
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ
আলোচনা বাতিলের পর বেড়েছে পাল্টাপাল্টি হামলা
- আপলোড সময় : ২২-০৬-২০২৫ ০১:০১:৪৪ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২২-০৬-২০২৫ ০১:০১:৪৪ অপরাহ্ন


* ইসরায়েলের বেন-গুরিয়ন বিমানবন্দর ও সামরিক দফতরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ইরানের
* ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা ইসরায়েলের
* মোসাদের ৫৪ গুপ্তচর গ্রেফতার
* ইরানের পারমাণবিক বোমা তৈরির সক্ষমতা দুই বছর পিছিয়ে গেছে ইসরায়েল
* জাতিসংঘে ইসরায়েলকে তুলোধুনো পাকিস্তান, চীন, রাশিয়া ও আলজেরিয়ার
ইরান ও ইসরায়েল গতকাল শনিবার নতুন করে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে। হুমকির মুখে থাকা অবস্থায় পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে তারা আলোচনা করবে না বলে জানানোর একদিন পর এই পাল্টাপাল্টি হামলা চালালো ইরান-ইসরায়েল। ইরানের ফার্স সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, ইসরায়েল দেশের অন্যতম বৃহৎ ইসফাহান পারমাণবিক স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। তবে কোনো বিপজ্জনক পদার্থের লিকেজ পাওয়া যায়নি। ইরানি গণমাধ্যম আরও জানায়, ইসরায়েল কোম শহরের একটি ভবনে হামলা চালিয়েছে। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, এতে ১৬ বছর বয়সী এক কিশোর নিহত এবং দুইজন আহত হয়েছেন। এদিকে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, তারা ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র সংরক্ষণাগার এবং উৎক্ষেপণ অবকাঠামো স্থাপনার বিরুদ্ধে একের পর এক আক্রমণ করেছে। এদিকে আইআরজিসি এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা বেন-গুরিয়ন বিমানবন্দর ও কিছু সামরিক সদর দফতরকে লক্ষ্য করে ইসরায়েল-অধিকৃত ফিলিস্তিনের অঞ্চলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। একইসঙ্গে প্রাণঘাতী এই সংঘাতের মধ্যেই ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাথে সম্পর্কিত ৫৪ জন গুপ্তচরকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে ইরানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তবে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কিছু না বলা হলেও তারা ইরানের পারমাণবিক বোমা তৈরির সক্ষমতা দুই বছর পিছিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে। এমনকি ইরানে ইসরায়েলের যে হামলা চলছে তা থামানোর কোনও পরিকল্পনা নেই বলেও জানানো হয়েছে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে। অন্যদিকে নিরাপত্তা পরিষদের এক জরুরি বৈঠকে ইরানের ওপর ইসরায়েলের সামরিক হামলার কঠোর সমালোচনা করেছে পাকিস্তান, চীন, রাশিয়া ও আলজেরিয়া।
এর আগে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানায়, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি জেনেভায় ইউরোপীয় কূটনীতিকদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। ইউরোপীয় দেশগুলো (যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) তাকে কূটনৈতিক আলোচনায় ফিরে আসার আহ্বান জানায়, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু আলোচনা পুনরায় শুরুর ব্যাপারে। তবে আরাগচি স্পষ্ট করে জানান, ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ না হলে আমরা কোনও কূটনৈতিক আলোচনা করব না। তিনি দাবি করেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ এবং আত্মরক্ষার অধিকার আন্তর্জাতিক আইনে বৈধ। আমাদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা নিয়ে কোনও আলোচনা হবে না। এদিকে তার এ ঘোষণার পরেই ইসরায়েলে ভোরে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ইরান থেকে সম্ভাব্য ক্ষেপণাস্ত্র হামলার বিষয়ে সতর্ক করে, যার ফলে তেল আবিবসহ মধ্য ইসরায়েলের বিভিন্ন অংশ এবং ইসরায়েলি-অধিকৃত পশ্চিম তীরে বিমান হামলার সাইরেন বেজে ওঠে। এ সময় তেল আবিবের আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করার শব্দ শোনা যায়। তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়ায় এলাকা জুড়ে বিস্ফোরণের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়। ইসরায়েলর