বাংলাদেশ ও ইতালির মধ্যে সম্প্রতি একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে। নতুন এ চুক্তির আওতায় ইতালি বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে। শ্রমবাজারের জন্য এটি নতুন দিশা। এতে অবৈধ পথে ইতালি যাওয়া বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি ইউরোপের শ্রমবাজারে বাড়বে বাংলাদেশিদের দখল।
অভিবাসন সংশ্লিষ্টদের মতে, এই চুক্তির ফলে ইউরোপগামী কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলবে। এ ধরনের উদ্যোগ শুধু কর্মসংস্থানের সুযোগই তৈরি করছে না, বরং বৈদেশিক আয় বাড়ানোর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করছে। পাশাপাশি ইউরোপে বৈধ পথে অভিবাসনের সুযোগ বাড়বে এবং মানবপাচারের ঝুঁকিও কমবে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ও ইতালির মধ্যে প্রথম কোনো এমওইউ (সমঝোতা স্মারক) এটা। বৈধ পথে মাইগ্রেশন বাড়াতে দুই দেশের এ উদ্যোগ।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মসংস্থান অনু বিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারি গাজী শাহেদ আনোয়ার বলেন, প্রথম দিকে সিজনাল কর্মী যাবে। ইতালি জানিয়েছে, তারা প্রথম এগ্রিকালচার ও ট্যুরিজম সেক্টরে লোক নেবে। এরপর সেক্টর আরও বাড়াবে। কতজন কর্মী যাবে, প্রসেস কী? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জন্য কোটা তারা এখনো প্রকাশ করেনি। মাত্র এমওইউ হলো, জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের মিটিংয়ে এসব জানা যাবে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন চুক্তির আওতায় ইতালি যে শুধু কোটার আওতায় কর্মী নেবে তা নয়, বরং বাছাইকৃত খাতে দক্ষতা অনুযায়ী নিয়মিত নিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এই সমোঝতা স্মারকের জন্য ইতালির আগ্রহ বেশি ছিল। কারণ ইতালিতে অবৈধ শ্রমিক অনেক বেশি। এই স্মারকের মাধ্যমে অবৈধদের দেশে পাঠানো কিংবা বৈধ করতে একটা প্রক্রিয়া তৈরি হতে পারে। দেখা গেছে, এমন কোনো প্রক্রিয়া হলো অবৈধদের তারা দেশে পাঠাবে। বৈধভাবে সেক্টরভিত্তিক দক্ষ লোক যাওয়ার একটা সহজ পথ তৈরি হবে।
অভিবাসন বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউরোপে একমাত্র ইতালির শ্রমবাজারটি সম্ভাবনাময়। কিন্তু কিছু সংকট আর কর্মীদের অদক্ষতার কারণে সেখানে বৈধ পথে যাওয়ার সংখ্যা কমছে। তবে নতুন সমোঝতা স্মারক হলে শ্রমবাজারটি আরও সম্ভাবনাময় হবে। তবে এটাকে কাজে লাগাতে হবে।
বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে বৈধ পথে ইতালিতে গেছেন মোট ৮৩ হাজার ৯ জন বাংলাদেশি শ্রমিক, যা বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক শ্রমবাজারের শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ। সবশেষ ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে ইতালি গেছেন ২৭ হাজার ৫৩৬ জন।
ইতালিপ্রবাসীদের নিয়ে গঠিত ইতালবাংলা সমন্বয় ও উন্নয়ন সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সালে প্রথম বিদেশি কর্মী নিয়োগের কোটায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করে ইউরোপের দেশ ইতালি। এতে দেশটিতে বাংলাদেশি কর্মী বাড়তে শুরু করে। ২০১৫ সালে মোট বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা দুই লাখ ছাড়ায়। এর আগে ২০১১ সালে কিছু অবৈধ কর্মীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চায় ইতালি। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে কোনো চুক্তি না থাকায় এটি সম্ভব হয়নি। ২০১২ সালে বাংলাদেশের কোটা সুবিধা বাতিল করে ইতালি সরকার। পরের বছর থেকে কর্মী পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। এতে অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে।
২০১৩ সালে ইতালি শ্রম বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কর্মী নিয়োগ নিয়ে ২০২০ সালে দুই দেশের মধ্যে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সই হয়। ২০২০ সালে কোভিডের কারণে ইতালিতে নতুন করে খুব বেশি কর্মী যেতে পারেনি। এরপর ২০২১ থেকে নিয়মিত কর্মী যাওয়া শুরু করে। বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ইতালি যান ৬৫৩ জন। ২০২২ সালে তা বেড়ে হয় ৭ হাজার ৫৯৪ জন, পরের বছর যান ১৬ হাজার ৮৭৯ জন। ২০২৪ সালে যান মাত্র ১ হাজার ১৬৪ জন। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে গেছেন ১ হাজার ২৪৬ জন। ২০২১-২২ অর্থবছরে ইতালি থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৫৪ দশমিক ২০ মিলিয়ন ডলার, যা পরের বছর ২০২২-২৩ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১১শ ৮৫ দশমিক ৯৪ মিলিয়নে। সবশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১২শ ১৩ দশমিক ৭৯ মিলিয়ন ডলারে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইতালির শ্রমবাজারে বাংলাদেশিদের অবস্থান দিন দিন শক্ত হচ্ছে। নতুন সমঝোতার আওতায় নিয়োগ বাড়লে এ আয় আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, ইতালি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার। নতুন সমঝোতা চুক্তি সেই সুযোগকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। সরকার যদি দক্ষ কর্মী তৈরি, প্রক্রিয়া স্বচ্ছ রাখা এবং নিয়োগে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে এই চুক্তি বাংলাদেশের অভিবাসন খাতে বড় পরিবর্তন আনবে।
অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইতালির শ্রমবাজারে গত দুই বছর থেকে একটা সংকট চলছে। বাংলাদেশ থেকে যারা ওয়ার্ক পারমিট ও স্পন্সর নিয়ে ভিসার আবেদন করেছেন, তাদের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে ঢাকার ইতালি দূতাবাস। এতে এক বছরের বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে কোনো কোনো কর্মীকে। আবার দীর্ঘদিন পাসপোর্ট আটকে থাকায় কর্মীরা গত বছর ক্ষোভ প্রকাশ করার পর অনেকের পাসপোর্ট ফিরিয়ে দেয়া হয়।
ইতালির ভিসাপ্রত্যাশী ইয়াসিন আরাফাত বলেন, স্পন্সরে অনেকে ইতালি যায়, অনেকে ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট পেয়ে লাখ লাখ টাকা খুইয়েছেন। অনেক দিন থেকে ওয়ার্ক পারমিট পেয়েও ইতালি যাওয়ার জন্য ঘুরছি। অনেক টাকা নষ্ট করেছি। অনেকে অনেক প্রলোভন দেখাচ্ছে। তিনি বলেন, এখন এই চুক্তির আওতায় যদি লোক নেয়, তাহলে আমরা বৈধভাবে কম খরচে যেতে পারবো। যাওয়ার প্রসেসটা যদি নির্বিঘ্ন হয়, দালালের দৌরাত্ম্য না থাকলে আশাকরি আমাদের স্বপ্ন পূরণ হবে।
ব্র্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল হাসান বলেন, ইউরোপের মধ্যে যেই দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক যাচ্ছে তার মধ্যে ইতালি অন্যতম। অন্যদিকে এই দেশটিতেই আবার সবচেয়ে বেশি অবৈধ শ্রমিক যায়, এবং মানব পাচারের শিকার হয়। ফলে সম্প্রতি যে সমোঝতা স্মারক হয়েছে, এটি অন্যতম বড় মাইলফলক হবে, যদি যথাযথ কার্যকর করা হয়। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে বৈধপথে অভিবাসন বৃদ্ধি পাবে। মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি হবে।
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল হাসান বলেন, ইউরোপের মধ্যে যে দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক যাচ্ছে তার মধ্যে ইতালি অন্যতম। অন্যদিকে এই দেশটিতেই আবার সবচেয়ে বেশি অবৈধ শ্রমিক যায়, এবং মানবপাচারের শিকার হয়। ফলে সম্প্রতি যে সমোঝতা স্মারক হয়েছে, এটি অন্যতম বড় মাইলফলক হবে যদি যথাযথ কার্যকর করা হয়। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে বৈধপথে অভিবাসন বাড়বে। মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হবে।
অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ইতালির বিষয়ে বিগত দু-এক মাসে তাদের অ্যাম্বাসির লোকজনসহ অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতি তাদের সহমর্মিতা আছে, তারা চায় আমাদের দেশ থেকে বৈধভাবে শ্রমিক যাক। তবে শঙ্কার বিষয়, ওখানে যারা অ্যাসাইলাম (আশ্রয়) চায়, তাদের অনেককে রিজেক্ট করতে পারে। এই চুক্তির মধ্যে হয়তো এ বিষয়টা যুক্ত হতে পারে। অবৈধদের ফেরত পাঠাবে কি না, সেটা আসলে আমাদের সরকার কীভাবে ম্যানেজ করে তার ওপর নির্ভর করবে। তিনি বলেন, আমাদের দেশের একটা সমস্যা হলো সমঝোতা স্মারক হলে বা নতুন কোনো চুক্তি হলে মানুষ সেটা গণমাধ্যমেই বেশি জানে। মন্ত্রণালয় কিংবা বিএমইটি কিন্তু জানায় না কোন সেক্টরে যাবে, কতজন নেয়া হবে প্রসেস কী? এগুলো খুব বেশি প্রচার করা হয় না। ফলে হাজার হাজার মানুষ যখন যাওয়ার জন্য তৈরি হয় তখন অনেক অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালালচক্র এই সুযোগ নিয়ে প্রতারণা করে। তাই সরকারিভাবে ক্যাম্পেইনটা জরুরি। তিনি বলেন, এখানে আরেকটা বিষয় হলো, স্মারকে সিজনাল ভিসার একটা বিষয় আছে। আমাদের অনেক কর্মী গিয়ে আবার ইউরোপের অন্য দেশে চলে যায়। ফেরত আসতে চায় না। তাই কর্মীদের চুক্তি মানতে বাধ্য করা কিংবা কর্মীদের মধ্যে সচেতনতা জরুরি। রিক্রুটিং এজেন্সিকে মানতে বাধ্য করার কাজটা সরকারকে করতে হবে। না হলে অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে এভাবে শ্রমবাজার হারাচ্ছে, কর্মী নেয়ার কোটা কমে যাচ্ছে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

* অবৈধ পথে ইতালি যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে * ইউরোপের শ্রমবাজারে বাড়বে বাংলাদেশিদের দখল
বাংলাদেশ-ইতালি সমঝোতায় শ্রমবাজারে নতুন দিশা
- আপলোড সময় : ১৪-০৫-২০২৫ ০৬:৩৯:৩৩ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৪-০৫-২০২৫ ০৬:৩৯:৩৩ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