
তুরাগ থেকে মনির হোসেন জীবন
রাজধানীর অভিজাত ও জনবহুল এলাকার নাম উত্তরা-তুরাগ থানা এলাকা। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের উত্তরার আব্দুল্লাহ, টঙ্গী ও উত্তরায় ফ্লাইওভার উড়াল সড়কে দিবারাত্রি প্রকাশ্যে চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, খুন, অপহরণ ও মাদক বেচাকেনাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটছে। এতে করে এ পথে চলাচলরত পরিবহন যাত্রী ও সাধারণ মানুষ অনেকটাই আতঙ্কে থাকেন। সড়ক ও মহাসড়কে অনেক সময় ছিনতাইকারীদের বাঁধা দিতে গিয়ে ধারালো ছুরি-চাপাতির আঘাতে মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তারমধ্যে নতুন করে আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে হানিট্র্যাপ। মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে যৌনতার ফাঁদে ফেলে প্রতারণা ও ছিনতাইয়ের অহরহ অভিযোগ পাওয়া গেছে। উত্তরা বিভাগের বিভিন্ন এলাকাতে হানিট্র্যাপ আতঙ্কে ভুগছে নগরবাসী।
সূত্র জানায়, যৌনতা বা শারীরিক সম্পর্কের প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে প্রতারণা বা ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটছে। এ চক্রের সাথে সংঘবদ্ধ একাধিক নারীও জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের টার্গেট পুরুষ পথচারী। টার্গেট করা ব্যক্তিকে চক্রের অন্য সদস্যদের সহযোগিতায় ধাপে ধাপে ফাঁদে ফেলে এক পর্যায়ে জিম্মি করে সর্বস্ব লুটে নেয় অপরাধী চক্রের সদস্যরা। গাজীপুরে চান্দনা চৌরাস্তায় সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে কুপিয়ে হত্যা, টঙ্গীর চেরাগ আলী বাসস্ট্যান্ড, স্টেশন রোড, টঙ্গী বাজার, টঙ্গী ব্রিজ, উত্তরার আব্দুল্লাহ বাসস্ট্যান্ড, হাউজ বিল্ডিং, বিএনএস সেন্টার, আজমপুর, রাজলক্ষ্মী, জসিমউদদীন রোড ও বিমানবন্দর উড়ালপথ সড়কে খুন, ঘুম, অপহরণ, প্রকাশ্যে মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারযোগে ছিনতাই ঘটনার পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে হানিট্র্যাপ গ্রুপ। হানিট্র্যাপ গ্রুপের হাতে বলি শিকার হন দৈনিক প্রতিদিনের কাগজের স্টাফ রিপোর্টার নিহত আসাদুজ্জামান তুহিন।
গতকাল সোমবার বিকেলে টঙ্গী ও উত্তরার স্থানীয় এলাকাবাসী এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সময় সুযোগ বুঝে তারা টার্গেট করে বিভিন্ন জেলা থেকে আগত সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে পথচারীদের হানিট্র্যাপে ফেলে সবকিছু লুটে নিয়ে কৌশলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যাচ্ছে। দেশের দূরদূরান্ত থেকে বহু নারী-পুরুষও প্রতিদিন কয়েক লাখ মানুষ ঢাকায় আসা যাওয়া করে। দিনের বেলা টানা পার্টি চক্র সক্রিয় রয়েছে।
একটি নির্ভরশীল সূত্র বলছে, ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও এয়ারপোর্ট বিমানবন্দর মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে টানা পার্টির সদস্যরা ভ্যানিটি ব্যাগ, পার্স, মানিব্যাগ, কানের দুল, গলার চেইন ইত্যাদি নিয়ে ভিড়ের মধ্যে মিশে যায়। তবে এ সংঘবদ্ধ চক্রের প্রধান টার্গেট হলো মোবাইল ফোন। রাস্তায় কেউ পায়ে হেঁটে ফোনে কথা বলতে বলতে চলার সময় বা বাস কিংবা ট্রেনে বসে ফোনে কথা বলার সময় জানালা দিয়ে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায় এসব চক্রের সদস্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখের