* পাচার হওয়া অর্থের বড় একটি অংশ যুক্তরাজ্যে রয়েছে: প্রধান উপদেষ্টা
* পাচারকৃত অর্থ কীভাবে দেশে ফেরত আনা যায় তা নিয়ে বেড়েছে তৎপরতা
* শেখ হাসিনার শাসনামলে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে বিদেশে
* পাচার হওয়া অর্থ বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দেয়ার আহ্বান টিআইবিসহ তিন সংস্থার
* অর্থ ফেরানোর বিষয়টি অত্যন্ত জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদি বলে অভিমত অর্থনীতিবিদদের
বিগত শাসনামলে বিদেশে পাচারকৃত অর্থের একটা বড় অংশই পাচার হয়েছে যুক্তরাজ্যে। যে কারণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই সফরকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। তবে যুক্তরাজ্য থেকে এই পাচার হওয়া অর্থ খুব সহজে স্বল্প মেয়াদে ফেরত আনা সম্ভব নয় বলেও মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার করা হয়েছে। পাচার হওয়া এই বিপুল অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ লক্ষ্যে আমলতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে আনতে এ সম্পর্কিত আইন পরিবর্তন করার উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে পাচারকৃত অর্থ কীভাবে দেশে ফেরত আনা যায় তা নিয়ে তৎপরতা বেড়েছে সরকারের সকল মহলে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস চার দিনের সফরে বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। এই সফরের অন্যতম প্রধানর উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে পাচার হওয়া অর্থ কীভাবে ফেরত আনা যায়, তা নিয়ে কাজ করা। সরকারি সূত্র বলছে, এই লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হিসেবে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ড. আবদুল মোমেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, বাংলাদেশ থেকে যে অর্থ যুক্তরাজ্যে পাচার হয়েছে, সেটি ফেরত আনার সম্ভাব্য উপায় খুঁজতেই প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীরা কাজ করছেন। তবে এই অর্থ ফেরত আনা আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়ে ঢাকায় শুরু হয়েছে নানা আলোচনা।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বিষয়টি অত্যন্ত জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদি। বাংলাদেশের আর্থিক খাতের দুর্নীতি নিয়ে অধ্যাপক ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত কমিটি যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিল তাতে দেখা যায়, বিগত শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়েছিল বিদেশে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিগত শাসনামলে বিদেশে পাচারকৃত অর্থের একটা বড় অংশই পাচার হয়েছে যুক্তরাজ্যে। যে কারণে প্রধান উপদেষ্টার এই সফরকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন তারা। তবে যুক্তরাজ্য থেকে এই পাচার হওয়া অর্থ খুব স্বল্প মেয়াদে ফেরত আনা সম্ভব নয় বলেও মনে করছেন তারা।
চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মোট ১৭ হাজার ৩৪৫টি সন্দেহজনক লেনদেন ও কার্যক্রম সংক্রান্ত প্রতিবেদন (এসটিআর/এসএআর) দাখিল হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় যা প্রায় ২৩ শতাংশ বেশি। এতে বোঝা যায়, অর্থ পাচার প্রতিরোধ কার্যক্রমে প্রতিবেদন প্রদানকারী সংস্থাগুলোর সচেতনতা ও দক্ষতা বেড়েছে। এছাড়া বিএফআইইউ গত অর্থবছরে ১১৪টি আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থার কাছে পাঠিয়েছে। আইন প্রয়োগকারী, নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ মোট ১ হাজার ২২০টি তথ্য বিনিময়ও হয়েছে, আগের বছরের তুলনায় যা ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ বেশি।
এ নিয়ে অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার সহজ কোনো রাস্তা নাই। কেননা, যে অর্থ পাচার হয়ে যুক্তরাজ্যে বিনিয়োগ হয়েছে, সেটির সঙ্গে পাচার করা অর্থের যোগসূত্র প্রমাণ করাই বড় চ্যালেঞ্জ।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার এই সফর ঘিরে যুক্তরাজ্যে পাচার হওয়া অর্থ বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা-ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি, স্পটলাইট অন করাপশন ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-ইউকে। যুক্তরাজ্যে পাচার হওয়া অর্থ বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দিতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় সংস্থাগুলো। বিবৃতিতে সন্দেহভাজন অর্থ পাচারকারী, দুর্নীতি ও চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে জড়িতদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং যুক্তরাজ্যে পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারে দেশটির সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাষ্ট্রসংস্কারের চলমান উদ্যোগ, বিশেষ করে দুর্নীতির কার্যকর নিয়ন্ত্রণের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে পাচার হওয়া সম্পদ বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দিতে যুক্তরাজ্যকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। এর মাধ্যমে এমন জোরালো বার্তা দিতে হবে যে, চূড়ান্ত বিবেচনায় অর্থপাচারকারীদের শুধু উৎস হিসেবে বাংলাদেশই নয়, গন্তব্য দেশ যুক্তরাজ্যেও কার্যকরভাবে জবাবদিহি করতে হয়।
