
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি
জনমনে বাড়ছে আস্থাহীনতা
- আপলোড সময় : ১৫-০৭-২০২৫ ০৪:৫০:৪৬ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৫-০৭-২০২৫ ০৪:৫০:৪৬ অপরাহ্ন


* ঘর থেকে বের হয়ে ভয়ে দিশেহারা সাধারণ মানুষ
* চাঁদাবাজি, ছিনতাই, খুন ও অপহরণে বেড়েছে আতঙ্ক
* আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তায় জনমনে ক্ষোভ
* পরিস্থিতি উন্নয়নে কঠোর পদক্ষেপের আহ্বান অপরাধ বিশেষজ্ঞদের
* সশস্ত্র বাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতার মেয়াদ ২ মাস বাড়ল
রাজধানীসহ সারাদেশে বেপরোয়া চাঁদাবাজি, গণছিনতাই, খুন, অপহরণ ও মব সৃষ্টি করে পিটিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, চুরি, ডাকাতি ও দস্যুতাসহ সব ধরনের অপরাধ বেড়েছে। রীতিমতো আতঙ্ক তৈরি করেছে খোদ রাজধানীতে। সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই দেখা যাচ্ছে ভীতিকর ভিডিও’র দৃশ্য। ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। দেশীয় অস্ত্র দিয়ে কোপানোর ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে। চলন্ত বাসে ডাকাতি ও ছিনতাই করে ফেলে দেয়ার ঘটনা উদ্বেগ তৈরি করেছে নতুন মাত্রা। পুরান ঢাকায় চাঁদার দাবিতে প্রকাশ্যে পিটিয়ে ব্যবসায়ী সোহাগকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাসহ সবমিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে চারদিকে। জনমনে বাড়ছে সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের প্রতি আস্থাহীনতা ও অসন্তোষ। একের পর এক মব ভায়োলেন্স বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক বা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রহস্যজনক নিষ্ক্রিয়তায় অপরাধ বাড়ছে বলে মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সশস্ত্র বাহিনীকে দেয়া বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতার মেয়াদ আরও দুই মাস বাড়িয়েছে সরকার।
সূত্র জানায়, গত রোববার সন্ধ্যা ৭টার দিকে খুলনার ৪নং ঘাট এলাকা থেকে পুলিশ পরিচয়ে খাদ্য পরিদর্শক সুশান্ত কুমার মজুমদারকে পুলিশ পরিচয়ে অপহরণ করে সন্ত্রাসীরা। তাকে তুলে নিয়ে সন্ত্রাসীরা মুক্তির জন্য পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করে। অপরহণের ঠিক ৫ ঘণ্টা পর রোববার রাত সাড়ে ১২টার দিকে তেরখাদা উপজেলার আজগড়া বিআরবি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে হাত, পা ও চোখ বাধা অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়। অপহরণের শিকার সুশান্ত কুমার মজুমদার খাদ্য পরিদর্শক পদে খুলনার ৪নং ঘাট ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত আছেন। এ ঘটনায় খাদ্য বিভাগের ওই কর্মকর্তার স্ত্রী মাধবী রানী মজুমদার খুলনা সদর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
স্থানীয়রা জানান, গত রোববার সন্ধ্যায় নগরীর ৪নং ঘাট এলাকার নাসিমার চায়ের দোকান থেকে কয়েকজন ব্যক্তি খাদ্য কর্মকর্তা সুশান্ত কুমার মজুমদারকে চাঁদার দাবিতে অপহরণ করে। এ সময় অপহরণকারীরা নিজেদের পুলিশ পরিচয় দেয়।
খুলনা সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাওলাদার সানওয়ার হুসাইন মাসুম জানান, অপহরণের পরপর খুলনা সদর থানা পুলিশ অভিযান শুরু করে। পুলিশের অভিযানে আতঙ্কিত হয়ে অপহরণকারীরা তাকে তেরখাদা উপজেলার আজগড়া গ্রামের বিআরবি উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে হাত-পা ও চোখ বাঁধা অবস্থায় ফেলে রেখে যায়। সেখানকার পুলিশের সহয়তা নিয়ে তাকে উদ্ধার করা হয়। থানায় এনে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পরে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
গত বুধবার সন্ধ্যায় পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল চত্বরে শতাধিক লোকের সামনে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে (৩৯) দেশীয় অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে, পিটিয়ে ও পাথর ছুড়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হত্যার পর মরদেহের ওপর চলে নৃশংস উন্মত্ততা। এ হত্যাকাণ্ডের পুরো দৃশ্য ধরা পড়ে সিসিটিভি ফুটেজে। ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন ব্যক্তি সোহাগকে প্রথমে নির্মমভাবে মারধর করে, পরে কুপিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। এরপর দুই যুবক তার নিথর দেহ রাস্তায় টেনে নিয়ে এসে একের পর এক লাথি, ঘুষি ও বুকের ওপর লাফিয়ে বর্বরতা চালায়। পরে তার মাথা ও শরীরের ওপর ছোড়া হয় বড় বড় পাথর। ঘটনার সময় শত শত মানুষ আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। এমনকি হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত আনসার সদস্যরাও নীরব ছিলেন। আতঙ্কে সবাই নৃশংস দৃশ্য দেখলেও কেউ বাধা দেয়নি। নিহতের পরিবার দাবি করেছে, সোহাগকে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে তার দোকান থেকে ডেকে নেওয়া হয়। প্রতিপক্ষ একটি গ্রুপ তার ব্যবসায় আধিপত্য চাচ্ছিল এবং নিয়মিত চাঁদা দাবি করছিল। সোহাগ রাজি না হওয়ায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অপারেশনস) এস এন নজরুল ইসলাম বলেন, ভিডিও দেখে আমরা শিউরে উঠেছি। এ ধরনের উগ্রতা সমাজের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, বাকিদের ধরতে অভিযান চলছে।
অপরদিকে গত শনিবার বিকেল পৌনে ৫টার দিকে দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার দক্ষিণ বাসুদেবপুর মালেপাড়া এলাকায় বাবুল হোসেন (৩২) নামের এক যুবককে বাড়ি থেকে ডেকে এনে পিটিয়ে হত্যা করেছে কয়েকজন যুবক। নিহত বাবুল হোসেনের বাড়ি পৌর শহরের চুড়িপট্টি এলাকায়। তিনি পেশায় একজন ভ্রাম্যমাণ বই বিক্রেতা ছিলেন। দক্ষিণ বাসুদেবপুর মালেপাড়া এলাকার রাব্বী হোসেনের বাড়ি থেকে টাকা ও স্বর্ণালংকার চুরির অভিযোগ তুলে রাব্বী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ। এ সময় বিজয় কুমার নামে বাবুলের এক সহযোগীকেও মারধর করা হয়। এ ঘটনায় অভিযুক্ত রাব্বীর শাশুড়ি রিনা পারভীন (৫২) ও মামা জিয়া মণ্ডলকে (৪২) গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ঘটনার পর রাব্বী হোসেন ও তার স্ত্রী মিম আক্তার পালিয়ে যান। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহত বাবুলের মা মমেনা খাতুন থানায় মামলা করেছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে।
গত ১ জুন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার জামাল ইউনিয়নের বিএনপি নেতা মহব্বত হোসেন ও ইউনুছ আলী খুন হন। বিএনপির স্থানীয় দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত হন এ দুই ভাই। পুলিশ সদর দফতরের তথ্য বলছে, সারা দেশে গড়ে প্রতিদিন ১১ জন মানুষ খুন হচ্ছেন। গত মাসে মুরাদনগরের ধর্ষণ ও ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। সব মিলিয়ে দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে অস্বস্তি বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্রিয়তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। অপরাধীদের ভয়ে এগিয়ে আসছেন না সাধারণ জনগণও। এতে জনমনে তৈরি হওয়া উদ্বেগ ও ক্ষোভ দুটোরই প্রকাশ দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারা দেশে ১ হাজার ৯৩০ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে খুন হন ২৯৪ জন। ফেব্রুয়ারিতে খুনের সংখ্যা বেড়ে হয় ৩০০। পরের মাসে খুনের সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। মার্চে সারা দেশে ৩১৬ জন খুন হয়েছেন। এপ্রিলে ৩৩৬ জন, মে মাসে ৩৪১ জন খুন হন। জুনে চলতি বছরের সর্বোচ্চ খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ মাসে সারা দেশে মোট ৩৪৩ জন খুন হয়েছেন। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এ বছরে প্রতি মাসেই খুনের ঘটনা বাড়ছে। বেশি খুন হচ্ছে ঢাকা মেট্রোপলিটন, ঢাকা রেঞ্জ ও চট্টগ্রাম রেঞ্জে। অনেক খুনের পেছনে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের মতো ঘটনা কাজ করেছে বলে জানা যাচ্ছে। যার সর্বশেষ উদাহরণ পুরান ঢাকায় ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যাকাণ্ড। বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন এ খুনের ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে মিছিল-সমাবেশ করেছে।
খুনের পাশাপাশি সারা দেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ডাকাতি, ছিনতাই, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং অপহরণের মতো অপরাধও সংঘটিত হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারা দেশে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৩৬৬টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭৪টি ডাকাতি হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে। এছাড়া এ ছয় মাসে ১১ হাজার ৮টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে গত এপ্রিলে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী ও পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য এএসএম নাসির উদ্দিন এলান। তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা যে অর্জনটা করেছিলাম তার মধ্যে এখন একটা পলিটিক্যাল দুর্বৃত্তায়ন ঢুকে গেছে। এ উত্তাপেই মূলত এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ ধরনের সংকট নিরসনে সরকারকে কঠোর হতে হবে। দলমত নির্বিশেষে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। কাউকে ছাড় দেয়া যাবে না। এছাড়া দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না।
