
মো: আবু সাঈদ
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আগত জাতীয় নির্বাচন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়। এই নির্বাচন শুধু একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে না, বরং দেশের গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়ন যাত্রার গতিপথও নির্ধারণ করবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো, নির্বাচন কমিশন, এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মন্তব্য থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য পর্যন্ত—সবকিছুই এই পরিস্থিতির জটিলতাকে তুলে ধরে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি, জনগণের আস্থাহীনতা, রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা এবং সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি সামগ্রিক বিশ্লেষণ করা যায়। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, যার প্রধান দায়িত্ব হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা। তবে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে বরাবরই বিতর্ক রয়েছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচন কমিশনের যথেষ্ট প্রস্তুতি আছে, কারণ তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো মাত্র তিন মাস নয়, বরং দীর্ঘ সময় পেয়েছে, তবুও কিছু বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) প্রথমে বলেছিলেন যে নির্বাচনের বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা তিনি পাননি। যা কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি করেছিল। পরে অবশ্য প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে একটি চিঠি পাওয়ার পর প্রস্তুতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়। যদিও নানান কারণে বিষয়টি কিছুটা সন্দেহজনক মনে হতে পারে, তবুও নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সংস্থা হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব পালনে সক্ষম, এমনটাই আশা করা যায়।
তবে, নির্বাচন কমিশনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার আর আস্থার জায়গা তৈরি করা। তাদের হাতে পর্যাপ্ত সময়, জনবল এবং বাজেট থাকা সত্ত্বেও যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহযোগিতা ও সমঝোতা না থাকে, তাহলে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা কঠিন হবে। কমিশনের অধীনে পুরো প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা থাকলেও, তাদের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশনকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাদের আইনি ক্ষমতা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। যাতে কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব বা অনিয়ম সহ্য করা না হয়।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসিরউদ্দিনের মন্তব্য, "নির্বাচনি সিস্টেমের ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। তাদের আবার ভোট কেন্দ্রে ফিরিয়ে আনা বড় কাজ হবে", বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার একটি সঠিক চিত্র। এই আস্থাহীনতার মূল কারণগুলো হলো:
• ভোট কারচুপি ও সহিংসতা: গত কয়েক দশকে দেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে ভোট কারচুপি, জোরপূর্বক ভোট প্রদান, এবং কেন্দ্রে সহিংসতার ঘটনা সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে রাতের আঁধারে ভোটগ্রহণের অভিযোগ ভোটারদের মধ্যে গভীর হতাশা তৈরি করেছে।
• প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব: সিভিল প্রশাসন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব আস্থাহীনতার আরেকটি বড় কারণ। ভোটাররা অনেক সময় মনে করেন, প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে না। যার ফলে তাদের ভোট দেওয়া বা না দেওয়া একই কথা।
• ভোটের আগেই ফলাফল নির্ধারণ: অনেক ক্ষেত্রে ভোটের আগেই ফলাফল পূর্বনির্ধারিত বলে গুজব ছড়ায়, যা ভোটারদের ভোট দিতে নিরুৎসাহিত করে।
• প্রার্থীদের প্রতি অনাস্থা: রাজনৈতিক দলগুলো অনেক সময় জনগণের পছন্দের প্রার্থীকে মনোনয়ন না দিয়ে এমন কাউকে দেয়, যাদের ওপর জনগণের আস্থা থাকে না।
এই আস্থাহীনতা দূর করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে:
১. স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা: নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে এবং কোনো ধরনের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সহ্য করা যাবে না।
২. প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিরপেক্ষতা: প্রশাসনকে কঠোর নির্দেশনা দিতে হবে, যাতে তারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করে। আইন অমান্যকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি: নির্বাচন কমিশন ও নাগরিক সমাজের যৌথ উদ্যোগে জনগণের মধ্যে ভোটের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
