ঢাকা , মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫ , ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
সংবাদ শিরোনাম
গাজীপুরে কিশোর গ্যাং লিডারের গুলি ছোড়া নিয়ে এলাকায় আতঙ্ক ডিবি পরিচয়ে ৩০ লাখ টাকা ছিনতাই : এক আসামি কারাগারে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ৫ জন নিহতের ঘটনায় বাসচালক গ্রেফতার দেশে বছরে পাটের উৎপাদন ১৫ লাখ টন বিপুল বিনিয়োগ সত্তেও কমেনি জ্বালানি খাতের ভর্তুকি পোশাকশ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা, বিক্ষোভের পর কারখানা বন্ধ ঘোষণা ডেঙ্গু রোগীর ভীড় হাসপাতালে যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ স্বামীর বিরুদ্ধে পোরশায় মাদকদ্রব্য বিরোধী সচেতনতামূলক সভা কটিয়াদীতে প্রতিপক্ষের জোরপূর্বকভাবে জায়গা দখলের অভিযোগ আমতলীতে পৌরসভায় ৯টি ওয়ার্ডে বিএনপির কমিটি গঠনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে ১,২,৩ নং ওয়ার্ডের কমিটি গঠন সম্পন্ন আমতলীতে গোজখালী মাজার শরিফের পীরজাদা মরহুম মাওলানা শাহ্ ছলিমউদ্দীন আহম্মদ কাদরী এর ছোট ছেলে পীরজাদা জলিল কাদরী ইন্তেকাল করেছেন মুরাদনগরে ধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ভিডিও অপসারণসহ নারীকে নিরাপত্তা ও চিকিৎসা দেওয়ার নির্দেশ হাইকোর্টের মজুত থাকার পরও দিনভর পাম্পে অকটেন সংকট ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে খেলাফত মজলিস-মামুনুল হক গাইবান্ধায় ৬ বছরের শিশু ধর্ষণ, গণপিটুনিতে অভিযুক্ত নিহত যত বাধাই আসুক ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হতেই হবে-দুদু আশানুরূপ অগ্রগতি নেই দ্বিতীয় দফার সংলাপেও আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের

ডেঙ্গু রোগীর ভীড় হাসপাতালে

  • আপলোড সময় : ০১-০৭-২০২৫ ০১:০৭:৪২ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ০১-০৭-২০২৫ ০১:০৭:৪২ পূর্বাহ্ন
ডেঙ্গু রোগীর ভীড় হাসপাতালে
মঞ্জুর মোল্লা : 

