠাকুরগাঁও, টাঙ্গাইল ও গাজীপুরে কাজুবাদাম চাষের পরীক্ষা চালানো হচ্ছে। প্রাথমিক ফলাফল অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। একটি গাছে ৪-৫ কেজি ফলন পাওয়া যাচ্ছে, উন্নত জাতের গাছে ফলন হচ্ছে ১২-১৪ কেজি পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ফসল আন্তর্জাতিক বাজারে বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে-বিশ্বে কাজুবাদামের বাজারের পরিমাণ ১৪.৯ বিলিয়ন ডলার। সরকার ইতোমধ্যে ‘কফি ও কাজুবাদাম গবেষণা, উন্নয়ন ও সমপ্রসারণ’ প্রকল্পে ২১১ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে, এবং আমদানিকৃত কাঁচা বাদামে শুল্ক ৯০% থেকে কমিয়ে ৫% করে দিয়েছে, যাতে স্থানীয় প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানগুলো উৎসাহ পায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, মানসম্পন্ন জাত এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তির সহায়তায় বাংলাদেশ এই দুই ফসলের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রপ্তানি বাজারে শক্ত অবস্থান নিতে পারে। এতে যেমন কৃষকদের আয় বৃদ্ধি পাবে, তেমনি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ তৈরি হবে। এদিকে দেশের পাহারগুলোতে জুমচাষ থেকে কৃষক এখন সম্ভাবনাময় কাজু-কফি চাষি। এতে দেশের অর্থনীতিতেও লাগছে বদলের হাওয়া। সরেজমিনে বান্দরবানে দেখা যায়, পাহাড়গুলো এখন সনাতন কৃষি থেকে বের হয়ে আধুনিক কৃষির সাম্রাজ্যে প্রবেশের চেষ্টা করছে। আর এ প্রচেষ্টার বীজ জোগান দিচ্ছে পাহাড়ে পরিচালিত ‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সমপ্রসারণ প্রকল্প’। প্রকল্প পরিচালক শহিদুল ইসলাম বলেন, পাহাড়ে যতটুকু চাষ সম্ভব হচ্ছে, এর চেয়েও বহুগুণ বাড়ানো সম্ভব। আমার প্রকল্পের কার্যক্রম ২০২১ সালের জুন মাসে শুরু হয়। দেশের ১৯ জেলার ৬৬টি উপজেলায় প্রকল্প কার্যক্রম চলমান। প্রকল্পের শুরুতে দেশে কাজুবাদাম চাষ হতো দুই হাজার ২শ হেক্টর জমিতে। প্রকল্প কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে বর্তমানে প্রায় চার হাজার ২শ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে। একই সঙ্গে ওই সময়ের (২০২১ সাল) কফি চাষ মাত্র ৬৫ হেক্টর থেকে বেড়ে এক হাজার ৮শ হেক্টরে উন্নীত হয়েছে। এ সমপ্রসারণ অধিকাংশই দেশের তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় হয়েছে। তিনি আরও বলেন, পাহাড়ে এখনো ৯৮ শতাংশ জমি অনাবাদি। যার প্রায় সবগুলোতে কফি ও কাজুবাদাম চাষ করা সম্ভব। অন্তত কয়েক বছরের মধ্যেই পাহাড়ের এক লাখ হেক্টর জমিতে কাজুবাদাম ও আরও এক লাখ হেক্টর জমিতে কফি চাষ সম্ভব। চাষাবাদ করলে শুধু উৎপাদন নয়, দেশের পাহাড়িদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, সার্বিক রপ্তানিসহ অনেক পরিবর্তন সম্ভব বলে জানান এ প্রকল্প পরিচালক। তিনি বলেন, কাজুবাদাম উৎপাদনে একদম যত্নের প্রয়োজন হয় না। একবার গাছ লাগালে হয়ে যায়। ঘরে মাসের পরে মাস সংরক্ষণ করা যায়। এটার দাম ভালো। কফিও তাই। এমন উচ্চমূল্যের ফলন কমই আছে। জানা যায়, এক কেজি কাজুবাদাম বিক্রি করে তিনি ২০০ টাকা ও কফি বীজে ৪শ থেকে ৬শ টাকা পাচ্ছেন