সাংবিধানিক পদে নিয়োগের পদ্ধতি এবং উচ্চকক্ষ গঠনসহ বেশ কিছু মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনও ঐকমত্য তৈরি হয়নি। সর্বশেষ গত রোববার ফরেন সার্ভিস একাডেমীতে অনুষ্ঠিত বৈঠকসহ তিন দফা আলোচনা করেও ব্যাপক মতপার্থক্য থেকেই গেছে। এতে করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আশাবাদী পরিকল্পনা নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ফলে একই চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর জাতীয় ঐকমত্যের আলোচনা। অবশ্য আজ বুধবার পরবর্তী আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। আশা করা যায় এ সভা থেকে রাজনৈতিক দলগুলো একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবেন।
তবে কেউ কেউ মনে করছেন, রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক যে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করছে, সেটা ফুটে ওঠে দ্বিতীয় দফার সপ্তম দিনের আলোচনায় অধ্যাপক আলী রীয়াজের সূচনা বক্তব্যে। দফায় দফায় বৈঠক শেষে বাস্তবতা এসে দাঁড়িয়েছে দলগুলোর ঘুরেফিরে একই চক্রে ঘুরপাক খাওয়া। এ আলোচনা বিবেচিত হচ্ছিল চূড়ান্ত হিসেবে। কিন্তু জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে না পারায় কাঠামো পরিবর্তন করে নাম পাল্টে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি করা হয়। সেটি নিয়েও দ্বিমত দেখা যায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। এ কমিটি গঠনে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ঐকমত্য পোষণ করলেও বিএনপি ও তার জোটসঙ্গী ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের দাবি এ কমিটি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব করে নির্বাহী বিভাগকে দুর্বল করে দেবে। সাংবিধানিক পদগুলোয় নিয়োগের জন্য সার্চ কমিটি বা আইনি ব্যবস্থায় হাঁটতে চায় দলগুলো।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী টানা দুই মেয়াদের পর বিরতি দিয়ে আবারও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পক্ষে বিএনপি। জামায়াতে ইসলামী ও বাম দলগুলোও কমিশনের এ প্রস্তাবের কয়েকটিতে দ্বিমত জানিয়েছে। একই ব্যক্তি একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও দলের প্রধান থাকতে পারবেন না এবং এক ব্যক্তি সারা জীবনে ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। এমন মত দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র’ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবে ‘বহুত্ববাদ’ না রাখার ব্যাপারে বেশির ভাগ দল মতামত দিয়েছে। সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনের বিপক্ষে মত দিয়েছে বেশির ভাগ দল। ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এ প্রস্তাবের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি একমত হলেও বিএনপি একমত নয়। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের বিষয়েও ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। তবে দ্বিতীয় দফা আলোচনায় কমিশনের পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত মৌলিক সংস্কারের অন্তত ২০টি বিষয়ে আলোচনার লক্ষ্য নির্ধারিত হলেও, এখন পর্যন্ত সাত কার্যদিবসে ৯টি বিষয়ের আলোচনা সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে পুরোপুরি ঐকমত্য হয়েছে মাত্র দুটি প্রস্তাবে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংশোধন এবং সংসদীয় কমিটিতে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিষয়ে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সব প্রস্তাবে যদি আমাদের শতভাগ একমত হতে হয়, তাহলে আলোচনা কেন? যেসব বিষয়ে সবাই একমত, সেগুলো নিয়েই তো সনদে স্বাক্ষর হওয়ার কথা। বাকি প্রস্তাবগুলো হলো-১০০ নারী আসনে সরাসরি ভোট, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল সীমিতকরণ ও সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতির সংযুক্তি। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি)’ পরিবর্তে নতুন একটি ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ নিয়োগ কমিটি’ গঠনের ধারণা উঠে এসেছে। কিন্তু এই প্রস্তাবও সব দলের সমর্থন পায়নি। বিএনপিসহ কয়েকটি দল এই কমিটির বিরোধিতা করেছে। তাদের যুক্তি, সংবিধানে এ ধরনের কমিটি যুক্ত করা হলে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব খর্ব হতে পারে। তবে বিএনপি জানিয়েছে, তারা প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল ১০ বছর নির্ধারণের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী, তবে শর্ত হলো-সংবিধানে ‘নিয়োগ কমিটি’ বা ‘এনসিসি’-র কোনো বিধান রাখা যাবে না। গত ২৯ জুনের আলোচনায় উচ্চকক্ষ গঠন নিয়েও মতানৈক্য দেখা দেয়। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল, সংসদের উচ্চকক্ষে একটি দল নির্বাচনে যত ভোট পাবে, তার অনুপাতে আসন পাবে। এই প্রস্তাবে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি এবং আরও কয়েকটি দল সম্মত হলেও বিএনপি এতে একমত নয়। বিএনপির অবস্থান হলো, নিম্নকক্ষে দল যেসব আসন পাবে, তার ভিত্তিতে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টন করতে হবে। এসব প্রস্তাব নতুন নয়। বহুবার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু দলগুলো একমত হতে পারছে না।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ ওইদিন বৈঠকের শুরুতে বলেন, আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম, আবু সাঈদের শাহাদাতবার্ষিকীতে (১৬ জুলাই) সবাই মিলে ‘জুলাই সনদ’-এ স্বাক্ষর করব। কিন্তু বাস্তবে সেটা কতটা সম্ভব হবে, তা এখন রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করছে। এ বিষয়ে আমাদের কিছুটা শঙ্কাও রয়েছে। তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা চাই সমস্ত সংস্থাগুলোর স্ব স্ব আইন যেগুলো আছে তার মধ্যে সংশোধনী আনবো। এছাড়া সেই আইনগুলোকে সংস্কার করে আরো স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা করে নিশ্চয়তা বিধান করি। এছাড়া গঠন প্রক্রিয়া আরো শক্তিশালী করি। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, এবি পার্টি, সিপিবি, গণসংহতি ও গণঅধিকার পরিষদের মতো বাকি দলগুলো বলছে যাতে প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত না হয় সে জন্যই সাংবিধানিক কমিটির পক্ষে তারা।
