
* গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র জনতার প্রত্যাশা পূরণে ছাত্রদলের ৯ দফা প্রতিশ্রুতি
* গুপ্তগোষ্ঠীর প্রোপাগাণ্ডা মোকাবিলা করেই আমাদের বছর পার: ছাত্রদল সভাপতি
স্টাফ রিপোর্টার
তারুণ্যের প্রথম ভোট, ধানের শীষের জন্য হোক বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গতকাল রোববার রাজধানীর শাহবাগে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের মাসব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে আয়োজিত ছাত্র-সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন। তবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেছেন, আমরা একটি গুপ্তগোষ্ঠীর বিভিন্ন প্রোপাগাণ্ডা মোকাবিলা করেই পথ চলছি, একটি বছর পাড়ি দিয়েছি। এই এক বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদলের দ্বারা কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা হয়নি। ২৪ এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা পূরণের ৯ দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।
শাহবাগে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের মাসব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে আয়োজিত ছাত্র-সমাবেশে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, গত দেড় দশকে ৪ কোটির বেশি নতুন ভোটার ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সামনে জাতীয় নির্বাচন। এবার তোমাদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়ার সময়। ধানের শীষ প্রতীকে প্রথম ভোট হবে তোমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার। তিনি বলেন, চলো আজ আমরা সবাই একসঙ্গে প্রতিজ্ঞা করি আমাদের প্রথম ভোট হবে বাংলাদেশ পুনর্গঠনের জন্য। আমাদের প্রথম ভোট হবে শহীদদের রক্তের মর্যাদা রাখার জন্য। আমাদের প্রথম ভোট হোক ধানের শীষের জন্য। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আরও বলেন, এই দেশের ছাত্রসমাজই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। তোমরাই গড়ে তুলবে শহীদদের স্বপ্নের সেই বাংলাদেশ। তিনি বলেন, শুধু রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, আমাদের প্রয়োজন শিক্ষিত, দক্ষ, প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন একটি প্রজন্ম, যারা জ্ঞান ও মানবিকতা দিয়ে দেশকে নেতৃত্ব দেবে। ছাত্রদলের হাজারো নেতাকর্মী জেল, নির্যাতন, খুন-গুম এবং হামলার শিকার হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে শতাধিক ছাত্রদলকর্মী শহীদ হয়েছেন, গ্রেফতার হয়েছেন দুই হাজারেরও বেশি। কিন্তু এই ত্যাগ বৃথা যাবে না। তারেক রহমান বলেন, ভবিষ্যতের শিক্ষানীতিতে আমরা চাই স্কুল থেকেই ব্যবহারিক ও কারিগরি শিক্ষার সংযোগ, যেন একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় শেষে চাকরির জন্য পথে বসে না থেকে নিজের দক্ষতা দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। তিনি বলেন, বিএনপি পরিকল্পনা করছে স্কুল পর্যায়ে আইটি, ডেন্টাল হাইজিন, মেডিকেল টেকনিশিয়ান ও অন্যান্য কারিগরি শিক্ষা চালু করার। এর পাশাপাশি থাকবে একাধিক ভাষা শিক্ষার সুযোগ ইংরেজির পাশাপাশি আরবি, জার্মান, ফরাসি, জাপানি ও চীনা ভাষা শেখার সুযোগ থাকবে। বিএনপির এই শীর্ষ নেতা বলেন, আজকের তরুণ প্রজন্মের জন্য দেশের প্রতিটি জেলায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প স্থাপনে সহায়তা করা হবে, যেন তারা নিজেরাই উদ্যোক্তা হয়ে অন্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে বিশ্বমানের ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে প্রবেশের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি। ফ্রিল্যান্সাররা বৈদেশিক মুদ্রায় আয় করলেও অনেকেই তা দেশে আনতে পারছেন না এ সমস্যা সমাধানে বিএনপি সরকার গঠন করলে আন্তর্জাতিক লেনদেন নিরাপদ করতে জরুরি নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে বলে আশ্বাস দেন তারেক রহমান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক গৌরব ফিরিয়ে আনতে হলে গবেষণার পরিবেশ, আবাসন সংকট এবং খাবারের মান উন্নয়ন জরুরি। আমরা চাই প্রতিটি ক্যাম্পাস হোক নিরাপদ ও মুক্ত চিন্তার স্থান।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গ্লোবালাইজেশনের সুযোগ কাজে লাগাতে বিএনপি একাধিক ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করতে চায় বলে জানান তারেক রহমান। তিনি বলেন, বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি আরবি, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, জাপানি শেখার সুযোগ সৃষ্টি হবে। তারেক রহমান বলেন, একজন শিক্ষার্থীর জন্য একাধিক ভাষাজ্ঞান তাকে কর্মসংস্থানে এগিয়ে রাখবে। আমরা চাচ্ছি ছাত্র-ছাত্রীদের এমনভাবে তৈরি করতে যেন তারা বিশ্বে যেখানেই যাক না কেন, সহজেই টিকে থাকতে পারে। শিক্ষার্থীদের নিরাপদ ও মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে তিনি বলেন, লাইব্রেরিগুলোকে অনলাইন-অফলাইন উভয় প্ল্যাটফর্মে আধুনিকায়ন করতে হবে। হলগুলোর আবাসন ও খাবারের মান বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, শিক্ষায় খরচ নয়, এটি রাষ্ট্রের বিনিয়োগ।
ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিবের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছিরের সঞ্চালনায় সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, ড. আসাদুজ্জামান খান রিপন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, হাবিব উন নবী খান সোহেল, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, ছাত্রদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি আবু আফসান মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, সাংগঠনিক সম্পাদক আমান উল্লাহ আমান প্রমুখ বক্তৃতা করেন।
