দুদক, জনপ্রশাসন ও বিচার বিভাগ সংস্কারে ঐক্য তৈরি হলেও মৌলিক বিষয়ে বিপরীতমুখী অবস্থানে রাজনৈতিক দলগুলো। আনুপাতিক উচ্চকক্ষ, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে স্বাধীন কাউন্সিল গঠন এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর মতো বিষয়ে আপত্তি রয়েছে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের। তবুও পূর্ণাঙ্গ ঐক্যের ভিত্তিতে জাতীয় সনদ তৈরিতে আশাবাদী ঐকমত্য কমিশন।
রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দাবি ওঠে পুরো ব্যবস্থা আমূল পরিবর্তনের। রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাত সংস্কারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। অক্টোবরে প্রথম ধাপে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা পড়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। এসব প্রতিবেদনের সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুদক ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের মতামত জানতে চায় ঐকমত্য কমিশন। মতামত দেয়া ৩৩টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ৪৫টি অধিবেশনের মাধ্যমে প্রথম পর্যায়ের সংলাপ শেষ হয়। গত ২ জুন দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু হয়। এসব আলোচনায় স্বৈরতন্ত্র টিকিয়ে রাখার অন্যতম উপাদান হিসেবে বিবেচিত ৭০ অনুচ্ছেদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। যা বাস্তবায়ন হলে অর্থ বিল ও আস্থা ভোট বাদে বাকি বিষয়ে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন সংসদ সদস্যরা। এছাড়া বিরোধী দল থেকে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংক্রান্ত জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটির সভাপতি নিয়োগ, নারীদের জন্য ১০০টি সংরক্ষিত আসনের বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন। তবে আনুপাতিক উচ্চকক্ষ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন, প্রধান বিচারপতির নিয়োগ এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাসের মতো অন্যান্য মৌলিক সংস্কারে বিপরীতমুখী অবস্থানে দলগুলো। দ্বিতীয় দফার দীর্ঘ আলোচনায় এনসিসির পরিবর্তিত নাম সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটির প্রস্তাবেও সায় নেই বিএনপিসহ কয়েকটি দলের। এ ধরনের কমিটি নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা খর্ব করবে বলে মনে করে দলটি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একজন ব্যক্তির সর্বোচ্চ ১০ বছর মেয়াদ মানার শর্ত হিসেবে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি বাদ দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিএনপি। যদিও জুলাইয়ের মধ্যেই ঐকমত্যের মাধ্যমে সনদ তৈরির ব্যাপারে আশাবাদী ঐকমত্য কমিশনের অন্যতম সদস্য বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, কতগুলো আইন-কানুন বিধিবিধান পরিবর্তন এবং সংবিধানের সংশোধন না করলে আবারও স্বৈরাচারের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। আশাবাদী হতে চাই, বাংলাদেশের ভবিষ্যতের স্বার্থে আমরা কতগুলো বিষয়ে ঐকমত্যে আসতে পারবো।
এদিকে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন, কিছু সংসদীয় কমিটির সভাপতি বিরোধী দল থেকে করার প্রস্তাবে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। দুই দিন আলোচনার পর এ দুটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়। ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল, অর্থবিল ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা পাবেন সংসদ সদস্যরা। দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে, অর্থবিল ও আস্থা ভোট ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা (এমপি) পূর্ণ ক্ষমতা পাবেন বা স্বাধীন থাকবেন। সংবিধান সংস্কার কমিশনের আরেকটি প্রস্তাব ছিল, সবগুলো সংসদীয় কমিটির সভাপতি বিরোধী দল থেকে করা হবে। আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়েছে, সরকারি হিসাব, অনুমিত হিসাব, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশেষ অধিকার–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি—এই চারটিসহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদ আসনের সংখ্যানুপাতে বিরোধী দলের মধ্য থেকে দেওয়া হবে। অর্থাৎ বিরোধী দলগুলো সংসদে যে কটি আসন পাবে, তার অনুপাতে সংসদীয় কমিটির সভাপতি পদ পাবে।
এ বিষয়ে ঢাবি’র রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, ১৬৬টি পয়েন্টেই ঐকমত্য চান, এটা কখনো হবে না বাংলাদেশে। সমঝোতার মধ্য দিয়ে যতটুকু ঐকমত্য তৈরি হবে তা বাস্তবায়নেই জোর দেয়া উচিত। এক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থে সব রাজনৈতিক দলকেও ছাড় দিতে হবে।
সংস্কার ও বিচার বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি হলে আগামী বছর রমজান অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণার পর গতি এসেছে ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে। ফলে অনেকটাই আশাবাদী হয়ে উঠেছে কমিশন। এখন পর্যন্ত যত সময় নিয়ে আলোচনা হয়েছে তার তুলনায় ফল কম হলেও ঐকমত্য কমিশন আশাবাদী। তারমধ্যে রয়েছে, নির্বাচনী এলকার সীমানা নির্ধারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা, সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি, জরুরি অবস্থা ঘোষণার প্রক্রিয়া, স্থানীয় সরকারে নারী প্রতিনিধিত্ব, উচ্চকক্ষের নির্বাচনপদ্ধতি, জেলা সমন্বয় কাউন্সিল গঠন ইত্যাদি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এখন পর্যন্ত আলোচনায় যে অগ্রগতি, কমিশন আরেকটু বেশি অগ্রগতি হবে এবং দলগুলো আরেকটু বেশি ছাড় দেবে বলে আশা করেছিল। কিছু কিছু বিষয়ে দু–একটি দল মতভিন্নতা দেখাচ্ছে। কিন্তু বড়মাপে ঐকমত্যে আসার চেষ্টা আছে, আলোচনায় সবাই সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে অংশ নিচ্ছেন, ক্ষেত্রবিশেষে দলীয় অবস্থান নমনীয় করছেন, এটা ইতিবাচক। তিনি বলেন, ‘আগামীতে জাতীয় স্বার্থে দলগুলো প্রয়োজনে কিছুটা ছাড় দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবে এবং দ্রুত একাধিক বিষয়ে ঐকমত্য হবে বলে আশা করছি।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

*মত-দ্বিমতের মধ্য নিলিমায় আটকে যাচ্ছে সংস্কার *রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছে ঐকমত্য কমিশন
সংস্কারের ঐক্য আশা ছাড়েনি কমিশন
- আপলোড সময় : ২৮-০৬-২০২৫ ০৪:৩৫:৫২ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৮-০৬-২০২৫ ০৪:৩৫:৫২ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