
রায়পুর পৌরসভা
নকল সইয়ে কমিটি বদল, ৯ কোটি টাকা লুটের কারসাজি


রায়পুর প্রতিনিধি
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর পৌরসভার নগর পরিচালন ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের নিম্ন আয়ের পাড়া (লিনিক) বাস্তবায়ন কমিটির ৯ কোটি টাকার কাজ বাস্তবায়নে কারসাজির অভিযোগ উঠেছে। এরইমধ্যে ৪টি প্যাকেজের বিপরীতে পছন্দের ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাবে ৭১ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ এসেছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এএফডি) আর্থিক সহায়তায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়। অভিযোগ রয়েছে, ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর ৩-৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী পৌরসভার অপসারিত মেয়র গিয়াস উদ্দিন রুবেল ভাটের সই নকল করে লিনিক কমিটি করেন। এতে প্রকল্প ঘিরে সরকারের উদ্দেশ্য ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি অনিয়মের বিষয়ে প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে অভিযোগ করেছেন এক ব্যক্তি।
মানুষের জীবনযাত্রার মান, ভৌত অবকাঠামো ও পরিবেশ উন্নয়নের লক্ষ্যে গেলো বছর প্রথম ধাপে রায়পুরসহ ৩৭টি পৌরসভায় নগর পরিচালন ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে জেলার রামগঞ্জ, রামগতি, নোয়াখালীর চৌমুহনী ও গোপালগঞ্জ পৌরসভাও রয়েছে। পরবর্তীতে আরও দুই ধাপে ৩১টিসহ মোট ৬৮ পৌরসভা এ প্রকল্পের তালিকাভুক্ত হয়। এরমধ্যে কিছু পৌরসভায় এসব প্রকল্পের উন্নয়নমূলক কাজ শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে নোয়াখালীর চৌমুহনী পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা (সচিব) জাকির হোসেন বলেন, নগর পরিচালন ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে আমাদের ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ এসেছে। তবে লিনিক বাস্তবায়ন কমিটির সভা হয়েছে। এখনো প্রশিক্ষণ হয়নি। ৫ আগস্টের আগে আমাদের কমিটি করা হলেও তা পরিবর্তন করা হয়নি। এ নিয়ে কারো কোনো আপত্তিও নেই।
এদিকে সোমবার (৫ মে) রায়পুর পৌরসভা কার্যালয়ে নগর পরিচালন ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের সভা ও প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হয়। পৌর প্রশাসক ও রায়পুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমরান খানের উপস্থিতিতে এতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন ছিলেন। এতে নামের তালিকা বদল, সই জালিয়াতিসহ অনিয়ম তুলে ধরেন একাধিক বক্তা। সেখানে পৌর বিএনপির সদস্য সচিব শফিকুল আলম আলমাস ও সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুর জাহের মিয়াজি বলেন, সুবিধাবাদী গোষ্ঠী অনিয়মের মাধ্যমে বরাদ্দের টাকা লুটপাটের পাঁয়তারা করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রায়পুর পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডে ৯ প্যাকেজে ২৬টি বাড়ির উন্নয়নে লিনিক কমিটি করা হয়। এতে ৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতকর (এলজিইডি)। এ প্রকল্পের কাজের কোনো টেন্ডার হবে না। দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন ও পৌরসভার উপ-সহকারী প্রকৌশলী এ কাজের দায়িত্বে থাকবেন। প্রকল্পে রাস্তা, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, পুকুর ঘাটলা, স্যানিটেশন, গভীর নলকূপ স্থাপন, লাইটিংসহ উন্নয়নমূলক কাজ করার কথা রয়েছে।
সে লক্ষ্যে ২০২৪ সালের ১০ জুন প্রকল্প কমিটির সঙ্গে তৎকালীন মেয়র গিয়াস উদ্দিন রুবেলের ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়। সেখানে পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ফারজানা আক্তার আছমা, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের নন্দিতা রাণী সাহা ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডের শিউলি আক্তারকে লিনিক কমিটির চেয়ারপার্সন মনোনীত করা হয়। চুক্তিটি ৫ বছরের জন্য। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর কারসাজির মাধ্যমে পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডে কমিটিতে জান্নাতুল ফেরদাউস বিউটি, ৩ নম্বর ওয়ার্ডে রহিমা বেগম, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের শাহনাজ আক্তার ও ১ নম্বর ওয়ার্ডের ফাতেমা বেগমকে চেয়ারপার্সন দেখানো হয়।
পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের অপসারিত কাউন্সিলর আবুল হোসেন বলেন, প্রথমে আমার ওয়ার্ডে শিউলি আক্তারকে প্রকল্প চেয়ারপার্সন করা হয়। ৫ আগস্টের পর মেয়র এলাকাছাড়া হলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ওই কমিটি বদলে শাহনাজ আক্তারকে চেয়ারপার্সন করা হয়। সব ওয়ার্ডেই চেয়ারপার্সনসহ নতুন লোক দেয়া হয়েছে। তদন্ত হলেই সত্য বেরিয়ে আসবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পৌরসভা কার্যালয়ের তিনজন কর্মচারী জানান, মেয়র গিয়াস উদ্দিন রুবেল রায়পুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি (মেয়র) আর পৌরসভা কার্যালয়ে আসেননি। কিন্তু ১৩ আগস্ট পরিকল্পিতভাবে পৌরসভার ৩-৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী তড়িঘড়ি করে লিনিক সভা দেখিয়ে কার্যবিবরণী (রেজুলেশন) করেন। তারা মেয়রের সই নকল করে পূর্বের কমিটি বদলে নিজেদের পছন্দের লোক দিয়ে নতুন কমিটি গঠন, তাদের নামে ব্যাংক হিসাব খোলেন।
প্রসঙ্গত ১৮ আগস্ট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সারাদেশের সঙ্গে রায়পুর পৌরসভার মেয়র গিয়াস উদ্দিন রুবেলকেও অপসারণ করে মন্ত্রণালয়। যোগাযোগ করা হলে আমেরিকায় অবস্থান করা গিয়াস উদ্দিন রুবেল বলেন, লিনিক প্রকল্পের তালিকা পরিবর্তনের জন্য আমি কোনো সই করিনি। আমার সই নকল করে নতুন তালিকা জমা দেয়া হয়েছে বলে শুনেছি। সরকারি টাকা আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে এমনটি করা হয়েছে।
অন্যদিকে সম্প্রতি প্রকল্পের অনিয়মের বিষয়ে মহাপরিচালকের কাছে রায়পুর পৌরসভার দেনায়েতপুর এলাকার এক বাসিন্দা (নিরাপত্তাজনিত কারণে এখন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) অভিযোগ দিয়েছেন। সেখানে বলা হয়, রায়পুর পৌরসভার সাবেক মেয়র এবিএম জিলানী, পৌরসভার হিসাবরক্ষক নুর এ হেলাল মামুন ও পৌরসভার বাজার পরিদর্শক মাহতাব উদ্দিনের যোগসাজশে জালিয়াতি করে কমিটি বদল করা হয়। এরইমধ্যে লিনিক কমিটির ব্যাংক হিসাবে ৭১ লাখ ৫০ হাজার টাকা জমা হয়েছে। এরমধ্যে আজম উদ্দিন বেপারী বাড়িতে ১৮ লাখ ১২ হাজার টাকা, কুড়িপাড়ায় ১৭ লাখ ১১ হাজার টাকা, বয়াতি বাড়িতে ১৮ লাখ ৬২ হাজার টাকা, নয়াবাড়ি-ছৈয়ালবাড়িতে ১৭ লাখ ১৪ হাজার টাকা ব্যাংক হিসেবে জমা হয়েছে। যদিও এখনও কাজ শুরু হয়নি।
রায়পুর পৌর বিএনপির সদস্য সচিব শফিকুল আলম আলমাস বলেন, টাকা লুটপাট করে খেতে গোপনে কারসাজি চলছে। এটি পুকুর চুরি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে কাউকে অনিয়ম-দুর্নীতি করতে দেয়া হবে না। প্রকল্প কমিটির সভায় আমরা ঘটনাটি উপস্থাপন করেছি। পৌর প্রশাসক অনিয়ম খতিয়ে দেখবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। যদিও সাবেক মেয়র এবিএম জিলানী অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এর সঙ্গে তিনি জড়িত নন। তার কী সেই ক্ষমতা আছে? রাজনৈতিক কারণে প্রতিপক্ষের লোকজন এসব অপপ্রচার রটাচ্ছে। একই ধরনের কথা বলছেন নুর এ হেলাল মামুনও। তিনি বলেন, আমি প্রকল্প রিলেটেড কেউ নই।
রায়পুর পৌরসভার প্রশাসক ও ইউএনও ইমরান খান বলেন, প্রকল্পের কিছু টাকা বরাদ্দ এলেও এখনো কাজ শুরু হয়নি। কমিটি পরিবর্তন করে নতুন নাম সংযোজন, পৌরসভার হিসাব বাদ দিয়ে প্রকল্পে মহিলাদের নামের হিসাবে বরাদ্দের টাকাসহ কিছু অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়গুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে নগর পরিচালন ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালক মো. আবদুল বারেকের মোবাইলে ফোন করলেও রিসিভ করেনি। তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এসএমএস পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