ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ
* ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনা ফোর্দো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহানে হামলা
* মার্কিন নৌবাহিনীর সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপ করা হয়েছে ৩০ টিএলএএম ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র
* হামলার আগেই পারমাণবিক উপকরণ সরিয়ে নেয়ার কথা জানিয়েছে ইরান
* ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি
* যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিগুলো শক্তি নয়, দুর্বলতার প্রতীক : আইআরজিসি


মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দুই সপ্তাহের সময়সীমার অনেক আগেই ইরানে হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গতকাল রোববার ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনা ফোর্দো, নাতাঞ্জ এবং ইস্পাহানে হামলার কথা জানান ট্রাম্প। যা একটি অসাধারণ সামরিক সাফল্য বলে উল্লেখ করেন তিনি। ইরানের সবচেয়ে সুরক্ষিত পারমাণবিক স্থাপনা ফোর্দোতে ছয়টি বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমান উড়ে গিয়ে মোট ১২টি ‘বাংকার বাস্টার’ বোমা ফেলেছে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আইআরএনএ এক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে বলেছে, মার্কিন নৌবাহিনীর সাবমেরিন থেকে ৩০ ‘টিএলএএম’ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রও নিক্ষেপ করা হয়েছে ইরানের নাতাঞ্জ আর ইস্পাহান পারমাণবিক স্থাপনায়। সেই সঙ্গে একটি বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমান নাতাঞ্জে উড়ে গিয়ে দুটি বাংকার বাস্টার বোমা ফেলেছে। তিনি আরো বলেছেন, যে তিন পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার কথা যুক্তরাষ্ট্র বলছে, আদতে সেখানে তেজস্ক্রিয়তা সৃষ্টি করার মতো কোনো পদার্থ নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগেই তিনটি পরমাণু কেন্দ্রের পারমাণবিক উপকরণ সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছে ইরান। দেশটির রাষ্ট্রীয় টিভির উপ-রাজনৈতিক পরিচালক হাসান আবেদিনি টিভিতে সরাসরি কথা বলেন। তিনি বলেছেন, আগেই আমরা তিনটি পরমাণু কেন্দ্র আগেই খালি করে ফেলেছিলাম। যদি ট্রাম্পের কথা সত্যি হয়ও আমরা বড় ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়িনি। কারণ পারমাণবিক উপকরণ আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। এদিকে গত শনিবার রাতে চালানো মার্কিন হামলার জবাবে গতকাল রোববার সকালে ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। ইরানের সর্বশেষ এ হামলায় ইসরায়েলে অন্তত ৮৬ জন আহত হয়েছে এবং তাদের চিকিৎসা চলছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েল।
দৈনিক ইসরায়েল হাইয়োম-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরান অন্তত ৪০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। যেগুলো হাইফা, তেলআবিব ও ইসরায়েলের উপকূল ও মধ্যাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে আঘাত হেনেছে। এর পাশাপাশি মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির প্রভাবশালী একজন উপদেষ্টা। একইসঙ্গে ইরানের কায়হান পত্রিকার প্রধান সম্পাদক হোসেইন শরিয়তমাদারি সতর্ক করে বলেছেন, ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর, এখন আমাদের পালা। অন্যদিকে মার্কিন হামলার পরিণতি ‘চিরস্থায়ী’ হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি।  সেইসঙ্গে তিনি ওয়াশিংটনকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করেছেন।
গত শনিবার দিবাগত রাতে ইরানের ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান-তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক পোস্টে ইরানে হামলা চালানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। পরে ইরানও তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার বিষয় নিশ্চিত করে। তেহরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থা ‘অ্যাটমিক এনার্জি অর্গানাইজেশন অব ইরান’ (এইওআই) বলেছে, এ হামলা আন্তর্জাতিক আইন, বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির (এনপিটি) লঙ্ঘন। যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমান ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের বোমা বহনে সক্ষম। এ বোমা ‘বাংকার বাস্টার’ নামে পরিচিত। বি-২ বিমান থেকে এ বোমা ফেলে ইরানের ফর্দো ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানো হতে পারে বলে আগে থেকেই আশঙ্কা করা হচ্ছিল। এদিকে শনিবার রাতে চালানো মার্কিন জবাবে গতকাল রোববার সকালেই ইসরাইলের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। হামলায় ইসরায়েলে অন্তত ৮৬ জন আহত হয়েছে এবং তাদের চিকিৎসা চলছে বলে জানিয়েছে ইসরাইল।
