
* নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ‘ইশতেহার’ প্রত্যাশা এনসিপি নেতাকর্মীদের
জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতিতে ২৪টি বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়ে নতুন বাংলাদেশের ইশতেহার ঘোষণা করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। গতকাল রোববার বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশে ইশতেহার ঘোষণা করেন দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। এর আগে নাহিদ ইসলাম বলেন, ঐতিহাসিক ১ দফা কোনো ব্যক্তির পক্ষ থেকে নয়, কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকে নয়, কোনো দলের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়নি। সেদিন ১ দফা ঘোষণা করা হয়েছিল বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে। বাংলাদেশের অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে। ফলে ১ দফার প্রকৃত ঘোষক হলেন বাংলাদেশের জনগণ, বাংলাদেশের অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতা এবং শহিদ ভাইবোনেরা।
এনসিপির ঘোষণা করা ইশতেহারগুলো হলো-১.নতুন সংবিধান ও সেকেন্ড রিপাবলিক। ২.জুলাই অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি ও বিচার। ৩. গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কার। ৪. ন্যায়ভিত্তিক বিচারব্যবস্থা ও আইন সংস্কার। ৫. সেবামুখী প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন। ৬. জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ৭. গ্রাম পার্লামেন্ট ও স্থানীয় সরকার। ৮. স্বাধীন গণমাধ্যম ও শক্তিশালী নাগরিক সমাজ। ৯. সর্বজনীন স্বাস্থ্য। ১০. জাতিগঠনে শিক্ষানীতি। ১১. গবেষণা, উদ্ভাবন ও তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব। ১২. ধর্ম, সম্প্রদায় ও জাতিসত্তার মর্যাদা। ১৩. নারীর নিরাপত্তা, অধিকার ও ক্ষমতায়ন। ১৪.মানবকেন্দ্রিক ও কল্যাণমুখী অর্থনীতি। ১৫. তারুণ্য ও কর্মসংস্থান। ১৬. বহুমুখী বাণিজ্য ও শিল্পায়ন নীতি। ১৭. টেকসই কৃষি ও খাদ্য সার্বভৌমত্ব। ১৮. শ্রমিক-কৃষকের অধিকার। ১৯. জাতীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনা। ২০. নগরায়ন, পরিবহন ও আবাসন পরিকল্পনা। ২১. জলবায়ু সহনশীলতা ও নদী-সমুদ্র রক্ষা। ২২. প্রবাসী বাংলাদেশির মর্যাদা ও অধিকার। ২৩. বাংলাদেশপন্থী পররাষ্ট্রনীতি। ২৪. জাতীয় প্রতিরক্ষা কৌশল।
কেউ বাধা দিলে পিছু হটবেন না, নেতাকর্মীদের হাসনাত: জাতীয় নাগরিক কমিটির (এনসিপি) নেতাকর্মীদের এলাকায় এলাকায় বাধা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন দলটির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, কেউ বাধা দিলে পিছু হটবেন না। তিনি বলেন, দীর্ঘ এক বছর ধরে আমরা কথা বলছি। এখন আমাদের কাজ করার সময়। আমাদের আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব পরবর্তী দিক-নির্দেশনা দেবেন। সে অনুযায়ী আমরা নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ করবো। নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এখানে যারা আমাদের নেতাকর্মী আছেন কেউ যদি ভয় দেখায়, বাধা দেয়, আপনারা পিছু হটবেন না। আমরা জানি, এলাকায় এলাকায় এনসিপি নেতাকর্মীদের বাধা দেওয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, টেকেনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাটুরিয়া এনসিপির একটা নেতকার্মীর দিকে কেউ যদি চোখ তুলে তাকায়, আমরা তাকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিল করবো। আমাদের আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব পরবর্তী সময়ে দিক-নির্দেশনা দেবেন। আমরা জীবন দিয়ে হলেও তা বাস্তবায়ন করবো।
মুজিববাদী সংবিধান আর রাখতে চাই না: জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেছেন, আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, বাহাত্তরের সংবিধান একটা দলের ছিল। যে সংবিধান আরেকটা দেশ থেকে পাস হয়ে এসেছে। এই মুজিববাদী সংবিধান আর বাংলাদেশে থাকতে দিতে পারি না। আমরা আজ এই মঞ্চে মুজিববাদী সংবিধান ভেঙেচুরে শেষ করে দিয়ে নতুন সংবিধান চাইতে এসেছি। তিনি বলেন, ২৩ বছরে পাকিস্তান শাসনে ছিলাম, অধিকার পাইনি। ৫৪ বছরেও দেশেও অধিকার পাইনি। আজ থেকে এক বছর আগে আমরা এই শহীদ মিনারে ছিলাম। এদিন হাসিনার পতনের ডাক এসেছিল। এক বছর হয়ে গেছে আজও আমাদের অধিকার পাইনি। আমরা আর হতাশার কথা শুনতে চাই না। সারজিস আলম বলেন, এক বছর আগে এই শহীদ মিনারে যারা ছিল, তাদের অনেকে আজ শহীদ। তাদের পরিবার এখানে আছে। আমরা এই শহীদ ভাইদের হত্যার বিচার চাইতে এসেছি। আমরা এই সরকারের কাছে মৌলিক সংস্কারের নিশ্চয়তা চেয়েছি। শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন ও আহত যোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিশ্চিত করতে এখানে এসেছি। তিনি বলেন, আমাদের লড়াই ২৪ এর নয়। বিডিআর হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছে, ১৩ সালে শাপলা চত্বরে যারা নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদের বিচার চাইতে এসেছি। এই বাংলাদেশে যেমন জঙ্গিবাদ মেনে নেব না, তেমনি জঙ্গি নাটকও মেনে নেব না। এই বাংলাদেশে সিভিল সোসাইটি নামে সব দালালকে আর মেনে নেব না।
