মো. খলিলুর রহমান মৃধা নলছিটি (ঝালকাঠি) প্রতিনিধি
আধুনিকতার প্রভাবে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার মাটির চুলা। আবহমান বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মারক মাটির চুলা। মানবসভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে দেশের অন্য অঞ্চলের মতো গ্রামীণ নারীদের একমাত্র অবলম্বন ছিল মাটির চুলায় রান্না। এক সময় দক্ষিনাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা ঝালকাঠির গ্রামীণ মানুষের রান্নার একমাত্র অবলম্বন ছিল মাটির চুলা। বর্তমানে বিদ্যুৎ আর গ্যাসের যুগে কাঠ, খড়ি জ্বালানির ঝামেলা এড়াতে ঝুঁকছেন বিদ্যুৎ, গ্যাস, ম্যাজিক চুলার ব্যবহারের দিকে। এতে আবহমান বাংলার চিরায়িত ঐতিহ্যবাহী মাটির চুলা হারিয়ে যাচ্ছে।
হারিয়ে যাচ্ছে মাটির চুলায় রান্না করা খাবার ও রান্নার স্বাদ। হারিয়ে যাচ্ছে মায়েদের নিপুন হাতের শৈল্পিক হস্তশিল্প। ঐতিহ্যের মাটির চুলা আধুনিকতার ছোঁয়ায় আজ বিলুপ্তির পথে। বর্তমান যন্ত্রনির্ভর যুগে আজ নারীরা নির্ভরশীল হচ্ছে গ্যাসের চুলায়। আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষের রুচির পরিবর্তনের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে মাটির চুলা। হয়তো একদিন সনাতনী পদ্ধতির মাটির চুলা একদিন জীবন থেকে উঠে আসবে গল্প, কবিতা, নাটক, সিনেমায়। আধুনিক সমাজে পৌঁছে যাবে শিল্পীর চিত্রকর্মে বইয়ের প্রচ্ছদে প্রচ্ছদে।
রান্না করার জন্য মাটি দিয়ে নির্মিত চুলাকে “মাটির চুলা” বলা হয়। এক সময় গ্রাম-বাংলায় রান্না-বান্নার মূল ভিত্তি ছিল এই মাটির চুলা। প্রাচীন মানুষের কাঠ ও খড়কুটো জ্বালিয়ে তাতে খাবার পুড়িয়ে খেত। পুড়িয়ে খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা থেকে ধীরে ধীরে মানুষ শিখে নেয় চুলা বানানোর কৌশল। ধারণা করা হয়, পৃথিবীতে প্রথম চুলা তৈরি হয় মাটি দিয়ে। প্রথম চুলার আবিষ্কারের পর শত শত বছরের অনুশীলন মানুষকে আজকে চুলা বানাতে সহায়তা করেছে।
এক সময়, রান্নাবান্নার মূল ভিত্তি ছিল মাটির চুলা। শীতকাল আসলেই মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির নারীরা ঘরের পাশে মাটির চুলা তৈরির ধুম লেগে যেতো । আশেপাশের ফসলি জমি থেকে মাটি এনে সুন্দর করে মাটির চুলা বানাতেন তারা। কারিগড়রা একমুঠো দুইমুঠো করে একের পর এক মাটি সাজিয়ে তৈরি করতেন চুলা। নিপুন হাতের ছোয়ায় ধীরে ধীরে মাটির চুলায় সৌন্দয্য পায়।
