
আরও ১১ জনকে পুশইন, মোট সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে
- আপলোড সময় : ০২-০৬-২০২৫ ০৩:৪৪:২৩ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০২-০৬-২০২৫ ০৩:৪৪:২৩ অপরাহ্ন


ভারত থেকে প্রতিদিনই কোনো না কোনো সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’ চলছে। এ ঘটনায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দফায় দফায় চিঠি দিলেও তা বন্ধ হয়নি। ৫ আগস্টের পর ভারতে পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগের বেশকিছু স্থানীয় নেতা-কর্মীকেও পুশ ইন করেছে দেশটি। এরমধ্যে, মৌলভীবাজারের বড়লেখা সীমান্ত দিয়ে আরও ১১ জনকে পুশ-ইন করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। গতকাল রোববার বিজিবি-৫২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহেদী হাসান ১১ জনকে আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, আটকদের বড়লেখা থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। গত শনিবার ভোরে ১১ জনকে পুশ-ইন করা হয়। বিজিবি সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পুশ-ইনের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৩৭ জনে। উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় ওই ১১ জনকে আটক করে বিজিবি। আটকরা বাংলাদেশি নাগরিক বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিজিবি সূত্র আরো জানায়, গত শনিবার উপজেলার উত্তর শাহবাজপুরের সীমান্ত এলাকা দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় ১১ জনকে আটক করে বিজিবি-৫২ ব্যাটালিয়নের আওতাধীন লাতু বিওপি ক্যাম্পের সদস্যরা। পরে তাদের পরিচয় যাচাই-বাছাই শেষে বড়লেখা থানায় হস্তান্তর করেছে। তারা হলেন- মো. আল আমীন (৩০) দিনাজপুর, মো. মকবুল (৬০) দিনাজপুর, আরিফুল ইসলাম (২০) রংপুর, মো. হাদিকুল আলম (১৮) রংপুর, মো. সেলিম রেজা (২০) দিনাজপুর, মো. খলিলুর রহমান (২০) দিনাজপুর, মো. নাজমুল (৩৩) দিনাজপুর, জাহাঙ্গীর আলম (৩০) দিনাজপুর, মো. জহিরুল ইসলাম (২৫) ঠাকুরগাঁও, মো. রহমান আলী (৪০) ঠাকুরগাঁও, মো. মনিরুল ইসলাম (২৮) ঠাকুরগাঁও।
পুশ ইন যেভাবে শুরু: ভারতের কাশ্মীরের পেহেলগাঁওয়ে গত ২২ এপ্রিল এক সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ ভারতীয় নাগরিক নিহত হন। তারপরই ভারতের গুজরাটে অভিযান চালিয়ে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ দাবি করে কিছু লোককে আটক করা হয়। পরে তাদের পুশ ইন করতে থাকে ভারত। ৭ মে প্রথম দফায় খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা ও পানছড়ি সীমান্ত দিয়ে ৬৬ ভারতীয় নাগরিক ও কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে আরও ৩৬ জনকে পুশ ইন কর হয়। এরপর থেকে পুশ ইন অব্যাহত রয়েছে।
২৫ দিনে এক হাজারেরও বেশি পুশ ইন: ভারত থেকে এ পর্যন্ত এক হাজারেরও বেশি লোককে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পুশ ইন করা হয়েছে। গত ৭ মে থেকে ২৮ মে পর্যন্ত মৌলভীবাজারে ৩৩১, খাগড়াছড়িতে ১১১, কুড়িগ্রামে ৬০, হবিগঞ্জে ১৯, সুনামগঞ্জে ১৬, দিনাজপুরে ২, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৯, চাপাইনববগঞ্জে ১৭, পঞ্চগড়ে ৩২, লালমনিরহাটে ২০, চুয়াডাঙ্গায় ১৯, মেহেরপুরে ৩০, ঝিনাইদহে ৪২, কুমিল্লায় ১৩, সাতক্ষীরায় ২৩ এবং ফেনী সীমান্ত দিয়ে ৩৯ জনকে পুশ ইন করেছে ভারত। এছাড়া সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবনের মধ্যে ৭৮ জনকে পুশ ইন করে দেশটি। এভাবে প্রতিদিনই বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পুশ ইন করা হচ্ছে।
পুশ ইনের আইনি স্বীকৃতি নেই: ভারত থেকে ‘পুশ ইন’ বা বাংলাদেশ থেকে ‘পুশ ব্যাক’ করার কোনো আইনি স্বীকৃতি না থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে এই পদ্ধতি সীমান্তে কার্যকর রয়েছে। তবে এখন হঠাৎ করে ভারত থেকে যে পুশ ইনের ঘটনা ঘটছে, সেটা নজিরবিহীন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভারতে কোনো বাংলাদেশি নাগরিক থাকলে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তাদের তালিকা যেন দেওয়া হয়। তালিকা যাচাইয়ের পর কোনো বাংলাদেশি থাকলে, তাকে গ্রহণ করবে বাংলাদেশ। তবে সেই প্রক্রিয়া না মেনে পুশ ইনের ঘটনা অব্যাহত রেখেছে ভারত। ভারতীয় নাগরিকদের জোর করে বাংলাদেশে পুশ ইন করা হচ্ছে। পুশ ইনের শিকার খাইরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি সামাজিক মাধ্যমে দাবি করেছেন, তিনি ভারতের নাগরিক। আসামের একটি স্কুলের শিক্ষক তিনি। ভারতীয় বিএসএফ জোর করে পুশ ইন করেছে।