এক বছরেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিরাপদ হয়ে ওঠেনি: জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেছেন, গত এক বছরেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিরাপদ হয়ে ওঠেনি। তারপরও বলছি এনসিপি লড়বে দেশের মানুষের ন্যায়বিচারের জন্য। তিনি বলেন, এক বছর পার হয়েছে কিন্তু হত্যাকাণ্ডের এখনো বিচার হয়নি। যারা দীর্ঘদিন ধরে গুম ছিল তাদের কাছে আমরা ক্ষমা চাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, আমরা এমন একটি রাষ্ট্র স্বপ্ন দেখেছিলাম যে রাষ্ট্র যাবে পরিবর্তনের দিকে। জুলাইয়ের পরও আমরা কুমিল্লার মুরাদনগরে ট্রিপল মার্ডারের ঘটনা দেখেছি। আমরা বলেছিলাম আওয়ামী লীগ শাসনামলে যারা নির্যাতিত হয়েছে, অত্যাচারিত হয়েছে, যারা গুম হয়েছে আমরা তার বিচার করতে পারিনি। তিনি বলেন, গত বছর এই দিনে আমরা যে স্বপ্ন দেখেছি সে স্বপ্নের সারথি হয়েছিল পুরো জাতি।
‘বাংলার ইয়াজিদ’ শেখ হাসিনাকে বিচারের আওতায় আনবোই: জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেছেন, ‘বাংলার ইয়াজিদ’ শেখ হাসিনাকে বিচারের আওতায় আনবোই। তার বিচার নিশ্চিত না করে আমরা থামবো না। তিনি বলেন, শহীদ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ও আহতদের পরামর্শে চলছে এনসিপি। শহীদদের আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল মানুষের কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকার আদায়ের জন্য। আমরা চাই বাংলাদেশে সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করেছে। বিদেশি সংস্কৃতি টেনে এনেছে। যে সংস্কৃতিতে আমাদের দেশের মাইজদী, আব্দুল করিম বা আব্দুল আলিমের কথা নেই। আগামীতে আমরা দেশি সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। সামান্তা শারমিন বলেন, দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে চাই। যেখানে কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের কথা উচ্চকিত করতে চাই। তিনি বলেন, ৬৪ জেলা সফরে গিয়ে মানুষের আকাক্সক্ষার কথা জেনেছি। আমাদের শরীরে এখনও পর্যন্ত প্রান্তিক মানুষের ভালোবাসার ছোঁয়া রয়েছে। আশা করি একটি নতুন বন্দোবস্ত বাস্তবায়ন করতে পারবো।
নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ‘ইশতেহার’ প্রত্যাশা এনসিপি নেতাকর্মীদের: ‘নতুন বাংলাদেশের ইশতেহার’ ঘোষণা করতে যাচ্ছে জাতীয় নাগরিক কমিটি (এনসিপি)। সে লক্ষ্যে রোববার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করছে সংগঠনটি। এদিন বিকাল ৪টায় আনুষ্ঠানিক সমাবেশ শুরুর কথা থাকলেও যথাসময়ে শুরু করতে পারেনি। নতুন বাংলাদেশের ইশতেহারে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের রূপরেখা ও নির্দেশনা থাকবে এমন প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন সমাবেশে যোগ দেওয়া নেতাকর্মীরা।
মোহাম্মদপুর থেকে আসা এনসিপির সমর্থক নাহিদ হাসান বলেন, ৩ আগস্টেও আমরা শহীদ মিনারে এসেছিলাম। আজ এক বছর পর তাদের রাজনৈতিক দলের ডাকেই শহীদ মিনারে এসেছি। যেহেতু গণঅভ্যুত্থান ছিল ফ্যাসিস্ট সরকার ও সিস্টেমের বিরুদ্ধে, তাই নতুন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রত্যাশা আমাদের। নাহিদ ইসলাম যে নতুন বাংলাদেশের ইশতেহার ঘোষণা করতে যাচ্ছেন, তাতে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের বার্তা থাকবে, এটায় প্রত্যাশা। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ইশরাক বলেন, আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ চাই। চাঁদাবাজিমুক্ত, গুম-খুনমুক্ত, ঘুষমুক্ত, নাগরিক অধিকারের বাংলাদেশ। আজকের সমাবেশ থেকে নতুন বাংলাদেশের ইশতেহারে সেই রূপরেখা থাকবে আশা করছি।
এদিকে পূর্বঘোষিত বিকাল ৪টার আগেই সমাবেশস্থলে বৃষ্টি উপেক্ষা করে জড়ো হতে শুরু করেন এনসিপির নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। ছোট ছোট মিছিল নিয়ে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকেও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের ব্যানারে নেতাকর্মীদের আসতে দেখা গেছে। তাদের হাতে জাতীয় পতাকা ও এনসিপি লেখা পতাকা শোভা পাচ্ছে। কেউ কেউ মাথায় বেঁধেছেন জাতীয় পতাকা। এছাড়া মঞ্চে থেমে থেমে চলে কবিতা আবৃত্তি ও বক্তৃতা।