
পাঠাও কুরিয়ার সার্ভিসে ডেলিভারির কাজ করেন নাজিম উদ্দিন। সারাদিন ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ডেলিভারি শেষ করে তিনি বিকেল বা সন্ধ্যায় ফেরেন বাসায়। ৭ আগস্ট বিকেলের দিকে ডেলিভারি শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন নাজিম। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে ফেরা হয়নি তার। মোহাম্মদপুরে ঢাকা উদ্যানের ৫ নম্বর রোডের ডি ব্লকের সড়কে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা হঠাৎ তার সামনে আসে। রিকশা থেকে দুজন যাত্রী ও চালক নেমে ধারালো সামুরাই ধরে নাজিমের কাছে থাকা ডেলিভারির ৪১ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। এরপর অটোরিকশা টান দিয়ে চলে যায় যাত্রীবেশে থাকা ছিনতাইকারীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্র রিমন হোসেন মণ্ডলের ভাগ্য ভালো ছিল না। মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় বন্ধুর বাসা থেকে ভোরে রওয়ানা দেন ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে। কোনো যানবাহন না থাকায় হেঁটেই যাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ পেছন থেকে তিন কিশোর চাপাতি নিয়ে এসে গলা ও পেটের কাছে ধরে। এরপর মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়।
ঘটনার সময় একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা কয়েকবার এসে ওই রাস্তার সামনে দিয়ে ঘুরতে থাকে। এরপর ছিনতাই শেষে ওই রিকশায় করেই ছিনতাইকারীরা পালিয়ে যায়। রাশেদ মোহাম্মদপুর থানায় অভিযোগ করলেও চালক এবং ছিনতাইকারীরা শনাক্ত হয়নি। মোটরবাইক কিংবা প্রাইভেটকারে ছিনতাই রাজধানীতে নতুন নয়। ঢাকার প্রধান সড়কে দুর্ঘটনার অন্যতম অনুঘটক অটোরিকশাও এবার হয়ে উঠছে ছিনতাইয়ের অনুষঙ্গ। রাত কিংবা দিনের আলোয় ছিনতাই হচ্ছে রিকশা ব্যবহার করে। চালকবেশে ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা কৌশলে লুটে নিচ্ছে সাধারণ নাগরিকের সর্বস্ব। বিশেষ করে দ্রুত গতিতে চলা ব্যাটারিচালিত রিকশা ব্যবহার করে ছিনতাই বাড়ছে। দিনের ভাড়া বেশি, তাই রাতে এসব রিকশা ভাড়া করে ছিনতাইকারীরা ছিনতাই করছে ঢাকার অলিগলিতে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রিকশায় মূলত তিনজনের একটি সংঘবদ্ধ দল কাজ করে। একজন রিকশাচালক, যাত্রীবেশে থাকা এক-দুজন অপরাধী এবং রাস্তায় অপেক্ষমাণ সহযোগীরা। কখনো রিকশার পেছনে সঙ্গী সেজে ওঠে ছিনতাইকারী, আবার কখনো সামনে বা পাশ থেকে এসে ছিনতাই করে সব নিয়ে চলে যায়। রিকশায় চালকবেশে থাকা ছিনতাইকারী তার টার্গেট এলাকায় যাত্রী নিয়ে আগে থেকেই সেখানে থাকা তার সঙ্গীদের নিয়ে এ কাজ করে। আরেকটি চক্র আছে যারা রিকশাচালক থেকে যাত্রী সবাই ছিনতাইকারী। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে তারা বিভিন্ন নির্জন এলাকায় পথচারীকে চাপাতি ধরে ছিনতাই করে রিকশা টান দিয়ে পালিয়ে যায়। কয়েকজন ছিনতাইকারী ধরাও পড়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। তাদের কাছ থেকেও এমন কৌশলের কথা জানা যায়।
ছিনতাইয়ের ভয়ে নগরবাসীর একাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছেন। বিশেষ করে রাতের পর শহরের ভেতরে চলাফেরা করা নারীদের জন্য এই ভয় আরও প্রকট। বয়স্ক, শিক্ষার্থী, অফিস যাত্রী, এমনকি হাসপাতালের পথের যাত্রীও এখন নিরাপদ নন।
মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানের বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী সুরাইয়া বিনতে শিমু বলেন, বাসা একটু ভেতরের দিকে হওয়ায় একটা অন্ধকার গলির মধ্য দিয়ে রিকশা নিয়ে যেতে হয়। কিন্তু রাস্তাটি খুব নির্জন থাকায় এখন রিকশা দিয়ে চলাচল কমিয়ে দিয়েছি। মোহাম্মদপুরে ছিনতাই, চুরির ভয়ে আমার ভাই মোটরসাইকেলে আমাকে বাসায় দিয়ে আসে। আমার এই সুবিধা থাকায় এখন আর রিকশায় উঠি না।
কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারিম্যান নাজিম উদ্দিন বলেন, ৭ আগস্ট বিকেল ৪টা ১০ মিনিটের দিকে সাইকেল চালিয়ে ঢাকা উদ্যান পাঁচ নম্বর রোডের ডি ব্লক দিয়ে বাসায় ফিরছিলাম। আমি পাঠাও কুরিয়ারে চাকরি করি। সারাদিন ডেলিভারি দিয়ে ৪১ হাজার টাকা আমার পকেটে ছিল। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যাচ্ছে টাকা নিচ্ছে, কিন্তু চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। আমি সরাসরি দেখলে তাদের চিনবো।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, সামুরাই দেখিয়ে আমাকে বলে, এই লড়বি না লড়লে তোরে খামু একবারে। এই ভয়ে আমি চুপচাপ ছিলাম। এরপর সামুরাই ধরে আমার পকেট থেকে ৪১ হাজার টাকা তারা নিয়ে নেয়। পুরো টাকাটাই ছিল কুরিয়ারের ডেলিভারির। মোবাইল নিলেও পরে তা ফেরত দেয়। রিকশাচালকসহ তিনজন ছিল ছিনতাইকারীরা।
গ্রামাঞ্চল থেকে ঢাকায় আসা সাধারণ মানুষদের টার্গেট করে পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাই করে আসছিল একটি চক্র। তারা রিকশাচালকের বেশে যাত্রী তুলে নিজেদের পূর্বনির্ধারিত স্থানে নিয়ে পুলিশ পরিচয়ে তল্লাশির নামে ছিনতাই করতো। গত বছরের ৫ মার্চ রিকশায় করে কমলাপুর থেকে পুরান ঢাকার বংশালে যাওয়া এক ব্যবসায়ী এক লাখ টাকা খোয়ান। এ ঘটনায় ঢাকার শাহজাহানপুর থানায় করা মামলার তদন্তে নেমে রিকশাচালকের ছদ্মবেশ ও পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনায় চক্রের চার সদস্যকে গত বছরের ১৩ মার্চ গ্রেফতার করে পুলিশ। এসময় তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া ৪০ হাজার টাকা ও ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত দুটি রিকশা উদ্ধার করা হয়।
রিকশাচালকদের মাধ্যমে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন এমন বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী বলেন, রিকশায় ওঠার পর হঠাৎ চালক গলি বা নির্জন পথে রিকশা ঘুরিয়ে নেয়। একপর্যায়ে যাত্রীকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে টাকা, মোবাইল ফোন বা গহনা লুটে নেয়। প্রতিরোধের চেষ্টা করলেই মারধর, এমনকি চাপাতি দিয়ে আঘাতের ঘটনাও ঘটে। এছাড়া নির্জন পথে কোনো যাত্রী একা হেঁটে গেলে টার্গেট করে চালকসহ রিকশায় থাকা যাত্রীবেশে ছিনতাইকারী পথচারীকেও ভয়ভীতি দেখিয়ে মূল্যবান জিনিসপত্র কেড়ে নেয়।
ডিএমপির একটি সূত্র জানায়, ঢাকার বিভিন্ন গ্যারেজ রয়েছে যারা রাতে একটি চক্রকে রিকশা ভাড়া দিচ্ছে। সারারাত এসব রিকশা নিয়ে অপরাধীরা চুরি-ছিনতাই করে। সাধারণ যাত্রীদের চাওয়া, নিরাপদ চলাচলে পুলিশের টহলসহ এমন অপরাধীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নির্জন এলাকা ও অলিগলিতে সিসি ক্যামেরা বাড়াতে হবে। ঢাকায় যেভাবে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বেড়েছে সেভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি। যাত্রী ও পথচারীদের সুরক্ষা দিতে সরকারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একাধিক কর্মকর্তা জানান, রিকশাচালকদের জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই বা নিবন্ধনের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। ফলে অপরাধের পর চালক বা রিকশা চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব।
