
রাজধানীর শাহবাগে ছাত্রদল ও শহীদ মিনারে এনসিপির সমাবেশ, অন্যদিকে একটি শিল্পীগোষ্ঠীর অনুষ্ঠান, পাশাপাশি এইচএসসি পরীক্ষা, তারসঙ্গে রয়েছে সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস। সব মিলিয়ে বেহাল রাজধানী ঢাকাজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র যানজট ও চরম ভোগান্তি। এতে বিপাকে পড়েছেন নগরবাসী। গতকাল রোববার বেলা আড়াটাই রাজধানীর শাহাবাগে শুরু হয় ছাত্রদলের ‘ছাত্র সমাবেশ’, যা শেষ হয় সন্ধ্যা ৬টায়। এছাড়া সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদের’ দাবিতে জনসমাবেশ করেছে এনসিপি। আর সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘জুলাই জাগরণ’ অনুষ্ঠান করেছে। এ অবস্থায় শাহবাগ-বাংলামোটর-সায়েন্স ল্যাব, নীলক্ষেত-আজিমপুর, মিরপুর রোড, গুলিস্তান, প্রেসক্লাব-পল্টন, মতিঝিল-খিলগাঁও, মালিবাগ-মগবাজারসহ আশপাশের এলাকায় ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়।
সরেজমিন দেখা যায়, ছাত্রদলের সমাবেশকে কেন্দ্র করে কাঁটাবন মোড়, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড় এবং মৎস্যভবন মোড়ে যানবাহন চলাচল করছে ধীর গতিতে। উল্লেখিত এই রাস্তাগুলো থেকে মূলত শাহবাগের দিকে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। তাই যাত্রী-পথচারীদের ঘুরে যেতে হচ্ছে অন্য রাস্তা দিয়ে। এতে করেই ধীরগতি চলে আসে সড়কে। তবে শাহবাগের বারডেম হাসপাতালের সামনের রাস্তায় বাস বা অন্যান্য যানবাহন না চললেও রিকশা চলাচল করতে পারছে। এতে করে হাসপাতালে আসা মানুষেরা রিকশা করে মৎস্যভবন বা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়ে যেতে পারছে। এছাড়া ফার্মগেট কাওরান বাজার, বাংলামটর, সায়েন্স ল্যাব, মিরপুর রোডের বিভিন্ন পয়েন্টে যানবাহনের চাপ দেখা গেছে। প্রেস ক্লাব, গুলিস্তানের দিকেও যানজট রয়েছে। এদিন যাত্রীর চাপ বাড়ায় গণপরিবহণের সংকটে অনেককে প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে বাসে উঠতে দেখা গেছে। কর্মজীবী মানুষ, অফিসগামী যাত্রী ও পরীক্ষার্থীরা সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে হিমশিম খেয়েছেন। গাড়ি না পেয়ে অনেকে পায়ে হেঁটেই গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হতে দেখা গেছে। এতে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কথা হয় বেসরকারি চাকরিজীবী চমং উ মারমা বলেন, দুপুরের দিকে অফিস ছিল। অন্যান্য দিনের মতো একই সময়ে বাসা থেকে বের হয়েছিলাম। কিন্তু, বাস পাওয়া যাচ্ছিল না। সঙ্গে বৃষ্টি তো রয়েছে। খুব কষ্ট করে অফিসে এসেছি। আসাদগেটে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করা যাত্রী বাদল মিয়া গণমাধ্যমে বলেন, কয়েকটা বাস সামনে দিয়ে গেল। ভেতরের ওঠার মতো পরিস্থিতি দেখলাম না। এদিন বেলা সাড়ে ১২টার দিকে আব্দুর রহমান নামে এক পথচারী বলেন, ৯টার আগে কেরানীগঞ্জ থেকে কল্যাণপুর যাওয়ার উদ্দেশ্যে অফিস থেকে বের হয়েছি। এখন সাড়ে ১২টা বাজে, শাহবাগ পার হতে পারিনি। সংসদ ভবন স্টেশন থেকে মেট্রোরেলে উঠার চেষ্টা করেও উঠতে পারিনি। তিনি বলেন, পরে পায়ে হেঁটে গন্তব্যের দিকে রওনা দিয়েছি। সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে এমন রাজনৈতিক প্রোগ্রাম কাম্য নয়। এছাড়া ঢাকা শহরে অনেক বড় বড় মাঠ আছে সেখানেও রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে সমাবেশ করতে পারতেন। কিন্তু সবাই রাস্তা বন্ধ করে সমাবেশ করছে। কাঁটাবন মোড়ে মোটরসাইকেল আরোহী আরিফ হোসেন বলেন, সায়েন্সল্যাব থেকে কাঁটাবন মোড়ে আসছি ২০ মিনিটে। বাইকে এই