গণমাধ্যমে পাঠানো এই বিবৃতিতে স্পটলাইট অন করাপশনের নির্বাহী পরিচালক সুসান হাওলি বলেছেন, সময় অপচয় না করে তাৎক্ষণিকভাবে যুক্তরাজ্য সরকারের উচিত বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ জব্দে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ ও অর্থ পুনরুদ্ধারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে।
এই বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, দ্য অবজারভার ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ইউকে’র তদন্তে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজনদের যুক্তরাজ্যে মালিকানাধীন কমপক্ষে ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) ইতোমধ্যে ৯০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সম্পদ জব্দ করেছে।
বিবৃতিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ইউকের পলিসি ডিরেক্টর ডানকান হেমস বলেন, বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজনদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে অর্জিত (বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত) যুক্তরাজ্যে ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ড সম্পদের যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, যথাযথভাবে অনুসন্ধান করে যুক্তরাজ্য সরকারকে তা জব্দ করতে হবে।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেন, বিগত সরকারের সময়ে ‘চুরি হওয়া’ অর্থ খুঁজে পেতে বাংলাদেশের নতুন সরকারকে সহায়তা করা যুক্তরাজ্যের একটি নৈতিক দায়। এ বাধ্যবাধকতা উপলব্ধি করা উচিত। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যমটিকে তিনি জানান, পাচার হওয়া অর্থের বড় একটি অংশ বর্তমানে যুক্তরাজ্যে আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ড. ইউনূস ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে জানিয়েছেন, স্টারমার এখনো তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, তার সঙ্গে আমার সরাসরি কথা হয়নি। আমি বিশ্বাস করি, তিনি (স্টারমার) আমাদের প্রচেষ্টায় সহায়তা করবেন। কারণ এগুলো ‘এগুলো চুরির টাকা।’ ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তাদের বরাতে দেশটির প্রভাবশালী এই সংবাদ মাধ্যমটি জানিয়েছে, অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কোনো পরিকল্পনা কিয়ার স্টারমারের নেই। যুক্তরাজ্য সরকারের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। ড. ইউনূস বলেন, যুক্তরাজ্য সরকার ইতোমধ্যে কিছু সহায়তা দিচ্ছে, তবে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে ‘আইনি ও নৈতিকভাবে’ আরও দৃঢ় সহায়তা করা উচিত। এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে এ বিষয়ে আরও উদ্যমী সহায়তা।
এদিকে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত নিয়ে যুক্তরাজ্যে কিয়ার স্টারমারের দল লেবার পার্টির ওপর রাজনৈতিক চাপ তৈরি হয়েছে। এসব অভিযোগের জেরে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ‘সিটি মিনিস্টার’ পদ ছাড়তে বাধ্য হন লেবার পার্টির এমপি ও শেখ হাসিনার ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিক, যিনি স্টারমারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের কাছ থেকে সম্পদ গ্রহণ করেছেন তিনি। যদিও তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
বর্তমানে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট সদস্য টিউলিপ সিদ্দিক চলতি সপ্তাহে অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কিছু বিষয় নিয়ে ‘ভুল বোঝাবুঝি’ হয়েছে দাবি করে তা দূর করতে চান তিনি। তবে অধ্যাপক ইউনূস এই সাক্ষাতে রাজি হননি। তিনি বলেন, এটি আইনি বিষয়, একটি প্রক্রিয়ার অংশ। এতে আমার ব্যক্তিগতভাবে যুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনামলে তিনি তার ক্ষমতাকে টাকার উৎসে রূপান্তর করেছিলেন, যা আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের লাভবান করার হাতিয়ার হয়ে ওঠে। ওই সময়ে একটি বড় লুটপাট হয়েছে। সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা জানান, শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে, যার একটি বড় অংশ যুক্তরাজ্যে গেছে। এগুলো চুরি করা অর্থ। তিনি বলেন, এই অবৈধ সম্পদের গন্তব্য রয়েছে- কানাডা, সিঙ্গাপুর, ক্যারিবিয়ান অঞ্চল ও মধ্যপ্রাচ্যেও। পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে যুক্তরাজ্যে এই সফর শুধু শুরু। অন্যান্য দেশেও সফরের পরিকল্পনা করছেন বলেও জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। যুক্তরাজ্যে ব্যবসায়িক মহল, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে সহায়তা প্রত্যাশা করছেন বাংলাদেশের সরকার প্রধান। তিনি বলেন, আমাদের গ্রেট ব্রিটেনের জনগণের সহায়তা প্রয়োজন।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে চ্যালেঞ্জের মুখে সরকার
- আপলোড সময় : ১৩-০৬-২০২৫ ১২:২৯:২৯ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৩-০৬-২০২৫ ১২:২৯:২৯ পূর্বাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