৪. ভোট কেন্দ্রে নিরাপত্তা: ভোটারদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং সহিংসতা রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দারের মন্তব্য, "আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ না হলে দেশে গৃহযুদ্ধ হতে পারে", দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির গভীরতা তুলে ধরে। তার এই মন্তব্যে 'সব দল' বলতে তিনি আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি—উভয়কেই আমলে নিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়া দেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
তবে, তার এই 'গৃহযুদ্ধ' তত্ত্ব নিয়ে ভিন্নমতও রয়েছে। অনেকে মনে করেন অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে প্রধান দলগুলোর অনুপস্থিতিতে নির্বাচন হলেও দেশে গৃহযুদ্ধ বাঁধেনি। বরং কিছু বিচ্ছিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। তবে এটিও অস্বীকার করার উপায় নেই যে একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতিতে নির্বাচন হলে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।
আওয়ামী লীগ সদ্য ক্ষমতাচ্যুত হলেও তাদের একটি বিশাল ভোটব্যাংক রয়েছে। অন্যদিকে, বিএনপি তাদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দাবির ওপর অনড়। এই দুই প্রধান দলের মধ্যে যদি সমঝোতা না হয়, তাহলে আসন্ন নির্বাচন একটি অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে। ব্যারিস্টার শামীম হায়দার হয়তো পরোক্ষভাবে উভয় দলকেই একটি বার্তা দিয়েছেন যে, পারস্পরিক সমঝোতা ছাড়া শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্ভব নয়।
অপর দিকে নির্বাচনের সময় পুলিশ, র্যাব এবং সেনাবাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ সদর দপ্তরের একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত, যেখানে মাঠ পর্যায়ের এসআই ও এএসআইদের রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাওয়া হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সমালোচকদের মতে, এটি একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। বিগত ১৫-১৬ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার বহু পুলিশ নিয়োগ দিয়েছে। যদি তাদের আদর্শের অনুসারীদের বাদ দিয়ে নির্বাচন করানো হয়, তাহলে একটি বিশাল সংখ্যক পুলিশ সদস্যকে নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে বাদ দিতে হবে। যা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।
অপরদিকে, সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়েও আলোচনা চলছে। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, নির্বাচনে সরকারকে সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হবে। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রায়ই উত্তেজনা থাকে, সেখানে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি। সেনাবাহিনী ছাড়া ভোটগ্রহণ তো দূরের কথা, পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়াই শুরু করা সম্ভব নয়।
এত কিছুর পরও যদি দেশে একটি নির্বাচন হয়ে তাহলে নতুন সরকার কেমন হতে পারে তা নিয়েও মানুষের মধ্যে কৌতুলহ আছে। তবে আমি মনে করি নির্বাচন পরবর্তী সরকার কেমন হবে, তা নিয়ে এখনই নিশ্চিতভাবে কিছু বলা কঠিন। কারন-১) যদি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (Proportional Representation) পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়, তাহলে কোনো একক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না এবং জোট সরকার গঠন করতে হবে। ২) এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি কোনোভাবে যুক্ত হয়, তাহলে রাজনৈতিক সমীকরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে। তাদের একটি নির্দিষ্ট ভোটব্যাংক এবং পরীক্ষিত মিত্র দল রয়েছে, যা তাদের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারে। ৩) কিছু আলোচকের মতে, বিদেশী শক্তির স্বার্থ এবং তাদের হস্তক্ষেপও নির্বাচন পরবর্তী সরকারের গতিপথ নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে, এটাও বলা যায় যে, নির্বাচনের পর সরকার যেভাবেই গঠিত হোক না কেন, দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আইনের শাসন এবং জনগণের প্রতি তাদের দায়িত্ববোধের ওপর। যদি দলগুলো কেবল নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাহলে দেশে আবার অস্থিরতা ফিরে আসতে পারে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা গেছে, যখনই গণতন্ত্রের পথে বাধা এসেছে, জনগণ রাস্তায় নেমে এসেছে।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি, জনগণের আস্থাহীনতা, রাজনৈতিক দলগুলোর অনমনীয়তা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকা—সবকিছুই একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথে চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। তবে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব যদি সকল অংশীজন, অর্থাৎ রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন এবং জনগণ—সদিচ্ছা নিয়ে কাজ করে। একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই পারে দেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে এবং জনগণের হারানো আস্থা ফিরিয়ে আনতে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ কোন পথে যাবে? এর উত্তর নির্ভর করছে আগত জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলের ওপর।
লেখক:মো: আবু সাঈদ; ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক;