এখনও থমথমে গোপালগঞ্জ। দিন-রাত অজানা আতঙ্কে বাসিন্দারা। সহিংসতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার সাথে চলছে কারফিউ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গ্রেফতার হয়েছেন ৪৫ জন। হামলাকারীদের ধরতে নৌপথে টহল জোরদার করেছে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী। গ্রেপ্তার আতঙ্ক ও কারফিউয়ের কারণে ব্যাবসায়ীরা ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। ফল ও কাঁচামাল ব্যবসায়ীরা পণ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় উদ্বেগে আছেন। অন্যদিকে, পোশাকসহ অন্যান্য দোকানদাররাও বিক্রি বন্ধ থাকায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
গতকাল শুক্রবার সকাল ১১টা থেকে ৩ ঘণ্টা শিথিল ছিল কারফিউ। এরপর দুপুর ২টা থেকে আবার কারফিউ শুরু হয়েছে। দুপুরের পর আবার পুলিশ ও এপিবিএন সদস্যদের শহরের বিভিন্ন সড়কে টহল দিতে দেখা গেছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কর্মসূচিতে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষের পর বুধবার রাত ৮টা থেকে কারফিউ জারি করা হয় গোপালগঞ্জ শহরে। সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত মোট ৫ জন নিহত হয়েছেন। হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এখন পর্যন্ত ৪৫ জনকে আটক করেছে যৌথবাহিনী। গোপালগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মির মো. সাজেদুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। আটকদের আদালতের মাধ্যমে জেলা কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
গোপালগঞ্জের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্রেপ্তার আতঙ্ক ও কারফিউয়ের কারণে তারা ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। ফল ও কাঁচামাল ব্যবসায়ীরা পণ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় উদ্বেগে আছেন। অন্যদিকে, পোশাকসহ অন্যান্য দোকানদাররা বিক্রি বন্ধ থাকায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
লঞ্চঘাট এলাকার ফল ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বলেন, ‘কারফিউয়ে দোকান খুলতে না পারায় ৩ দিনে প্রায় ২৫-৩০ হাজার টাকার ফল নষ্ট হয়েছে। বুধবার সকাল ১০টার দিকে পুলিশের পরামর্শে দোকান বন্ধ করি। আজ সকালে কারফিউ শিথিল হলে ১১টার পর একবার খুলেছি। অনেক ফল নষ্ট হয়ে গেছে।
পাবলিক হল রোডের কাপড় ব্যবসায়ী কাজী শামীম হোসেন বলেন, ‘বুধবার সকালের পর থেকে দোকান বন্ধ। তিনদিনে সাধারণত ৫০-৬০ হাজার টাকার কাপড় বিক্রি হয়। পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও সময় লাগবে।
কারফিউ শিথিল হলে সকাল ১১টার পর চৌরঙ্গী এলাকায় প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে আসা জিল্লুর রহমান বলেন, ‘গত দুই দিন বাসা থেকে বের হতে পারিনি। দরকারি কেনাকাটা ছিল। সেজন্য বের হলাম। কারফিউ শিথিল হলেও পথে লোকজন কম। সবার চোখে-মুখে এক ধরনের ভয়।
এ সময় বিভিন্ন সড়কে কিছু রিকশা, ইজিবাইক চলাচল করতে দেখা যায়। তবে সংখ্যা ছিল অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশ কম।
পুলিশ ও এপিবিএন সদস্যদের দেখা গেলেও সেনাবাহিনীর কোনো টহলযান দেখা যায়নি।
গোপালগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রুহুল আমিন সরদার বলেন, শহরের পরিস্থিতি এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে। কারফিউ চলাকালে যেন কোনো দোকানপাট খোলা না থাকে, তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষকে কোনো ধরনের হয়রানি করা হচ্ছে না।॥
এদিকে গতকাল শুক্রবার দুপু?রে নৌবা?হিনীর দা?য়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লেফ?টেন?্যান্ট সাজ্জাদ ও কোস্টগার্ড মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হারুন-অর-রশীদ জানান গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর হামলার ঘটনায় করা মামলার আসামিদের ধরতে নদীপথে টহল জোরদার করেছে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী।
।তারা বলেন, গত বুধবার (১৬ জুলাই) গোপালগঞ্জে এনসিপি নেতাদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও আসামিদের ধরতে যৌথবাহিনীর অভিযান চলছে। দুষ্কৃতকারীরা যাতে নদীপথে পালিয়ে যেতে না পারে, সেজন্য গোপালগঞ্জ জেলার নদীপথে বিশেষ টহল দেওয়া হচ্ছে।
এ টহলে কোস্টগা?র্ডের দুটি বোট ও নৌবা?হিনীর এক?টি বোট অংশ নি?য়েছে বলেও জানান তিনি।
এছাড়া নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যৌথবাহিনীর সদস্যরা দিনরাত টহল চালিয়ে যাচ্ছে। সন্দেহভাজন নৌযানগুলোতে তল্লাশি, যাত্রীদের পরিচয় যাচাই ও সন্দেহজনক গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে ব?লে জানান তারা। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গত বুধবার গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশ ঘিরে ব্যাপক সহিংসতা ও নাশকতা চালান ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এমনকি গোপালগঞ্জ কারাগারেও হামলার ঘটনা ঘটে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইলে তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান দলটির ক্যাডাররা। এতে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গোপালগঞ্জ শহর। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গোপালগঞ্জে ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন। মাঝখানে কয়েক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে গত বুধবার রাত ৮টা থেকে কারফিউ বহাল রয়েছে।
এনসিপির পূর্বঘোষিত পদযাত্রা ও সমাবেশের আয়োজন ছিল গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্কে। এ নিয়ে সেখানে সার্বিক প্রস্তুতির পাশাপাশি সমাবেশ মঞ্চ তৈরি করা হয়। কিন্তু আগের দিন রাত থেকেই আওয়ামী লীগের লোকদের এনসিপির কর্মসূচি পণ্ড করতে অনলাইন-অফলাইনে সংগঠিত হতে দেখা যায়।
এর মধ্যে সকালে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নে টহলরত পুলিশের গাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন দেয় নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ালের সমর্থকেরা।
এরপর সদর উপজেলার কংশুর এলাকায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) গাড়িবহরে হামলা ও ভাঙচুর করে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা। দুপুরে গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্কে এনসিপির সমাবেশের মঞ্চ ভাঙচুর করে এবং ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এ উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে এনসিপির নেতা-কর্মীরা সেখানে যায় এবং সমাবেশ করেন। কিন্তু সমাবেশ শেষে বেরিয়ে যাওয়ার পথে শহরের লঞ্চঘাট এলাকায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা আবার এনসিপির গাড়িবহরে হামলা চালায়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে হামলাকারীদের ধাওয়া-পালটা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলী?গের লোকেরা। তখন অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা। এসময় অনেক সাংবাদিকও অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মাঠে নামে সেনাবাহিনী। পরে গোপালগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রহরায় বের হয় এনসিপির নেতাদের গাড়িবহর। মাদারীপুরের নির্ধারিত সমাবেশ স্থগিত করে নেতারা চলে যান খুলনায়।
এ ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে পাঁচজনের। এতে আহত হন পুলিশ-সাংবাদিকসহ অর্ধশতাধিক মানুষ। এদিকে এ ঘটনায় গোপালগঞ্জ জেলা রি?পোর্টার্স ফোরা?মের অফিসে হামলা চালান আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের লোকেরা। এতে যমুনা টি?ভির সি?নিয়র স্টাফ রি?পোর্টার মোজাম্মেল হো?সেন মুন্না ও ডি?বি?সি টে?লি?ভিশ?নের রি?পোর্টার সুব্রত সাহা বা?পিসহ অনেক সাংবা?দিক আহত হ?ন।
তাদেরসহ এ ঘটনায় আহত অনেককে গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতা?লে নেওয়া হ?য়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ফাঁকা গু?লি ছুড়ে প?রি?স্থি?তি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে।
জুলাই মাসজুড়ে জেলায় জেলায় পদযাত্রা করছে কেন্দ্রীয় এনসিপি। এরই অংশ হিসেবে আজ তারা গোপালগঞ্জে লং মার্চ ও সমাবেশ করেন।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

* ৩ ঘণ্টা শিথিলের পর আবার কারফিউ বিপাকে গোপালগঞ্জের ব্যবসায়ীরা * হামলাকারীদের ধরতে নৌপথে টহল জোরদার করেছে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী * এখন পর্যন্ত ৪৫ জনকে আটক করেছে যৌথবাহিনী
গোপালগঞ্জে গ্রেফতার আতঙ্ক ক্ষতির মুখে ব্যবসায়ীরা


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