রাস্তায় এই সময় লাগেই না। আজ সমাবেশ বলে রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। তাই গাড়ি চাপ বেশি। বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা হাসান উদ্দিন বলেন, সকালে ডাক্তার দেখাতে আসছিলাম শনিরআখড়া থেকে। কিন্তু এখন রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। তাই রিকশা নিয়ে মৎস্যভবন যেতে হবে। না হলে সরাসরি এখান থেকেই বাসে উঠতে পারতাম। গাড়িতে উঠতে না পেরে আসাদগেট থেকে হেঁটেই কাওরান বাজারে দিকে রওনা হন ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, গাড়ির জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছি। গাড়িও কম আবার ভিড়ও, তাই অপেক্ষা না করে হেঁটে রওনা দিলাম। সেখানে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করা আরেক যাত্রী সাইমন মিয়া বলেন, কয়েকটা বাস সামনে দিয়ে গেলো। ভেতরের ওঠার মতো পরিস্থিতি দেখলাম না। গুলিস্থান যাবো। না পেলে হেঁটে ভেঙে ভেঙে যেতে হবে। মালিবাগগামী মিঠু নামের আরেক যাত্রী বলেন, বারডেমে আমার আত্মীয় ভর্তি। গাড়িতে উঠেছি অনেক কষ্টে, কিন্তু গাড়ি একদম চলছে না। সড়কে প্রচণ্ড চাপের প্রভাব পড়ে মেট্রোরেলেও। ফার্মগেট, পল্লবী, মিরপুরসহ বিভিন্ন স্টেশনে যাত্রীদের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। ফার্মগেট স্টেশনে টিকিটের জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রী আসিফ আলী বলেন, রাস্তায় জ্যাম দেখে মেট্রো ধরলাম। কিন্তু এখানে এসেও দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। আরেক যাত্রী শাহীন আলম জানান, মেট্রোরেলের দুটি ট্রেন মিস করেছি। এত যাত্রী কখনো দেখিনি।
মিডলাইন বাসের সহকারী ইমরুল কায়েস মিয়া বলেন, প্রায় ৪০ মিনিট ধরে হাইকোর্টের মোড়ে একই জায়গায় বসে আছি। কোনো গাড়ি সামনে এগোচ্ছে না। সব গাড়ি এক জায়গায় থেমে গেছে। মোটরসাইকেল আরোহী হামিদুল ইসলাম জানান, মতিঝিল থেকে মৎস্য ভবন মোড় পর্যন্ত আসতেই সময় লেগেছে ৪৫ মিনিট। যেখানে অন্যসময় লাগে ১৫ মিনিটেরও কম। সাধারণ মানুষ এ ভোগান্তির অবসান চায়। পুলিশের ওপর তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে সিএনজি অটোরিকশাচালক শামীম ইসলাম বলেন, প্রায় প্রতিদিনই আন্দোলনে রাস্তা বন্ধ থাকছে। আমাদের মতো মানুষ যারা দিন আনি দিন খাই তাদের তাহলে কী অবস্থা হয়, একটু ভাবেন। আন্দোলনে রাস্তা বন্ধ থাকায় ইনকামও কমে গেছে। পুলিশের উচিত এসব আন্দোলন বন্ধ করে রাস্তা স্বাভাবিক রাখা। তবে শাহবাগ ট্রাফিক জোনের পরিদর্শক তারিকুল আলম সুমন জানান, শাহবাগ মোড়ের উত্তর সিগনালের ঠিক মাঝখানে একটি বিশাল মঞ্চ তৈরি করায় চারদিকে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। তিনি বলেন, একটি ক্রসিংয়ের মাঝে মঞ্চ তৈরি করার আগে ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত ছিল। তবে শহরের অন্যান্য অংশে ট্রাফিক পরিস্থিতি ছিল নিয়ন্ত্রণে।
লালবাগ ট্রাফিক বিভাগের ডিসি মোফিজুল ইসলাম বলেন, আমার এলাকার যান চলাচল এখনো স্বাভাবিক রয়েছে। কোথাও যানজট তৈরি হয়নি। তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) শামীমা সুলতানা জানান, বাংলামোটর থেকে শাহবাগ রুটে যান চলাচল কিছুটা ধীরগতির হলেও সামগ্রিক ট্রাফিক পরিস্থিতি বেশ স্বাভাবিক। রমনা ট্রাফিক বিভাগের ডিসি শফিকুল ইসলাম বলেন, যান চলাচল এখনো স্বাভাবিক রয়েছে। তবে কোথাও যাতে যানজট না হয়, সেজন্য ইন্টারকন্টিনেন্টাল, মৎস্য ভবন ও কাটাবন মোড়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অতিরিক্ত নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।