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ইবনে মিজান বলেন, ছিনতাইসহ যে কোনো অপরাধের বিষয়ে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা তৎপর। রিকশাচালক ছিনতাইকারী চক্রের সদস্য হয়ে থাকলে, এমন নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাসের মাথায় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, এক ব্যক্তি একাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশার মালিক হতে পারবেন না- এমন প্রস্তাব রেখে নতুন নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে। প্রস্তাবিত নীতিমালার আলোকে এখন থেকে কোনো ব্যক্তি একাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশার মালিক হতে পারবেন না। নীতিমালায় ‘যিনি চালক তিনি মালিক’ এ নীতি প্রাধান্য দেওয়া হবে।
জানতে চাইলে রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান লিপন বলেন, এটি একটি নতুন ফেনোমেনা। আগে ব্যাটারিচালিত রিকশা ছিনতাই হতো। রিকশা ছিনতাই করে ব্যাটারি বিক্রি করা হতো। ইদানীং এসব রিকশা দিয়ে ছিনতাই হওয়া উদ্বেগজনক। অপরাধী চক্র সিএনজি, মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার ব্যবহার করতো। এখন রিকশা ব্যবহার করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক থাকার অনুরোধ করবো। পাশাপাশি আমাদের সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করা হবে। তিনি বলেন, দীর্ঘ ১২ বছর ধরে বলছি প্রধান সড়ক বাদে ফিডার সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করার জন্য। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার নীতিমালা চূড়ান্ত করার কথা বলে; কিন্তু নীতিমালা চূড়ান্ত করছে না। এ কারণে দিন দিন জটিলতা বাড়ছে। ব্যাটারি রিকশাকে শৃঙ্খলায় আনতে গেলে নীতিমালা করে প্রশিক্ষণের পর নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে।
রিকশায় অপরাধের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. সরওয়ার বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ডিএমপির সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৪৫০টি রিকশা ডাম্পিং করা হচ্ছে, ব্যাটারি জব্দ করা হচ্ছে, তার কেটে দেওয়া হচ্ছে। মূল সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা যেন না উঠতে পারে সে কারণে শৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশের পাশাপাশি এক হাজার ছাত্র সদস্য কাজ করছে। রিকশা দিয়ে অপরাধ কমাতে রিকশাচালকের পরিচয়পত্র ও রিকশার নম্বরপ্লেটের উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বুয়েটের তৈরি ব্যাটারিচালিত রিকশা সড়কে চলাচল করলে মোটরযান আইন ভঙ্গ করলে যে অপরাধ রয়েছে সেসব অপরাধে সংশ্লিষ্ট রিকশার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হবে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, অপরাধীরা অটোরিকশা ব্যবহারের কারণ স্পিডে চালিয়ে পালিয়ে যাওয়া যায়। অটোরিকশাকে গতি দিয়ে ভুল