জাতীয় জরুরি পরিষেবা বিভাগের কর্মকর্তা ম্যাগেন ডেভিড অ্যাডম জানিয়েছেন, দক্ষিণ ইসরায়েলেও সাইরেন বেজে ওঠে। এরপর ইসরায়েলের বেন-গুরিয়ন বিমানবন্দর ও সামরিক দফতর লক্ষ্য করেও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইরান। গতকাল শনিবার সকালে ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) এ ঘোষণা দেয়। আইআরজিসি এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা বেন-গুরিয়ন বিমানবন্দর ও কিছু সামরিক সদর দফতরকে লক্ষ্য করে ইসরায়েল-অধিকৃত ফিলিস্তিনের অঞ্চলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। তারা ট্রু প্রমিজ অপারেশন-৩ এর ১৮তম পর্যায় শেষ করেছে। এতে ‘শাহেদ ১৩৬’-এর মতো অসংখ্য আত্মঘাতী এবং যুদ্ধ ড্রোন, পাশাপাশি নির্ভুল কঠিন জ্বালানি এবং তরল জ্বালানি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। বিবৃতি অনুসারে, আইআরজিসি বেন গুরিওন বিমানবন্দর এবং সামরিক অপারেশনাল লজিস্টিক সেন্টারগুলোতে পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুগলো সফলভাবে ধ্বংস করেছে। সরকারের অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইরানি ড্রোনগুলোকে বাধা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। হামলার কারণে ইসরায়েলিরা আশ্রয়কেন্দ্রে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। তবে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, সর্বশেষ হামলায় ১০টির মধ্যে ৫টি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র তাদের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে। এরমধ্যে বন্দরনগরী হাইফাতে আঘাত হানা এক ক্ষেপণাস্ত্রে ৩ জন আহত হয়েছেন বলেও স্বীকার করেছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী। এদিকে ইরানের ধারাবাহিক পাল্টা হামলার প্রেক্ষিতে ইসরায়েল নতুন ‘লাইটনিং’ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম মোতায়েন শুরু করেছে, যাতে ইরানি ড্রোন প্রতিহত করা যায়। এদিকে জেরুজালেম পোস্ট স্বীকার করে বলেছে, ইরানি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের হামলা শুরুর এক সপ্তাহ পরেও ‘তেহরানে কেন্দ্রীয় সরকারের স্থিতিশীলতার কোনো ভাঙন নেই, বরং তেহরানের অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে।’ এদিকে গতকাল শনিবার ইরানের ইসফাহান অবস্থিত একটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। ইসফাহান গভর্নরের ডেপুটি সিকিউরিটি অফিসার আকবর সালেহি বলেছেন, শনিবার সকালে ইসফাহানের কয়েকটি স্থানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল, এর মধ্যে একটি পারমাণবিক স্থাপনাও রয়েছে। তিনি বলেন, হামলার পর সেখান থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা গেছে। তবে কোনো ক্ষতিকর পদার্থের গ্যাস বা তরল নির্গমন ঘটেনি। সালেহি আরো বলেন, ইসফাহান রিফাইনারি (পরিশোধনাগার) ইসরায়েলি হামলার লক্ষ্য ছিল না। ইসফাহান, লাঞ্জান, মোবারাকে ও শাহরেজা শহরের কিছু এলাকা ইসরায়েলি হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। আকবর সালেহি বলেন, এসব হামলায় এখন পর্যন্ত কোনো প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি। তবে কিছু এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এদিকে প্রাণঘাতী সংঘাতের মধ্যেই ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাথে সম্পর্কিত ৫৪ জন গুপ্তচরকে গ্রেফতার করেছে ইরান। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের শত্রুর পক্ষ নিয়ে তথ্য সংগ্রহ, রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। গতকাল শনিবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়ে বার্তাসংস্থা আনাদোলু বলেছে, ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার মধ্যে ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ খুজেস্তানে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ৫৪ জনকে গ্রেফতার করেছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। ইরানের আধা-সরকারি নিউজ এজেন্সি ফার্স রাষ্ট্রপক্ষের বরাত দিয়ে জানায়, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের সঙ্গে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সরাসরি যোগাযোগ থাকার প্রমাণ মিলেছে বলে দাবি করছে কর্তৃপক্ষ। এদিকে ইরানের ছোড়া অন্তত ৩৯টি ক্ষেপণাস্ত্র গত শুক্রবার থেকে ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে আঘাত হেনেছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম চ্যানেল ১২। চ্যানেল ১২ জানায়, ইরানের এসব হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল সামরিক স্থাপনা ও কৌশলগত স্থাপনা, যার মধ্যে কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র বেসামরিক এলাকাতেও আঘাত হেনেছে। হাইফা ও বিরশেবায় এর আগেও বেশ কয়েকবার ইরানি হামলার শিকার হয়েছে। নতুন হামলায় শহর দুটির আরও বেশ কয়েকটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে হতাহতের সংখ্যা নিশ্চিত করেনি কর্তৃপক্ষ। এদিকে হামলা পাল্টাপাল্টি হামলার ভেতরেই ইসরায়েল ঘোষণা করেছে, ইরানের পারমাণবিক বোমা তৈরির সক্ষমতা দুই বছর পিছিয়ে গেছে। ইসরায়েলের পক্ষে এ ঘোষণা দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদেওন সার। এমনকি ইরানে ইসরায়েলের যে হামলা চলছে তা থামানোর কোনও পরিকল্পনা নেই বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। গতকাল শনিবার এই তথ্য জানিয়ে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা বলেছে, জার্মান পত্রিকা বিল্ড-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদেওন সার দাবি করেছেন, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনা অন্তত দুই থেকে তিন বছর পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। গিদেওন সার বলেন, আমরা যে মূল্যায়ন পাচ্ছি, তা অনুযায়ী অন্তত দুই-তিন বছরের জন্য ইরানের পারমাণবিক বোমা তৈরির সক্ষমতা পিছিয়ে দিয়েছি। তিনি আরও জানান, ইসরায়েলের হামলা থামানোর কোনও পরিকল্পনা নেই। তার দাবি, এই হুমকি সরিয়ে নিতে যা যা করা দরকার, আমরা তাই করব। এদিকে নিরাপত্তা পরিষদের এক জরুরি বৈঠকে ইরানের ওপর ইসরায়েলের সামরিক হামলার কঠোর সমালোচনা করেছে পাকিস্তান, চীন, রাশিয়া ও আলজেরিয়া। জাতিসংঘে ইসরায়েলকে কার্যত তুলোধুনো করেছে এই চার দেশ। সংস্থাটির নিরাপত্তা পরিষদের এক জরুরি বৈঠকে ইরানের ওপর সামরিক আগ্রাসন নিয়ে ইসরায়েলের সমালোচনা করে দেশগুলো। এই চারটি দেশ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, ইরানের ওপর এই হামলা পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। গতকাল শনিবার এই তথ্য জানিয়ে সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ড বলেছে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এক জরুরি বৈঠকে ইরানের ওপর ইসরায়েলের সামরিক হামলার কঠোর সমালোচনা করেছে পাকিস্তান, চীন, রাশিয়া ও আলজেরিয়া। তারা সতর্ক করে বলেছে, এই হামলা পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে এবং পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার যে নজির তৈরি করা হয়েছে, তা ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক। মূলত এই চারটি দেশের অনুরোধেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া বলেন, ইরানের শান্তিপূর্ণ বেসামরিক পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকেও লক্ষ্যবস্তু বানানো হচ্ছে। এতে ভয়াবহ পারমাণবিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এমন স্থাপনায় হামলা চালানো যায় না। চীনের রাষ্ট্রদূত ফু কং বলেন, ইসরায়েলের এই হামলা আন্তর্জাতিক আইন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। এটি ইরানের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তাকেও ক্ষুণ্ন করছে এবং গোটা অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিপন্ন করছে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আসিম ইফতিখার আহমদ বলেন, ইসরায়েলের প্রকাশ্য সামরিক আগ্রাসন ও হামলাগুলোকে আমরা নিঃসন্দেহে নিন্দা জানাচ্ছি। এটি কেবল একটি দেশের জন্য নয়, গোটা অঞ্চলের ও বিশ্বশান্তির জন্যও গভীর হুমকি। আলজেরিয়ার রাষ্ট্রদূত আমার বেনদজামা এই হামলাকে বলেন, বিনা উসকানিতে ও অযৌক্তিকভাবে চালানো এই হামলা জাতিসংঘ সনদের প্রকাশ্য লঙ্ঘন।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