পুরান ঢাকায় সোহাগ হত্যাকাণ্ডের ঠিক দুইদিন পর ১১ জুলাই শুক্রবার খুলনা দৌলতপুর থানা যুবদলের সাবেক সহসভাপতি মাহবুবুর রহমান মোল্লাকে গুলি করে ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের সংশ্লিষ্টতা পাচ্ছে পুলিশ। মাহবুবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে খুলনা মহানগর পুলিশের (কেএমপি) উপকমিশনার (উত্তর) মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে আমরা প্রাথমিকভাবে মনে করছি।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এসএন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, মিটফোর্ডের ঘটনাটি চরম নৃশংসতার বহিঃপ্রকাশ। অপরাধীর কোনো দলীয় পরিচয় নেই। তার পরিচয় একটাই, সে অপরাধী। অপরাধ করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অপরাধের গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে বলে মনে করেন সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ। তিনি বলেন, রাজনীতিবিদ বলি বা চিন্তক বলি সবাই একটা কথা বলেন যে পলিটিক্যাল কালচার একটা বড় বিষয়। বিগত সময়ে চারটা কেয়ারটেকার সরকার আমরা দেখেছি। তখন কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর হতে চললেও এখনো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এমন পরিস্থিতিতে আমার মনে হয় নির্বাচন দিয়ে রাজনৈতিক সরকার গঠনের বিকল্প নেই। যত দ্রুত সম্ভব একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করে জনগণের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী একটি সরকার গঠন করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়া যেতে পারে।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস) ইনামুল হক সাগর বলেন, অপরাধ প্রতিরোধে পুলিশ আন্তরিকভাবে কাজ করছে। উপরন্তু যদি কোনো অপরাধ সংঘটিত হয় পুলিশ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত ঘটনাগুলোয় পুলিশ প্রকৃত অপরাধীদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে। অপরাধ প্রতিরোধে এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে আমাদের কোনো ধরনের কার্পণ্য নেই। এক্ষেত্রে কোনো ছাড় নয়। তাছাড়া সামাজিক ও পারিবারিক অস্থিরতা থেকে বেরিয়ে আসাটা খুবই জরুরি। পুলিশের পাশাপাশি পরিবার ও সমাজের সব সচেতন নাগরিকের উচিত এ বিষয়ে ভূমিকা রাখা। পারস্পরিক সহনশীলতা, ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতার কোনো বিকল্প নেই বলে আমরা মনে করি। পাশাপাশি সমাজে যদি কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে, তাহলে আইন নিজের হাতে না নিয়ে পুলিশকে জানানো উচিত। আমরা তাৎক্ষণিক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
এদিকে সিরাজগঞ্জের কামারখন্দে হাজেরা খাতুন (৭) নামে এক শিশুকন্যাকে হত্যার পর বস্তায় ভরে খাটের নিচে রেখে পালানোর অভিযোগ উঠেছে সৎমায়ের বিরুদ্ধে। গত রোববার দুপুরে এ ঘটনা ঘটে। রাত ৯টার দিকে পুলিশ বস্তাবন্দি অবস্থায় লাশ উদ্ধার করে। শিশু হাজেরা খাতুন উপজেলার কুটিরচর এলাকার হারুনার রশিদের মেয়ে ও প্রথম শ্রেণির ছাত্রী। রাজধানীর উত্তরার হাউজ বিল্ডিং, আব্দুল্লাহপুর ও টঙ্গী ফ্লাইওয়াবের উপরে বাসের যাত্রীদের অস্ত্রেরমুখে জিম্মি করে ‘সবাই চুপ, যা আছে বের করে দে’ এ বলেই ছিনতাইকারী কজন বাসের যাত্রীর কাছ থেকে চোখের পলকে ফোন ও ওয়ালেট নিয়ে যায়। জাস্ট দুই মিনিটের মধ্যেই চোখের সামনে এসব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। প্রকাশ্যে দিনের বেলা রাজধানীর উত্তরায় ব্যস্ত সড়কে চলন্ত বাসে গণছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া পোস্টে দাবি করেছেন অনেকই। গত ৯ জুলাই রাতে টঙ্গী আব্দুল্লাহপুর ফ্লাইওভারের ব্রিজে ছিনতাইকারীদের ছুরির আঘাতে মাহফুজ নামের এক কলেজ ছাত্র নিহত হয়। এ ঘটনার চারদিন পর র্যাব-১ এর সদস্যরা টঙ্গীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে চার ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করেছে। গত রোববার র্যাব সদস্যরা জানান। গ্রেফতারকৃতরা হলো মো. রাফসান জনি রাহাত (২৮), মো. আক্তার আহম্মেদ পলাশ (২৩), মো. রাশেদুল ইসলাম (২০) ও রাকিব ইসলাম (১৬)। র্যাব জানায়, আব্দুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ডে গত বৃহস্পতিবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হাতেম আলী কলেজের ছাত্র মো. মাহফুজুর রহমান নির্মমভাবে হত্যাকান্ডের শিকার হন। ছিনতাইকারীদের ছুরির কাঘাতে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় থানায় একটি মামলা হয়েছে। এইভাবে প্রতিদিন রাজধানীতে বেপরোয়া হয়ে উঠছে ছিনতাইকারীরা। বেড়েই চলেছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারি করেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ছিনতাইকারীদের। প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে অভিনব ছিনতাইয়ের কৌশল। এমনই ভয়াবহ এক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর শ্যামলীতে। এ ঘটনার একটি সিসিটিভি ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, ছিনতাইকারীরা ভুক্তভোগী যুবকের সঙ্গে থাকা সব কিছু কেড়ে নেওয়াসহ ভুক্তভোগীর গায়ের পোশাক ও পায়ের জুতাও খুলে নিচ্ছেন। গত ১২ জুলাই শনিবার শেরে বাংলানগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমাউল হক বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তবে এ ঘটনায় এখনো থানায় কোনো অভিযোগ জমা পড়েনি। ইমাউল হক বলেন, ছিনতাইয়ের ঘটনায় এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কোনো ধরনের অভিযোগ জমা পড়েনি। তবে আমরা সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ছিনতাইকারীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে, গত শুক্রবার ভোর ৬টার দিকে শ্যামলী ২ নম্বর রোডে অবস্থিত কাজী অফিসের দিক থেকে ছাতা হাতে এক ব্যক্তিকে হেঁটে যেতে দেখা যায়। এসময় তার পেছন দিক থেকে একটি মোটরসাইকেলে আসতে দেখা যায় তিনজনকে। ভুক্তভোগীর কাছে এসে মোটরসাইকেলের পেছনের ব্যক্তি নেমে পড়েন। বাকি দুজন মোটরসাইকেলটি ইউটার্ন নিয়ে ভুক্তভোগীর সামনে এসে অবস্থান নেন। এসময় চালকের পিছে থাকা অন্য ছিনতাইকারীও নেমে পড়েন। অভিযুক্ত তিন ছিনতাইকারীর মধ্যে দুজনকে হেলমেট পরিহিত অবস্থায় এবং একজনকে খালি গায়ে দেখা গেছে। পরে দুই ছিনতাইকারী ভুক্তভোগীর কাছে থাকা টাকাসহ সবকিছু ছিনিয়ে নেন। এসময় তাদের হাতে থাকা ধারালো অস্ত্র দিয়ে ভুক্তভোগীকে ভয় দেখানো হয় এবং তার জামা ও জুতা খুলে নিতেও দেখা গেছে। ছিনতাই শেষে মোটরসাইকেলে চেপে তিন ছিনতাইকারীকে আবারও কাজী অফিসের দিকে পালিয়ে যেতে দেখা যায়।
তবে রাত যত গভীর হয়, রাজধানীর সড়কে কমতে থাকে যানবাহন। এই সুযোগে বেপরোয়া হয়ে ওঠে ছিনতাইকারীরা। তারা মোটরবাইক ও প্রাইভেট কার নিয়ে দাপিয়ে বেড়ায় শহরের বিভিন্ন সড়ক-অলিগলি। এ সময় তাদের শিকার হয় রিকশাযাত্রী বা পথচারীরা। কখনও অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ছিনিয়ে নেয় টাকা, মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান সামগ্রী। আবার কখনও ছোঁ মেরে নিয়ে যায় ব্যাগ। এমন কর্মকাণ্ড চলে ভোর অবধি। তারপর আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আড়ালে চলে যায় ছিনতাইকারীরা।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছর দেশে ৪৮১টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৩৪৫ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। গত ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গণমাধ্যমে ২ হাজার ৫২৫টি নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৫১৬টি, শিশু ধর্ষণ ৩৬৭টি। আর ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই ধর্ষণের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৮১, যার মধ্যে ৩৪৫টি ঘটনার ভুক্তভোগী শিশু। ধর্ষণ ছাড়া নারীদের ওপর সংঘটিত সহিংসতার মধ্যে হত্যা, যৌন নিপীড়ন ও উত্ত্যক্তের ঘটনাও উল্লেখযোগ্য হারে ঘটেছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি-জুন সময়ে ১ হাজার ৫৫৫টি নির্যাতনের খবর প্রকাশ পেয়েছে, যার মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ছিল ১০৬টি এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৭ জনকে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে একের পর এক ‘মব ভায়োলেন্স’ বা ‘দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টির ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক বা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাবে, গত ছয় মাসে অন্তত ১৪১টি মবের ঘটনায় ৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। রাজনীতিক ও বিশ্লেষকদের অনেকে এসব ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। যদিও সরকার মবের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছে। দেশের রাজনীতিতে মব ইস্যুতে ভিন্ন ভিন্ন ন্যারেটিভ বা ধারণাও দেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ঘটনাগুলোকে ‘জনরোষ’ হিসেবে বর্ণনা করছে। এমনকি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মবকে ক্ষুব্ধ মানুষের ‘প্রেসার গ্রুপ’ বলে ন্যারেটিভ দেন যা নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়। এর পেছনে তাদের যুক্তি হচ্ছে, পতিত আওয়ামী লীগের সাড়ে পনেরো বছরের শাসনে রাজনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্যাতিতদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকে কিছু ঘটনা ঘটছে। ভিন্ন ন্যারেটিভও রয়েছে রাজনীতিতে। কোনো কোনো রাজনীতিক মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের ১১ মাসের শাসনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে। সে কারণে মবের জবরদস্তি দেখা যাচ্ছে। তবে বর্তমানে প্রভাবশালী দলগুলোর মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির বিরুদ্ধেও মবের অনেক ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। রাজনীতিতে মব নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা, বক্তব্য বা ন্যারেটিভ, যাই থাকুক না কেন-পরিস্থিতি যে উদ্বেগজনক, এ ব্যাপারে দলগুলোর মধ্যে দ্বিমত নেই। মব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে দেশে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হতে পারে, এমন আশঙ্কার কথাও বলছেন কোনো কোনো রাজনীতিক। কখনও রাজনৈতিক, কখনও গোষ্ঠীগত বা ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা থেকে কাউকে স্বৈরাচারেরে দোসর বা এ ধরনের ‘তকমা’ দিয়ে মব ভায়োলেন্স বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ বছরের প্রথম ছয় মাসের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে এমন ধারণা পাওয়ার কথা বলছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। এসব সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, কট্টরপন্থি ধর্মভিত্তিক কোনো কোনো গোষ্ঠী, যাদের রাজনীতিতে, সাধারণ মানুষের মাঝে তেমন অবস্থান নেই, এ ধরনের কিছু শক্তি ‘তৌহিদী জনতা’ বা এ ধরনের ব্যানারে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু মব সৃষ্টি করেছিল। ইসলামপন্থি কোনো কোনো দলেরও তাতে সমর্থন ছিল।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, কোনো শক্তি একের পর এক মব তৈরি করে দেশকে একটা পরিস্থিতির দিকে নিতে চাইছে, যাতে পরিবেশ অস্থিতিশীল হয়। মব ভায়োলেন্সের ঘটনাগুলোর বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই রাজনীতি রয়েছে বলেই মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যে দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অভিযোগ রয়েছে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির বিরুদ্ধে। আর এনসিপির বিরুদ্ধেই অভিযোগের পাল্লাটা ভারি বেশি। যদিও দলটি অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। একইসঙ্গে তারা মবের ঘটনগুলোকে ‘জনরোষ’ বা ‘বিক্ষুব্ধ জনতা’ বলেও এক ধরনের ন্যারেটিভ দিচ্ছে। কিন্তু এনসিপির নেতা-কর্মীদের মবের মতো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সর্বশেষ অভিযোগ নিয়েও ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। কারণ তাদের মবের প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের পটিয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে সরকার প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলছেন, মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, দেশে এর আগেও বিভিন্ন সময় মব, দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা তৈরি করে বা গণপিটুনিতে মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু গত বছরের অগাস্টে গণ অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত একের পর এক মব ভায়োলেন্সের ঘটনা ঘটছে, যা উদ্বেজনক এবং থামছে না।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