ভারতকে চার দফায় চিঠি: ভারত থেকে অব্যাহতভাবে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পুশ ইনের ঘটনায় ইতোমধ্যেই দেশটিকে চার দফায় চিঠি দেওয়া হয়েছে। গত ৭ মে পুশ ইন শুরু হওয়ার পরদিন ৮ মে ভারতকে প্রথম চিঠি দেওয়া হয়। এরপর ১৩, ১৫ ও ২০ মে আরো তিন দফায় চিঠি পাঠানো হয়। এসব চিঠিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, কোনো ব্যক্তির নাগরিকত্ব পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে কাউকে যেন পুশ ইন করা না হয়। ভারতে কোনো বাংলাদেশি থাকলে যথাযথ চ্যানেল দিয়ে যেন পাঠানো হয়। তবে ভারত চিঠির প্রতিউত্তরে বলেছে, ভারত অবৈধ অভিবাসীদের স্থানীয় আইন ও রীতি অনুযায়ী মোকাবিলা করছে।
অবৈধ নাগরিকের তালিকা দিয়েছে ভারত: ভারতে অবস্থানরত ২ হাজার ৪৬১ জনকে বাংলাদেশি নাগরিক দাবি করে তাদের ফিরিয়ে নিতে বলেছে দেশটি। গত ২১ মে ভারতের পক্ষ থেকে এক চিঠিতে তাদের ফিরিয়ে নিতে বলা হয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রনধীর জয়সওয়াল জানিয়েছেন, বাংলাদেশি নাগরিকদের একটি তালিকা ইতোমধ্যেই ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৩৬০ জনের তথ্য যাচাই অপেক্ষমাণ রয়েছে। তিনি আরো বলেছেন, যেসব বিদেশি নাগরিক ভারতে অবৈধভাবে বসবাস করছেন, তাদের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানিয়েছি যেন তারা দ্রুত জাতীয়তা যাচাইয়ের কাজ সম্পন্ন করে।
ভারতে পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের পুশ ইন আতঙ্ক: ৫ আগস্টের পর ভারতে পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদেরও পুশ ইন করছে ভারত। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীকে পুশ ইন করেছে দেশটি। এ কারণে সেখানে থাকা নেতা-কর্মীরা পুশ ইন আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কেউ কেউ ভারত থেকে অন্য দেশে পাড়ি দেওয়ারও চেষ্টা করছেন।
কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর তাগিদ বিশেষজ্ঞদের: ভারত থেকে প্রতিনিয়ত পুশ ইন ঠেকাতে বাংলাদেশ সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে, জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, পুশ ইন বন্ধে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। প্রতিদিন সীমান্ত দিয়ে পুশ ইন হচ্ছে। কিন্তু কূটনৈতিক তৎপরতা তেমন চোখে পড়ছে না। বিশেষ করে দিল্লি ও কলকাতা মিশনে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। ভারতকে বলতে হবে, কেন এমন ঘটছে। না হলে সীমান্তের স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিদিন পুশ ইন-পুশ ব্যাক নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে থাকবে।
পুশ ইন নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্য: বাংলাদেশে ভারতের অব্যাহত পুশ ইনের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন গত ২১ মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, দিল্লির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ অব্যাহত আছে। আমরা চেষ্টা করছি নিয়মের বাইরে যাতে কিছু না ঘটে। পুশ ইন নিয়ে দিল্লির প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের অবস্থান কিছুটা জানিয়েছে। আমাদের অবস্থান তাদের কাছে ব্যাখ্যা করেছি। এভাবে দেওয়াটা যে ঠিক না এটা আমরা তাদের বুঝিয়েছি। আমরা তাদের বলেছি আমাদের স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) আছে, সেই প্রক্রিয়া অনুযায়ী আমরা যাব। তারা কিছু তালিকা দিয়েছে, আমরা সেই তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যাচাই করছি।
ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব যা বলছেন: ভারত থেকে পুশ ইনের ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার কী করছে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব রুহুল আলম সিদ্দিকী বলেন, আমরা এটা নিয়ে খুব সিরিয়াসলি কাজ করছি। আমাদের মনোনীত হাইকমিশনার সে দেশে আছেন। কিভাবে আমরা বিষয়টি হ্যান্ডেল করবো, সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। এছাড়া এর সঙ্গে জড়িত সব সংস্থাই রাউন্ড দ্য ক্লক কাজ করছে। ভারত থেকে প্রতিনিয়ত পুশ ইন করা হচ্ছে। তাদেরকে ভারতের তালিকা অনুযায়ী পুশ ইন করা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, যাদেরকে পুশ ইন করা হচ্ছে, তারা ওই তালিকায় আছেন কি না, যাচাই বাছাই করে দেখতে হবে। তার আগে এটা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো কিছু বলা যাবে না। এটা নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিজিবি সমন্বয় করে কাজ করছে। তিনি বলেন, ভারত থেকে যদি একজনের নাম কাশেম বলে এখানে পাঠানো হয়, আমাদের জানতে হবে তিনি কাশেম কি না। একটা নাম দিলেই তো চিহ্নিত করা সহজ নয়। কারণ অনেকের নামই তো মিলে যায়। আমাদের দেখতে হবে তিনি আমাদের নাগরিক কি না।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