করছি। কিছুদিন আগে ৩০০ ফিট সড়কে একটি অটোরিকশার ভিডিও ভাইরাল হয়। সেখানে দেখা যায়, একটি অটোকে পাঁচটি গাড়ি দিয়েও ধরতে পারেনি। অনেক দূর গিয়ে অবশ্য ধরা পড়ছিল। এই গতি দুর্ঘটনার বড় কারণ এবং অপরাধীদের জন্য সহায়ক। রিকশাকে অবশ্যই নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে। ঢাকার মধ্যে উত্তর-দক্ষিণ আলাদা রং করা যেতে পারে রিকশায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্র রিমন হোসেন মণ্ডলের ভাগ্য ভালো ছিল না। মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় বন্ধুর বাসা থেকে ভোরে রওয়ানা দেন ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে। কোনো যানবাহন না থাকায় হেঁটেই যাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ পেছন থেকে তিন কিশোর চাপাতি নিয়ে এসে গলা ও পেটের কাছে ধরে। এরপর মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়।
ঘটনার সময় একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা কয়েকবার এসে ওই রাস্তার সামনে দিয়ে ঘুরতে থাকে। এরপর ছিনতাই শেষে ওই রিকশায় করেই ছিনতাইকারীরা পালিয়ে যায়। রাশেদ মোহাম্মদপুর থানায় অভিযোগ করলেও চালক এবং ছিনতাইকারীরা শনাক্ত হয়নি। মোটরবাইক কিংবা প্রাইভেটকারে ছিনতাই রাজধানীতে নতুন নয়। ঢাকার প্রধান সড়কে দুর্ঘটনার অন্যতম অনুঘটক অটোরিকশাও এবার হয়ে উঠছে ছিনতাইয়ের অনুষঙ্গ। রাত কিংবা দিনের আলোয় ছিনতাই হচ্ছে রিকশা ব্যবহার করে। চালকবেশে ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা কৌশলে লুটে নিচ্ছে সাধারণ নাগরিকের সর্বস্ব। বিশেষ করে দ্রুত গতিতে চলা ব্যাটারিচালিত রিকশা ব্যবহার করে ছিনতাই বাড়ছে। দিনের ভাড়া বেশি, তাই রাতে এসব রিকশা ভাড়া করে ছিনতাইকারীরা ছিনতাই করছে ঢাকার অলিগলিতে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রিকশায় মূলত তিনজনের একটি সংঘবদ্ধ দল কাজ করে। একজন রিকশাচালক, যাত্রীবেশে থাকা এক-দুজন অপরাধী এবং রাস্তায় অপেক্ষমাণ সহযোগীরা। কখনো রিকশার পেছনে সঙ্গী সেজে ওঠে ছিনতাইকারী, আবার কখনো সামনে বা পাশ থেকে এসে ছিনতাই করে সব নিয়ে চলে যায়। রিকশায় চালকবেশে থাকা ছিনতাইকারী তার টার্গেট এলাকায় যাত্রী নিয়ে আগে থেকেই সেখানে থাকা তার সঙ্গীদের নিয়ে এ কাজ করে। আরেকটি চক্র আছে যারা রিকশাচালক থেকে যাত্রী সবাই ছিনতাইকারী। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে তারা বিভিন্ন নির্জন এলাকায় পথচারীকে চাপাতি ধরে ছিনতাই করে রিকশা টান দিয়ে পালিয়ে যায়। কয়েকজন ছিনতাইকারী ধরাও পড়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। তাদের কাছ থেকেও এমন কৌশলের কথা জানা যায়।
ছিনতাইয়ের ভয়ে নগরবাসীর একাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছেন। বিশেষ করে রাতের পর শহরের ভেতরে চলাফেরা করা নারীদের জন্য এই ভয় আরও প্রকট। বয়স্ক, শিক্ষার্থী, অফিস যাত্রী, এমনকি হাসপাতালের পথের যাত্রীও এখন নিরাপদ নন।
মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানের বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী সুরাইয়া বিনতে শিমু বলেন, বাসা একটু ভেতরের দিকে হওয়ায় একটা অন্ধকার গলির মধ্য দিয়ে রিকশা নিয়ে যেতে হয়। কিন্তু রাস্তাটি খুব নির্জন থাকায় এখন রিকশা দিয়ে চলাচল কমিয়ে দিয়েছি। মোহাম্মদপুরে ছিনতাই, চুরির ভয়ে আমার ভাই মোটরসাইকেলে আমাকে বাসায় দিয়ে আসে। আমার এই সুবিধা থাকায় এখন আর রিকশায় উঠি না।
কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারিম্যান নাজিম উদ্দিন বলেন, ৭ আগস্ট বিকেল ৪টা ১০ মিনিটের দিকে সাইকেল চালিয়ে ঢাকা উদ্যান পাঁচ নম্বর রোডের ডি ব্লক দিয়ে বাসায় ফিরছিলাম। আমি পাঠাও কুরিয়ারে চাকরি করি। সারাদিন ডেলিভারি দিয়ে ৪১ হাজার টাকা আমার পকেটে ছিল। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যাচ্ছে টাকা নিচ্ছে, কিন্তু চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। আমি সরাসরি দেখলে তাদের চিনবো।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, সামুরাই দেখিয়ে আমাকে বলে, এই লড়বি না লড়লে তোরে খামু একবারে। এই ভয়ে আমি চুপচাপ ছিলাম। এরপর সামুরাই ধরে আমার পকেট থেকে ৪১ হাজার টাকা তারা নিয়ে নেয়। পুরো টাকাটাই ছিল কুরিয়ারের ডেলিভারির। মোবাইল নিলেও পরে তা ফেরত দেয়। রিকশাচালকসহ তিনজন ছিল ছিনতাইকারীরা।
গ্রামাঞ্চল থেকে ঢাকায় আসা সাধারণ মানুষদের টার্গেট করে পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাই করে আসছিল একটি চক্র। তারা রিকশাচালকের বেশে যাত্রী তুলে নিজেদের পূর্বনির্ধারিত স্থানে নিয়ে পুলিশ পরিচয়ে তল্লাশির নামে ছিনতাই করতো। গত বছরের ৫ মার্চ রিকশায় করে কমলাপুর থেকে পুরান ঢাকার বংশালে যাওয়া এক ব্যবসায়ী এক লাখ টাকা খোয়ান। এ ঘটনায় ঢাকার শাহজাহানপুর থানায় করা মামলার তদন্তে নেমে রিকশাচালকের ছদ্মবেশ ও পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনায় চক্রের চার সদস্যকে গত বছরের ১৩ মার্চ গ্রেফতার করে পুলিশ। এসময় তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া ৪০ হাজার টাকা ও ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত দুটি রিকশা উদ্ধার করা হয়।
রিকশাচালকদের মাধ্যমে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন এমন বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী বলেন, রিকশায় ওঠার পর হঠাৎ চালক গলি বা নির্জন পথে রিকশা ঘুরিয়ে নেয়। একপর্যায়ে যাত্রীকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে টাকা, মোবাইল ফোন বা গহনা লুটে নেয়। প্রতিরোধের চেষ্টা করলেই মারধর, এমনকি চাপাতি দিয়ে আঘাতের ঘটনাও ঘটে। এছাড়া নির্জন পথে কোনো যাত্রী একা হেঁটে গেলে টার্গেট করে চালকসহ রিকশায় থাকা যাত্রীবেশে ছিনতাইকারী পথচারীকেও ভয়ভীতি দেখিয়ে মূল্যবান জিনিসপত্র কেড়ে নেয়।
ডিএমপির একটি সূত্র জানায়, ঢাকার বিভিন্ন গ্যারেজ রয়েছে যারা রাতে একটি চক্রকে রিকশা ভাড়া দিচ্ছে। সারারাত এসব রিকশা নিয়ে অপরাধীরা চুরি-ছিনতাই করে। সাধারণ যাত্রীদের চাওয়া, নিরাপদ চলাচলে পুলিশের টহলসহ এমন অপরাধীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নির্জন এলাকা ও অলিগলিতে সিসি ক্যামেরা বাড়াতে হবে। ঢাকায় যেভাবে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বেড়েছে সেভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি। যাত্রী ও পথচারীদের সুরক্ষা দিতে সরকারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একাধিক কর্মকর্তা জানান, রিকশাচালকদের জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই বা নিবন্ধনের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। ফলে অপরাধের পর চালক বা রিকশা চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব।
