
প্রতিনিয়ত সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে হয় জুলাইয়ের অভ্যুত্থান কিংবা মাইলস্টোনের মতো ভয়াবহ মৃত্যু, বীভৎস ঘটনা ও দৃশ্যের ট্রমা ও স্ট্রেসের। হামলা হুমকির পাশাপাশি ব্যক্তিগত থেকে পেশাগত জীবনের নানা অস্থিরতায় মনের ওপর চাপ বাড়ে। কিন্তু শারীরিক ক্ষতের চিকিৎসা করলেও মনের ক্ষত গোপনে পুষে রাখেন অনেকেই। তাই দুর্যোগ, দুর্ঘটনা, পেশাগত কিংবা ব্যক্তিগত যেকোনো কারণে সদস্যদের বিপর্যস্ত মনের স্বাস্থ্য পুনর্গঠনে সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্য শক্তিশালী করতে পাক্ষিক বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা ‘খোলা জানালা’ কার্যক্রম চালু করেছে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)। গতকাল মঙ্গলবার ডিআরইউ-এর শফিকুল কবির মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘খোলা জানালা’ এ কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
উদ্যোগটির অংশ হিসেবে, প্রতি ১৫ দিন অন্তর ডিআরইউ প্রাঙ্গণে সদস্য সাংবাদিকদের জন্য গোপনীয়, পেশাদার ও সম্মানজনক পরিবেশে সাইকোলজিস্ট ও সাইকিয়াট্রিস্ট দ্বারা বিনামূল্যে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করা হবে। এই সেবা প্রদান করবেন আন্তর্জাতিক মানের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী সংস্থা ‘মনের বন্ধু’-এর প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ পেশাজীবীরা।
ডিআরইউ সভাপতি আবু সালেহ আকনের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল’র সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান, বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ‘মনের বন্ধু’র হেড অব মেন্টাল হেলথ প্রোগ্রাম এবং লিড সাইকোলজিস্ট কাজী রুমানা হক ও স্কুল অব লিডারশিপ নির্বাহী পরিচালক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ড. জামিল আহমেদ। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যুগ্ম সম্পাদক নাদিয়া শারমিন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ডিআরইউ’র সাবেক সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা ও মুরসালিন নোমানী, বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটির সহ-সভাপতি গাযী আনোয়ার, সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল হাই তুহিন। অনুষ্ঠানে জুলাই ও মাইলস্টোন কভার করা সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে বৈশাখী টিভির সিনিয়র রিপোর্টার ও ডিআরইউ-এর সাবেক দপ্তর সম্পাদক মেহ্দী আজাদ মাসুম, দৈনিক সংগ্রামের সিনিয়র রিপোর্টার নাছির উদ্দিন শোয়েব এবং নিউজ ২৪ এর সিনিয়র রিপোর্টার রিশাদ হাসান তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
স্বাস্থ্য সচিব মো. সাইদুর রহমান বলেন, অনেক বাচ্চা মাইলস্টোনের পর অস্বাভাবিক আচরণ করছে। শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সাংবাদিকসহ যারা ট্রমাটাইজ তাদের কাছে আমাদের পৌঁছাতে হবে। লাশ গোপনের কোনো সুযোগ নেই। সবাই সবার পাশে থাকব। কাক্সিক্ষত দেশ গড়তে আপনাদের সহযোগিতা খুব জরুরি। একই সঙ্গে সাংবাদিকদের বুদ্ধিভিত্তিক চর্চার জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকার প্রয়োজন। ডিআরইউ’র এই আয়োজনকে সাধুবাদ জানান এবং সাংবাদিকদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পাশে থাকবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ডিআরইউ সভাপতি আবু সালেহ আকন বলেন, হাঁসের মতো সাংবাদিকদের সব দুঃখ, ভয়, সমস্যা ঝেড়ে ফেলতে হবে। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধে বিশ্বাসী হতে হবে। প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে কর্ম পরিবেশ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফিরিয়ে আনতে হবে।
সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল বলেন, বছরব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনার অংশ হিসেবে এই আয়োজন। এর আগে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের টিকা ফ্রি দেওয়া হয়েছে। করোনার সময় বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারিভাবে করোনা বুথ স্থাপনসহ ডেন্টাল, ডায়াবেটিস, গাইনি, মেডিসিন, কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সেবা ক্যাম্প চালু রেখেছে ডিআরইউ। এছাড়া সদস্যদের সেবাদানের জন্য খুব শিগগিরই হেলথ কর্নার, জরুরি সেবাদানে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, নারী সদস্য ও সন্তানদের জরায়ু ক্যান্সারের টিকা এবং সদস্যদের নিউমোনিয়ার টিকা প্রদানের আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। এই সেবা কার্যক্রমের আহ্বায়ক ও যুগ্ম সম্পাদক নাদিয়া শারমিন বলেন, আমরা সাংবাদিকরা অন্যের কণ্ঠস্বর হই, কিন্তু নিজেদের মানসিক যুদ্ধের কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে যায়। ‘খোলা জানালা’ সেই অন্ধকার দূর করার একটি সাহসী উদ্যোগ। ‘খোলা জানালা’ কার্যক্রমের উদ্দেশ্য: সাংবাদিকদের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করা, ট্রমা, উদ্বেগ, বিষণ্নতা, অনিদ্রা ইত্যাদি সমস্যা মোকাবেলায় সহায়তা, পেশাগত মানসিক স্থিতি ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। এছাড়া সহানুভূতিশীল ও সহায়ক সাংবাদিকতা সংস্কৃতি গড়ে তোলা। ডিআরইউ মনে করে-এই ‘খোলা জানালা’ মানসিক স্বাস্থ্যসেবার উদ্যোগটি শুধুমাত্র একটি সেবা নয়, এটি সাংবাদিকদের মানসিক সুস্থতাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার একটি প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ। এটি দেশের অন্যান্য সাংবাদিক সংগঠন ও গণমাধ্যম সংস্থার জন্যও একটি মডেল হিসেবে কাজ করবে। পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ট্যাবু ভেঙে সাংবাদিক সমাজে সচেতনতা ও সহানুভূতির নতুন সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আগত প্রধান ও বিশেষ অতিথিদের ক্রেস্ট দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়। এরপর অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় ধাপে ‘মনের বন্ধু’র লিড সাইকোলজিস্ট কাজী রুমানা হক, সাংবাদিকদের সাথে মানসিক স্বাস্থ্য শক্তিশালী করার পদ্ধতি নিয়ে একটি কাউন্সেলিং সেশন পরিচালনা করেন। সেখানে নিজ নিজ দুঃখ, হতাশ, ট্রমার কথা নিয়ে আলোচনা করে উত্তরণের পথ খোঁজেন সাংবাদিকরা। অনুষ্ঠানে কার্যনির্বাহী কমিটির ক্রীড়া সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান, আপ্যায়ন সম্পাদক মোহাম্মদ ছলিম উল্লাহ (মেজবাহ), কল্যাণ সম্পাদক রফিক মৃধা ও কার্যনির্বাহী সদস্য সুমন চৌধুরীসহ সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।