এদিকে জুলাই ছাত্র সমাবেশে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেছেন, আমরা একটি গুপ্তগোষ্ঠীর বিভিন্ন প্রোপাগাণ্ডা মোকাবিলা করেই পথ চলছি, একটি বছর পাড়ি দিয়েছি। এই এক বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদলের দ্বারা কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা হয়নি। সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে রাকিবুল ইসলাম রাকিব আরও বলেন, তারেক রহমানের নির্দেশনা মোতাবেক আমরা সর্বোতভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এই শাহবাগে ৭ জুলাই যেদিন বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালিত হয়েছিল, সেই কর্মসূচির অগ্রভাগে নেতৃত্ব দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলসহ ঢাকার সব ইউনিটের নেতৃবৃন্দ। তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটি গঠিত হওয়ার পর থেকে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, শাহবাগ নয়- বরং সারা বাংলাদেশে আন্দোলনের অগ্রভাগে নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রদল। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার পর ছাত্রদল তাদের পাশে থেকেছে। তারেক রহমানই সর্বপ্রথম এক দফার ঘোষণা দিয়েছেন। এসময় হুঁশিয়ারি দিয়ে ছাত্রদল সভাপতি বলেন, যে বা যারা জুলাই আগস্টের খণ্ডিত চিত্র এবং মনগড়া ইতিহাস রচনা করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন-আমরা সেসব ইতিহাসবেত্তাদের বলতে চাই, এই ইতিহাসবেত্তাদের ইতিহাসে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করা হবে। ছাত্রলীগের বিচারের দাবি জানিয়ে ছাত্রদল সভাপতি বলেন, ডাকসুসহ সব ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রদল অবশ্যই অংশগ্রহণ করবে। কিন্তু তার আগে আমাদের প্রধান দাবি ছিল ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করা, তালিকা প্রকাশ করা এবং বিচারের আওতায় নিয়ে আসা। কিন্তু শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নামকাওয়াস্তে একটা তালিকা প্রকাশ করে এক বছর অতিবাহিত করেছে তারা। এ সময় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদলের ভূমিকা উল্লেখ করে তিনি ছাত্রদলের যারা গুমের শিকার হয়েছেন তাদের সন্ধান দাবি করেন। পাশাপাশি এক বছরেও তাদের সন্ধানে সরকারের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ না থাকায় এর নিন্দা জানান।
এসময় ২৪ এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা পূরণের ৯ দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। গতকাল রোববার জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রাজধানীর শাহবাগে আয়োজিত সমাবেশে এই ৯ দফা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ছাত্রদলের ৯ দফা প্রতিশ্রুতি হলো- ১. শিক্ষাঙ্গনে গেস্টরুম নির্যাতন, গণরুম সংস্কৃতি, জোরপূর্বক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে বাধ্য করে এবং রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের মতো ঘৃণিত চর্চার স্থায়ী বিলোপসাধন এবং সব ধরনের সন্ত্রাস ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে ছাত্রদল সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। ২. ক্যাম্পাসে ও আবাসিক হলে প্রশাসন কর্তৃক শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ আবাসন, পুষ্টিকর খাদ্য, বাসযোগ্য কক্ষ এবং পড়াশোনার উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ছাত্রদল প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। ৩. ধর্ম, বর্ণ, জাতিসত্তা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব বাংলাদেশি নাগরিকের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি জনকল্যাণমুখী, পরমতসহিষ্ণু, উদার এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে ছাত্রদলের প্রতিটি নেতাকর্মী নিবেদিত থাকবে। শিক্ষাক্ষেত্রে এবং রাষ্ট্র গঠনের সব পর্যায়ে নারীর সমান অংশগ্রণ নিশ্চিত করতে এবং নারীদের জন্য শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে ছাত্রদল জোরালো উদ্যোগ নেবে। ৪. স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বার্থের সুরক্ষা এবং জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, আধিপত্যবাদবিরোধী এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী চিন্তার সন্নিবেশনে রাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশপন্থি সর্বজনীন শিক্ষানীতি ও পাঠক্রম প্রণয়নের লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে ছাত্রদল। ৫. বেকারত্ব দূর করতে রাষ্ট্রকর্তৃক কর্মমুখী ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে ছাত্রদল জোরালো উদ্যোগ নেবে। পাশাপাশি সব শিক্ষার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সব ধরনের একাডেমিক এবং চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস রোধ এবং এসব পরীক্ষাব্যবস্থাকে দুর্নীতি ও জালিয়াতিমুক্ত করতে ছাত্রদল সোচ্চার ভূমিকা পালন করবে। ৬. মাদকমুক্ত ক্যাম্পাস এবং মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে ছাত্রদল অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। ৭. ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৬৯, ১৯৭৫ এর ৭ নভেম্বর, ১৯৯০ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভাবধারার সাংস্কৃতিক চর্চা বেগবান করার লক্ষ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলবে ছাত্রদল। ৮. শিক্ষাঙ্গনগুলোতে শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিতভাবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিশ্চিত করতে ছাত্রদল জোরালো ভূমিকা রাখবে। ৯. বাংলাদেশে যেন আর কখনও ঘৃণ্য ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচার গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে না পারে, সে লক্ষ্যে ছাত্রদল সদা সোচ্চার থাকবে এবং একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার, ভোটাধিকার ও সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা নিশ্চিত করতে ছাত্রদল আপামর ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে নিরন্তরভাবে কাজ করে যাবে।