এ বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের সঙ্গে। তিনি বলেন, সাংবিধানিক কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। এখানে সরকারও আছে। এছাড়া সরকার বিরোধী যারা তারাও আছে। এইটা আমরা দেশের জন্য জরুরি মনে করি। একইসুরে কথা বলেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। তিনি বলেন, বিএনপি এবং তার সঙ্গে গুটি কয়েক দলের আপত্তির কারণে এই নিয়োগ কমিটি যার মধ্যে দিয়ে আসলে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনের নিয়োগ স্বাধীনভাবে হবে সেটা বাস্তবায়ন হলো না। এ নিয়ে অর্ধবেলার আলোচনায়ও একমত হতে না পারায় মধ্যাহ্নভোজনের বিরতি পর আলোচনা শুরু হয় দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার সদস্য নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে। এ পর্বেও মতানৈক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে দলগুলোর মধ্যে। জামায়াত, এনসিপি, এবি পার্টি, গণসংহতির মতো অধিকাংশ দল উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চায়। কারণ কোন দল যাতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংবিধান পাল্টে ফেলে স্বৈরাচার না হয়ে ওঠে। তবে বিএনপি ও এর জোটসঙ্গীদের দাবি, পিআর পদ্ধতির উচ্চকক্ষ ক্ষেত্রে আইন-প্রণয়ন ও সংবিধান সংশোধনে বাধা সৃষ্টি করবে। তাই বিদ্যমান সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচনের পক্ষে বিএনপি। এ বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষ গঠন করা হলে সেটা নিম্নকক্ষের রেপ্লিকা হয়ে যাবে। তিনি জানান, তারা নিম্নকক্ষে এখন সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চালুর কথা বলছেন না, তবে উচ্চকক্ষে সেটি দরকার। তবে ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন বলেন, মৌলিক হলো সংসদের নিম্নকক্ষ। আমরা সেখানে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির প্রস্তাব দিয়েছি। কিন্তু সেটা আলোচনায় না আসায় বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, আমরা এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম, যেখানে ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ, জবাবদিহি এবং ভারসাম্য থাকবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর হাতে যদি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে এত মানুষের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে। একইসুরে কথা বলেছেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন। তিনি জানান, আলোচনার একপর্যায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের সঙ্গে আলোচনা আটকে যায়। তিনি বলেন, ১১টা থেকে তিন ঘণ্টা আলোচনা করেও অগ্রগতি হয়নি। আমি প্রস্তাব রাখছি.কমিশন আগে বিএনপির অবস্থান জেনে আসুক, পরে আলোচনায় আনুক। তবে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক বলেন, কিছু কিছু দল নিজেদের অবস্থানে একেবারে অনড়। যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে কিয়ামত পর্যন্ত কোনো ঐক্য হবে না।
জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে গত বছরের অক্টোবর মাসে অন্তর্বর্তী সরকার ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। কমিশনগুলো সংবিধান, নির্বাচন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, প্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার নিয়ে প্রস্তাব দেয়। ফেব্রুয়ারিতে তারা পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেয়। এরপর মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলাদা আলোচনা হয়। এরপর জুন থেকে শুরু হয় দ্বিতীয় পর্বের বিষয়ভিত্তিক আলোচনা। ২৯ জুনের বৈঠকে অংশ নেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। আলোচনা শেষে আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, নিয়োগ কমিটির প্রস্তাবে বেশির ভাগ দল নীতিগতভাবে একমত। যারা এখনো দ্বিমত পোষণ করেছে, তাদের সংশোধিত প্রস্তাব দেওয়া হবে। আমরা আশা করছি, পরবর্তী বৈঠকে এই বিষয়ে সমাধান আসবে। তিনি বলেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের বিষয়ে বেশির ভাগ দল একমত। তবে উচ্চকক্ষ গঠনের পদ্ধতি নিয়ে ভিন্নমত রয়ে গেছে। জুলাই মাসের মধ্যেই আলোচনার চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে চাই।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

* জাতীয় ঐকমত্যের আলোচনা একই চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো * সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনের বিপক্ষে মতামত বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের
সংস্কার ইস্যুতে ঐকমত্যে অনিশ্চয়তা
- আপলোড সময় : ০১-০৭-২০২৫ ১০:৫৪:৫৬ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০২-০৭-২০২৫ ১২:৩২:০৪ পূর্বাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