চাষীরা। কিন্তু পাহাড়ে এক কেজি আম থেকে হয়তো মাত্র ৪০ টাকা পাওয়া যায়। তাই পাহাড়ি কৃষকরা কফি-কাজুবাদাম ফলনে আকৃষ্ট হচ্ছেন। এদিকে, কাজুবাদাম ও কফির আবাদ সমপ্রসারণের ফলে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। ষাটের দশক থেকে পাহাড়ে কাজুবাদামের চাষ হলেও প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির যন্ত্রপাতি সহজলভ্য ছিল না। তাই বাণিজ্যিকভাবে চাষে উৎসাহিত হননি কৃষক। কিন্তু লাভজনক হওয়ায় গত কয়েক বছরে দেশে ২২টি বাদাম প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যার মধ্যে নিয়মিত উৎপাদনে আছে ১৫টি প্রতিষ্ঠান। যাদের ১০-১২ হাজার টন বাদাম প্রক্রিয়ার সক্ষমতা রয়েছে। লাভজনক হওয়ায় বড় করপোরেট গ্রুপগুলোও এ ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে। এছাড়া, দেশে কাজুবাদামের ভোক্তা পর্যায়ে চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। দেশে বর্তমানে কাজুবাদামের বাজার প্রায় ৭শ কোটি টাকার। যেখানে স্থানীয় উৎপাদন মাত্র ১শ কোটি টাকার। বাকি ৬শ কোটি টাকার বাদাম আমদানি করতে হয়। যেজন্য বছরে আড়াই হাজার টন থেকে তিন হাজার টন কাজুবাদাম আমদানি হয়। সেটাও প্রতি বছর বাড়ছে। এদিকে দেশে কফির চাহিদা প্রায় দুই হাজার টন। গত এক দশকে গড়ে কফির চাহিদার প্রবৃদ্ধি প্রায় ৫৬ শতাংশ। বছরে প্রায় ৬শ কোটি টাকার কফি দেশের অভ্যন্তরে বিক্রি হয়। ভোক্তা পর্যায়ে গত পাঁচ বছরে এ দুটি পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। অন্যদিকে, বিশ্ববাজারে বিশাল চাহিদা রয়েছে এ দুই কৃষিপণ্যের। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক আয় সম্ভব। কফি-কাজুবাদাম প্রকল্পের শুরু থেকেই এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য কাজ চলমান। দেশের পার্বত্য অঞ্চলের দুই লাখ হেক্টর অনাবাদি জমিকে কাজুবাদাম ও কফি চাষের আওতায় আনার কাজ চলমান। এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে উৎপাদিত কাজুবাদাম ও কফির মাধ্যমে দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি এক বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি করা সম্ভব। পরিবেশ, অর্থনীতি এবং প্রযুক্তি-তিনটি খাতেই কফি ও কাজুবাদাম চাষ একটি স্থায়ী এবং টেকসই অবদান রাখতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
 

সম্পাদকীয় :

সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি : সৈয়দ এম. আলতাফ হোসাইন।

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক : সৈয়দ মোঃ আতিকুল হাসান।

নির্বাহী সম্পাদক আশীষ কুমার সেন।

ফোন : ৪৯৩৫৭৭৩০ (বার্তা), ৮৩১৫৬৪৯ (বাণিজ্যিক), ফ্যাক্স; ৮৮-০২-৮৩১৪১৭৪

অফিস :

প্রকাশক কর্তৃক রোমাক্স লিমিটেড, তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে মুদ্রিত।

সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : খলিল ম্যানশন (৩য়, ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলা), ১৪৯/এ, ডিআইটি এক্সটেনশন এভিনিউ, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত।

ই-মেইল : [email protected], ওয়েবসাইট : www.dainikjanata.net