সামনে প্রতিদিনই এ ধরনের অহরহ ঘটনা ঘটেই চলেছে। তবে আইনি জটিলতাসহ নানা কারণে ভুক্তভোগীদের অনেকেই পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমান সময়ে হানিট্র্যাপ চক্রের ভয়ংকর গ্রুপের সাথে জড়িত রয়েছে কয়েক ডজন সুন্দরী তরুণী। এছাড়া এ গ্রুপের অনেকেই নাকি নেশায় আসক্ত। এ সংবদ্ধ চক্রের সদস্য যদি কারও কাছে টাকা বা মূল্যবান কিছু পত্র দেখে ফেলে; তখন তারা ওই লোককে টার্গেট করে পিছু নেয়। টার্গেট করা ব্যক্তিকে এসব তরুণীকে দিয়ে ফাঁদে ফেলে মারধর করে মানিব্যাগসহ সঙ্গে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যায়।
এদিকে তুরাগ, উত্তরা ও গাজীপুরের টঙ্গী এলাকাবাসীর অভিযোগ, ছিনতাইকারীও নানাবিধ অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য ও অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে এসব এলাকাগুলো। প্রশাসনের চোখের সামনে ছিনতাইকারী, ডাকাত, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা ঘুরে বেড়ায়। পুলিশ মাঝেমধ্যে তাদের গ্রেপ্তার করে। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই জামিনে বেরিয়ে এসে ফের পূর্বের পেশায় ফিরে আসে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, হানিট্র্যাপের মাধ্যমে ছিনতাইয়ের এ চক্রটির মূল হোতা কে-টু মিজান। তার বিরুদ্ধে খুন, চাঁদাবাজি, মাদকসহ কম হলেও ১৫টি মামলা রয়েছে। তার স্ত্রী পারুল আক্তার ওরফে গোলাপীও একই চক্রের সদস্য। গত শনিবার আদালতে নেওয়ার সময় আসামি কে-টু মিজান সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা নাটক-সিনেমা-ছবি করেন, আর আমি করি রিয়েল। গাজীপুরে কে-টু মিজান গড়ে তোলেন এক ‘অপরাধ সাম্রাজ্য’। চক্রের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিল নিজেরই স্ত্রী গোলাপী। নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করত ছিনতাইকারী চক্র। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক এ চক্রের সদস্যরা হলো- মো. স্বাধীন (২৮), আল আমিন (২১), শাহ জালাল (৩২), ফয়সাল হাসান (২৩), সাব্বির সুমন (২৬) এবং শহীদুল ইসলাম প্রমুখ । তাদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় হত্যা, ধর্ষণ, মাদক, ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধারায় ২৯টি মামলা রয়েছে।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার রবিউল হাসান গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তায় সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যাকাণ্ডের পর নিরাপত্তা বলয় আগের চেয়ে জোরদার করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের সিসিটিভি ক্যামেরা লাগাতে বলা হয়েছে উল্লেখ করে পুলিশের এ কর্মকর্তা আরো বলেন, দ্রুত অপরাধী ধরতে ও শনাক্ত করতে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো ও সার্বক্ষণিক পুলিশের কুইক রেসপন্স টিম থাকবে। এছাড়া ছিনতাইকারীসহ নানাবিধ অপরাধীদের গ্রেপ্তারে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত আছে।
উত্তরা ডিএমপি’র উত্তরা বিভাগের পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. মুহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, উত্তরা বিভাগে চুরি, ছিনতাইসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আগের চেয়ে কমেছে। ইতিমধ্যে ২৫০ জনেরও বেশি ছিনতাইকারী, চোরসহ অসংখ্য অপরাধীকে আটক করে আদালতে পাঠানো হয়েছে।