অস্ট্রেলিয়ায় চাঞ্চল্যকর ‘মাশরুম মার্ডার’ মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে গত রোববার। ভিক্টোরিয়া রাজ্যের মোরওয়েল শহরের ল্যাট্রোব ভ্যালি আদালতের ১২ সদস্যের জুরি বোর্ড এরিন প্যাটারসনকে তিন আত্মীয়কে হত্যা এবং আরেকজনকে হত্যাচেষ্টার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেছে। সিএনএন, রয়টার্স এবং বিবিসি জানিয়েছে, প্রায় দশ সপ্তাহ ধরে চলা এই বিচারে আলোচিত ছিল কীভাবে একটি মধ্যাহ্নভোজ পরিণত হলো ভয়াবহ বিষক্রিয়ায় এবং তিনটি প্রাণহানির ঘটনায়।
২০২৩ সালের ২৯ জুলাই, ভিক্টোরিয়ার লিয়ংগ্যাথা শহরে নিজের বাড়িতে দুপুরের খাবারের আয়োজন করেন ৫০ বছর বয়সী এরিন প্যাটারসন। তিনি মেনুতে পরিবেশন করেন ‘বিফ ওয়েলিংটন’, যা গরুর মাংস, মাশরুম পেস্ট ও পাফ পেস্ট্রি দিয়ে তৈরি একটি বিলাসবহুল খাবার। তবে সেই খাবারে মিশেছিল প্রাণঘাতী ‘ডেথ ক্যাপ’ মাশরুম, যা মানুষের লিভার ও কিডনির কার্যক্রম দ্রুত বিকল করতে সক্ষম।
দাওয়াতে উপস্থিত ছিলেন এরিনের শ্বশুর-শাশুড়ি ডনাল্ড প্যাটারসন ও গেইল প্যাটারসন, গেইলের বোন হিদার উইলকিনসন এবং হিদারের স্বামী ইয়ান উইলকিনসন। তবে এরিনের বিচ্ছিন্ন স্বামী সাইমন প্যাটারসন শেষ মুহূর্তে দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেন। খাবারের পরই অতিথিরা ভয়ানকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বমি, ডায়রিয়া এবং পেটে তীব্র ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় সবাইকে। গেইল ও হিদার ৪ আগস্ট এবং ডনাল্ড ৫ আগস্ট মারা যান। ইয়ান উইলকিনসন দীর্ঘ দুই মাস হাসপাতালে থেকে প্রাণে বাঁচলেও কোমায় ছিলেন কয়েক সপ্তাহ।
প্রসিকিউশনের অভিযোগ, এরিন ইচ্ছাকৃতভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। সরকারি কৌঁসুলি ন্যানেট রজার্স আদালতে বলেন, এরিন চারটি ‘পরিকল্পিত প্রতারণা’ করেছেন। প্রথমত, তিনি ক্যানসারের গল্প সাজিয়ে এই দাওয়াতের আয়োজন করেন। দ্বিতীয়ত, খাবারে মিশিয়েছিলেন প্রাণঘাতী মাশরুম। তৃতীয়ত, নিজেও অসুস্থ হওয়ার নাটক করেন এবং চতুর্থত, প্রমাণ ধ্বংস ও ঘটনা আড়াল করতে চেষ্টা করেন।
প্রমাণ হিসেবে বলা হয়, ২০২৩ সালের ২৮ এপ্রিল এরিন একটি ফুড ডিহাইড্রেটর কিনেছিলেন, যেটিতে মাশরুম শুকানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। পরে তিনি সেটি ২ আগস্ট স্থানীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রে ফেলে দেন। সেটি থেকে এরিনের আঙুলের ছাপ এবং মাশরুমের অংশবিশেষ উদ্ধার করা হয়। আদালত আরও জানায়, এরিন ইন্টারনেটে ‘ডেথ ক্যাপ মাশরুম’ সম্পর্কিত তথ্য অনুসন্ধান করেছেন।
এরিনের আইনজীবী কলিন ম্যান্ডি এসব অভিযোগ ‘অযৌক্তিক ও জটিল ষড়যন্ত্র’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, এরিনও সেই খাবার খেয়েছিলেন এবং অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তার শরীরে পটাশিয়ামের ঘাটতি ও হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রমাণ আদালতে পেশ করা হয়। আইনজীবীর যুক্তি, এরিনের কোনো আর্থিক সমস্যা ছিল না, তিনি বড় বাড়িতে বাস করতেন এবং তার দুই সন্তানের প্রায় পুরো সময়ের হেফাজত তার কাছেই ছিল। ফলে হত্যার কোনো উদ্দেশ্য থাকার কথা নয়।
কিন্তু বিচারক ক্রিস্টোফার বিয়েল জুরিদের নির্দেশনা দিয়েছেন যে, এরিনের মিথ্যা বলা বা প্রমাণ নষ্ট করা আদালতকে ‘নৈতিকতার আদালত’ হিসেবে চালাতে প্ররোচিত করা উচিত নয়। বরং বিষয়টি ছিল, এরিন ফৌজদারি দায়ে অপরাধী কি না।
দীর্ঘ ৬ দিনের আলোচনা শেষে জুরি বোর্ড একমত হয় যে, এরিন ইচ্ছাকৃতভাবে ওই চার অতিথিকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন এবং তিনি মিথ্যা বলেছিলেন যে, খাবারে মাশরুম মিশে যাওয়া নিছক দুর্ঘটনা ছিল। এরিনের শাস্তি ঘোষণা করা হবে পরবর্তী তারিখে। সিএনএন জানিয়েছে, তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।
এই মামলার খবর অস্ট্রেলিয়ার সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছে। সিএনএন জানিয়েছে, মামলাটি নিয়ে ইতিমধ্যে চারটি পডকাস্ট চালু হয়েছে, যেখানে প্রতিদিনের সাক্ষ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। একদিকে আতিথেয়তার নামে ঘটে যাওয়া এই মর্মান্তিক ঘটনা, অন্যদিকে পারিবারিক টানাপোড়েন-সবমিলিয়ে ‘মাশরুম মার্ডার’ হয়ে উঠেছে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে এক অদ্ভুত ও বিভীষিকাময় অধ্যায়।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

অস্ট্রেলিয়ায় ‘মাশরুম মার্ডার’
বিষাক্ত মাশরুম খাইয়ে তিন আত্মীয়কে হত্যায় এরিন প্যাটারসন দোষী সাব্যস্ত
- আপলোড সময় : ০৭-০৭-২০২৫ ০৯:১৮:২৭ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৭-০৭-২০২৫ ০৯:১৮:২৭ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