ইসরায়েলের সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম কেএএন জানিয়েছে, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রগুলো কমপক্ষে ১০টি ভিন্ন স্থানে আঘাত করেছে। চ্যানেল ১৪ নিশ্চিত করেছে, পাঁচটি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলি ভূখণ্ডে আঘাত করেছে। যার মধ্যে তিনটি হাইফা অঞ্চলে এবং দুটি কেন্দ্রীয় ইসরায়েলে পড়েছে।  চ্যানেল ১২ বলছে, হাইফায় ‘অস্বাভাবিক এক ঘটনা’ ঘটেছে এবং সেখানে বহু বিস্ফোরণ হয়েছে। এছাড়া সতর্কতা সংকেত বেজে ওঠে উত্তর ও মধ্য ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থানে। বিশেষ করে হাইফা শহরে, যেখানে এর আগের হামলাগুলোর সময় কোনো আগাম সতর্কতা শোনা যায়নি। হাইফায় গুরুতর অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে এবং শেফেলাহ অঞ্চল ও ডান ব্লকে (যার মধ্যে তেল আবিব ও তার উপশহরগুলো অন্তর্ভুক্ত) অতিরিক্ত ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। কেএএন জানিয়েছে, তেলআবিবের আশপাশে একটি ভবনে সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে বহু ভবন ধ্বংস হয়েছে।
এদিকে ইসরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কারণে ৮৬ জন আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। যার মধ্যে দুজনের অবস্থা মাঝারিমানের, ৭৭ জনের অবস্থা ভালো এবং চারজন তীব্র উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভুগছেন। এছাড়া তিনজনের চিকিৎসা মূল্যায়ন চলছে। অন্যদিকে, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, ইরানি হামলার জবাবে দেশটিতে পালটা বিমান হামলা চালানো হয়েছে। ইরানের দেজফুল বিমানবন্দরে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী দুটি ইরানি এফ-৫ যুদ্ধবিমানে বোমা হামলা চালিয়েছে। এছাড়াও গতকাল রোববার সকালে চালানো হামলায় ইরানের আটটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার ধ্বংস করা হয়েছে, যার মধ্যে ছয়টি ইসরায়েলের উপর তাৎক্ষণিক আক্রমণের জন্য তৈরি ছিল। এর আগে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) বরাত দিয়ে আল-জাজিরা ও টাইমস অব ইসরায়েল জানায়, গতকাল রোববার সকালে ইরান থেকে একাধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। এ হামলাকে গত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইরানের প্রথম সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এর আগে ইরানের ড্রোন হামলার কারণে দক্ষিণ আরাভা অঞ্চলে সাইরেন বেজে ওঠে। এদিকে মার্কিন হামলার জবাবে মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির প্রভাবশালী একজন উপদেষ্টা। ইরানের কায়হান পত্রিকার প্রধান সম্পাদক হোসেইন শরিয়তমাদারি সতর্ক করে বলেছেন, ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর, এখন আমাদের পালা। হোসেইন শরিয়তমাদানি ইরানের রক্ষণশীল কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত। অতীতে তিনি নিজেকে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির প্রতিনিধি বলে দাবি করেছেন। সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম টেলিগ্রামে কায়হানের এক বার্তায় শরিয়তমাদারিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, কোনো সংশয় বা বিলম্ব না করে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আমরা অবশ্যই বাহরাইনে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাবো।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি ও ফ্রান্সের জাহাজ চলাচলের জন্য হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়া হবে। ওই বার্তায় পবিত্র কুরআনের একটি বাণী দিয়ে শেষ করা হয়।  বাণীতে বলা হয়, তাদের যেখানে পাবে সেখানেই হত্যা করো। এদিকে মার্কিন হামলার পরিণতি ‘চিরস্থায়ী’ হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি। সেইসঙ্গে তিনি ওয়াশিংটনকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে আরাগচি বলেন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা করে জাতিসংঘ সনদ, আন্তর্জাতিক আইন এবং এনপিটির গুরুতর লঙ্ঘন করেছে। তিনি বলেন, ঘটনাগুলো (মার্কিন হামলা) অত্যন্ত ভয়াবহ এবং এর চিরস্থায়ী পরিণতি হবে। জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্যকে অত্যন্ত বিপজ্জনক, আইনহীন এবং অপরাধমূলক আচরণের জন্য সতর্ক থাকতে হবে। তিনি আরও বলেন, ইরান ‘তার সার্বভৌমত্ব, স্বার্থ এবং জনগণকে রক্ষার সব অধিকার রাখে।
অপরদিকে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ছড়িয়ে থাকা সামরিক ঘাঁটিগুলো ‘শক্তির প্রতীক নয় বরং তাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা’। বিবৃতিতে আইআরজিসি বলে, অবৈধ মার্কিন শাসকগোষ্ঠী আগের যুদ্ধগুলোর কোনো শিক্ষাই নেয়নি। শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালিয়ে তারা নিজেই আগ্রাসনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। আইআরজিসি আরও দাবি করেছে, ইরানে চালানো যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বিমান হামলায় অংশ নেওয়া সব মার্কিন যুদ্ধবিমানের ফ্লাইট লোকেশন শনাক্ত ও নজরদারিতে রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটির সংখ্যা, বিস্তার ও আকার তাদের জন্য শক্তি নয়, বরং এতে তাদের আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়েছে। আইআরজিসির অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্র কেবল কৌশলগত ব্যর্থতাই দেখাচ্ছে না, বরং তারা ভূমি বাস্তবতা অস্বীকার করে মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন যুদ্ধাবস্থা তৈরি করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর এই হুঁশিয়ারি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী বর্তমানে ইরান ও তার মিত্রদের সম্ভাব্য পাল্টা আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।