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ইবনে মিজান বলেন, ছিনতাইসহ যে কোনো অপরাধের বিষয়ে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা তৎপর। রিকশাচালক ছিনতাইকারী চক্রের সদস্য হয়ে থাকলে, এমন নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাসের মাথায় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, এক ব্যক্তি একাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশার মালিক হতে পারবেন না- এমন প্রস্তাব রেখে নতুন নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে। প্রস্তাবিত নীতিমালার আলোকে এখন থেকে কোনো ব্যক্তি একাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশার মালিক হতে পারবেন না। নীতিমালায় ‘যিনি চালক তিনি মালিক’ এ নীতি প্রাধান্য দেওয়া হবে।
জানতে চাইলে রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান লিপন বলেন, এটি একটি নতুন ফেনোমেনা। আগে ব্যাটারিচালিত রিকশা ছিনতাই হতো। রিকশা ছিনতাই করে ব্যাটারি বিক্রি করা হতো। ইদানীং এসব রিকশা দিয়ে ছিনতাই হওয়া উদ্বেগজনক। অপরাধী চক্র সিএনজি, মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার ব্যবহার করতো। এখন রিকশা ব্যবহার করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক থাকার অনুরোধ করবো। পাশাপাশি আমাদের সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করা হবে। তিনি বলেন, দীর্ঘ ১২ বছর ধরে বলছি প্রধান সড়ক বাদে ফিডার সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করার জন্য। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার নীতিমালা চূড়ান্ত করার কথা বলে; কিন্তু নীতিমালা চূড়ান্ত করছে না। এ কারণে দিন দিন জটিলতা বাড়ছে। ব্যাটারি রিকশাকে শৃঙ্খলায় আনতে গেলে নীতিমালা করে প্রশিক্ষণের পর নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে।
রিকশায় অপরাধের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. সরওয়ার বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ডিএমপির সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৪৫০টি রিকশা ডাম্পিং করা হচ্ছে, ব্যাটারি জব্দ করা হচ্ছে, তার কেটে দেওয়া হচ্ছে। মূল সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা যেন না উঠতে পারে সে কারণে শৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশের পাশাপাশি এক হাজার ছাত্র সদস্য কাজ করছে। রিকশা দিয়ে অপরাধ কমাতে রিকশাচালকের পরিচয়পত্র ও রিকশার নম্বরপ্লেটের উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বুয়েটের তৈরি ব্যাটারিচালিত রিকশা সড়কে চলাচল করলে মোটরযান আইন ভঙ্গ করলে যে অপরাধ রয়েছে সেসব অপরাধে সংশ্লিষ্ট রিকশার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হবে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, অপরাধীরা অটোরিকশা ব্যবহারের কারণ স্পিডে চালিয়ে পালিয়ে যাওয়া যায়। অটোরিকশাকে গতি দিয়ে ভুল করছি। কিছুদিন আগে ৩০০ ফিট সড়কে একটি অটোরিকশার ভিডিও ভাইরাল হয়। সেখানে দেখা যায়, একটি অটোকে পাঁচটি গাড়ি দিয়েও ধরতে পারেনি। অনেক দূর গিয়ে অবশ্য ধরা পড়ছিল। এই গতি দুর্ঘটনার বড় কারণ এবং অপরাধীদের জন্য সহায়ক। রিকশাকে অবশ্যই নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে। ঢাকার মধ্যে উত্তর-দক্ষিণ আলাদা রং করা যেতে পারে রিকশায়।