থেমে থেমে হচ্ছে বৃষ্টি, আবার দেখা দিচ্ছে রোদ। এই গরম, এই শীতল অনুভূতি। প্রকৃতির এমন খেয়ালি আচরণে মৌসুম শুরুর আগেই চোখ রাঙাতে শুরু করেছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু সংক্রমণ। মে মাসের প্রথম পাঁচ দিনেই আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় দুইশ জন। এপ্রিল মাসে ছিল সাত শতাধিক। প্রতিদিনই বাড়ছে এডিস মশার সংক্রমণ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে ১০ হাজার ২৯৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বছরের এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৪২ জনের। আগের তুলনায় চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের হারও বেড়েছে। আসছে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে জ্বর হলেই পরীক্ষা করার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
গত রোববার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৪২৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এটি চলতি বছরে একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী হাসপাতালে ভর্তির ঘটনা। সবচেয়ে বেশি ১৪৯ জন ভর্তি হয়েছেন বরিশাল বিভাগে। তবে এই একদিনে ডেঙ্গুতে নতুন করে কারও মৃত্যু হয়নি। গতকাল সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, হাসপাতালে নতুন ভর্তিদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে আছেন ১৪৯ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৫৭ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে) ৬১, ঢাকা উত্তর সিটিতে ৪২ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ৪৫ জন, খুলনা বিভাগে ২১ জন এবং রাজশাহী বিভাগে ৫৪ জন। গত একদিনে সারা দেশে ৩৫৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ছাড়পত্র পেয়েছেন ৯ হাজার ৮৭ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনও আমরা ডেঙ্গুর আসল প্রকোপ দেখিনি। কেবল শুরুটা দেখছি। দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হবে এবং মৃত্যুর সংখ্যাও সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে। এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের সূচক ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ নামে পরিচিত। কোনো এলাকায় লার্ভার ঘনত্ব যদি ২০ শতাংশের বেশি হয়, তাহলে সেই স্থানকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। এ বছর রাজধানীসহ সারাদেশের বিভিন্ন এলাকা উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
সম্প্রতি ডেঙ্গু নিয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) এক জরিপে দেখা যায়, রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের ৭২টি ওয়ার্ডে মশার ঘনত্ব নির্দিষ্ট সূচকের চেয়ে বেশি যা ডেঙ্গু রোগের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাত এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ছয়টি ওয়ার্ডকে ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
জরিপে মশার প্রজনন উৎস হিসেবে সিমেন্টের পানির ট্যাঙ্ককে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ (ব্রুটো ইনডেক্স ২২ শতাংশ) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরপরই রয়েছে মেঝেতে জমে থাকা পানি (২০ শতাংশ);  প্লাস্টিকের ড্রাম (১৩ শতাংশ), ওয়াটার মিটার চেম্বার (১১ শতাংশ), প্লাস্টিকের বালতি (১০ শতাংশ), ফুলের টব ও ট্রে/প্লাস্টিকের পাইপের গর্ত (৭ শতাংশ), পরিত্যক্ত টায়ার (৬ শতাংশ), বাড়ির ভেতরের পানির চ্যানেল (৫ শতাংশ) এবং সিমেন্টের প্লট (৪ শতাংশ)। প্রাক-বর্ষা জরিপ অনুযায়ী, এডিস মশার লার্ভার সবচেয়ে বেশি ঘনত্ব (৫৮.৮৮ শতাংশ) পাওয়া গেছে বহুতল ভবনগুলোতে।
এডিস মশা নিয়ে আইইডিসিআরের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বাইরে ঝিনাইদহ, মাগুরা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরে এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি বেশি। ঝিনাইদহের শহর এলাকায় ২৭০টি বাড়ি পরিদর্শন করে ৫৪টি এডিসের লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ঝিনাইদহে ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ৬০ শতাংশ, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া মাগুরায় ব্রুটো ইনডেক্স ৫৫.৫৬ শতাংশ  এবং পিরোজপুরে ২০ শতাংশ। পটুয়াখালী পৌরসভায়ও পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, সেখানে ব্রুটো ইনডেক্স ১৯.২৬ শতাংশে পৌঁছেছে, অর্থাৎ উচ্চ ঝুঁকির সীমানায়। প্লাস্টিক ড্রাম, প্লাস্টিক বাস্কেট ও দইয়ের খালি পাত্রে লার্ভার উপস্থিতি বেশি পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছরে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই ব্রুটো ইনডেক্সে এডিস মশার ঘনত্ব ২০ শতাংশের ওপরে। এতে সারাদেশেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়বে। 
২০২৩ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ এক হাজার ৭০৫ জন মারা যান। সে বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন মোট তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সারাদেশে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন সাত হাজার ৯৭৮ জন এবং ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুবরণ করেছেন ৪৭ জন। চলতি বছর ২৭ জুন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ২০২৩ সালের প্রথমার্ধের চেয়েও বেশি। ২০২৪ সালে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন এবং ডেঙ্গুতে মোট মারা গেছেন ৫৭৫ জন। ওই বছর ৩০ জুন পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন তিন হাজার ৬৫১ জন এবং সে সময় মোট মারা গেছেন ৪৪ জন। এর আগে ২০২২ সালে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৬২ হাজার ৩৮২ জন এবং ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুবরণ করেছেন মোট ২৮১ জন। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ছয় মাসে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ৮৯ জন এবং ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে একজনের। 
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগে এডিস মশার বিস্তার কেবল রাজধানীতে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসার সক্ষমতা সীমিত। তাই এখনই পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কার্যকর মশা নিধন ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। তা না হলে ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার এবং মৃত্যু আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, আরও তিন মাস আগেই বলেছিলাম-এই বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হবে। দেশের ৬৪ জেলাতেই ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর ওপরে। নিশ্চিত করে বলা যায়, আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ভয়াবহ রূপ নেবে। আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, এখনও আমরা ডেঙ্গুর আসল প্রকোপ দেখিনি-শুধু শুরুটা দেখছি। এখন থেকেই মশার উৎস ধ্বংস, লার্ভা ম্যানেজমেন্ট এবং জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো না গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। 
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, বৃষ্টি হলেই ডেঙ্গু বাড়ে। এবার ইতোমধ্যেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ডেঙ্গু থেকে বাঁচার প্রধান উপায় হলো এডিস মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করা। কেউ বহুতল ভবনে বসবাস করলে সেখানেও পানি জমে থাকলে ফেলে দিতে হবে। ঘরের ভেতরেও যেন পানি না জমে। অনেকেই প্লাস্টিকের ড্রাম বা মাটির মটকিতে পানি সংরক্ষণ করেন— এগুলো তিনদিনের বেশি রাখা যাবে না। রাখলেও ঢাকনা দিয়ে রাখতে হবে, না হলে এডিস মশা ডিম পাড়বে। এডিস মশা ভোরে ও সন্ধ্যায় কামড়ায়, তাই তখন সাবধান থাকতে হবে। তিনি বলেন, জ্বর হলে এক-দুদিনের মধ্যেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে। উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা হচ্ছে। না হলে কাছাকাছি হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারেও পরীক্ষা করানো যাবে। জ্বর হলে প্রচুর পানি বা নানান ধরনের জুস পান করতে হবে। দুর্বলতা অনুভব করলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। সিটি করপোরেশনগুলোকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, এখন খুব মনোযোগ দিতে হবে যাতে কোথাও প্লাস্টিক কনটেইনার বা নির্মাণাধীন ভবনে পানি জমে না থাকে। আমাদের মাসিক কর্মসূচি নেওয়া উচিত— যেমন, মে মাসে যদি সব কনটেইনার অপসারণ করতে পারি, তাহলে জুনে ডেঙ্গু কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। আবার জুন মাসেও এটা চালু রাখতে পারলে জুলাইতে ফল পাওয়া যাবে। এভাবে সারা বছরই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে আমরা অনেক পদক্ষেপ নিয়েছি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা শুরু করেছি, ওয়ার্ড ক্যাম্পেইন হচ্ছে, ইউথ ক্যাম্পেইন হচ্ছে। মশার ওষুধ ঠিকমতো ছিটানোর জন্য আগের চুক্তি বাদ দিয়ে আর্মির সঙ্গে চুক্তি করছি— তিনদিনের মধ্যে এটি সম্পন্ন হবে। ম্যাসিভ আকারে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম চলবে। হাসপাতাল রেডি করেছি, জরুরি ওষুধগুলো কিনে রাখছি, মিডিয়া ক্যাম্পেইন শুরু হচ্ছে। আমি নিজেও সরেজমিনে যাচ্ছি।

নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

কমেন্ট বক্স