সে সময় চুলার চারপাশে বিভিন্ন ধরনের কারুকাজ দ্বারা ফুটিয়ে তুলতেন চুলার সৌন্দর্য। মাটির চুলা প্রথমে মাটিতে বিশেষভাবে গর্ত করে চুলা বানানো হয়। গর্তের ওপর থাকে মাটির তিনটি অনুচ্চ স্তম্ভ দেওয়া হয়। এই স্তম্ভগুলোর ওপরই হাঁড়ি বা পাতিল বসিয়ে রান্না করা হয়। একমুখো, দুমুখো ও তিনমুখো—এই তিন ধরনের চুলার ব্যবহার সর্বাধিক। প্রতিটি চুলায় সাধারণত একটি করে জ্বালানি প্রবেশের মুখ থাকে। যেসব চুলায় একটি হাঁড়ি বসানো যায়, সেটিই একমুখো চুলা। যে চুলায় দুটি হাঁড়ি বসানো যায়, সেগুলো দুমুখো চুলা। দুমুখো মাটির চুলা দিয়ে সাধারণত বাড়িতে ধান সিদ্ধ বা অনুষ্ঠানের খাবার রান্নার জন্য ব্যবহার করা হয়। তিনমুখো চুলায় একই সঙ্গে পাশাপাশি তিনটি হাঁড়ি বা ডেকচি বসানো যায়। এ ধরনের চুলায় লাকড়ি প্রবেশের দুটি মুখেরও দেখা পাওয়া যায় কোনো কোনো বাড়িতে।
তিনমুখো চুলার ব্যবহার খুব বেশি চোখে পড়ে না। মূলত ধান সিদ্ধ করার জন্য এটি ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া তোলা চুলা বলে এক ধরনের চুলা আছে। মূলত এটি একমুখো চুলা। তবে এটি তৈরি করা হয় পরিত্যক্ত গামলায় মাটি দিয়ে।
সাধারণত হালকা খাবার রান্না, খাবার গরম করা, দুধ গরম করা, চা তৈরি ইত্যাদি কাজে এটি ব্যবহার করা হয়। বিশেষ প্রয়োজনে এটিকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অনায়াসে নিয়ে যাওয়া যায়। সাধারণত মাটির চুলায় কাঠ, বাঁশ, খড়কুটো, পাটকাঠি, শুকনো পাতা প্রভৃতি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। রান্নাঘরের চুলা যত বেশি পুরনো হয়, তার ভেতরের মাটি পুড়তে পুড়তে তত বেশি লাল হয়। পুরনো চুলা তাপ ছড়ায় দ্রুত।
রান্না শেষে মাটির চুলার আগুন নেভানোর পরও তাতে জ্বলন্ত কয়লা ও গরম ছাই থেকে যায়। সাধারনত গ্যাসের চুলার গ্যাসের প্রধান উপাদান মিথেন, সালফার ডাই অক্সাইড, সামান্য ইথেন, অতিসামান্য পরিমান পেট্রোল জাত পদার্থ থাকে। যখন আগুনের সংস্পর্শে আসে তখন এগুলো পুড়তে থাকে। আর পরিবেশে অবশিষ্টাংশ ছড়াতে থাকে।
এমন সময় পাতিলে থাকা খাবারেও কার্বনজাত পদার্থ, কার্বন ন্যানোপার্টিকেল, কার্বন ডাইঅক্সাইড অল্প পরিমানে মিশতে থাকে। ঢাকনা বিহীন রান্নাতে মিথেন মিশে গিয়ে ওয়াটার গ্যাস সৃষ্টি করে। যার কারনে খাবারের প্রকৃত স্বাদের হেরফের ঘটে। কিন্তু মাটির চুল্লীতে কাঠ/খড় পোড়ানো হয়। যাতে থাকে সেলুলোজ পদার্থ। এগুলো পরিবেশে সম্পূর্ন দহন হয়। কোনো প্রকার মিথেন বা গ্যাসীয় পদার্থ নির্গত হয় না। তবে যে ধোয়াটা বের হয় তা কম ক্ষতিকর কার্বনের ধোয়া। যা পরিবেশে উবে যায়।
খাবারে কোনো ইফেক্ট ফেলে না। এই কারনে মাটির চুলায় খাবারের স্বাদ বজায় থাকে।চুলার আবিষ্কার মানবজাতির গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলোর অন্যতম। প্রাচীন মানুষের কাঠ ও খড়কুটো জ্বালিয়ে তাতে খাবার পুড়িয়ে খাওয়ার যে ঐতিহাসিক গল্প আমরা জানি, তার থেকে এক ধাপ এগিয়ে যায় মানুষ চুলার আবিষ্কারের পর। প্রথম চুলার আবিষ্কারের পর শত শত বছরের অনুশীলন মানুষকে আজকের চুলা বানাতে সহায়তা করেছে। মাটির চুলার ছাই সবজি চাষে কাজে লাগে। মাছ কাটতেও ছাই ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া গ্রামবাংলায় এখনো অনেক পরিবার হাঁড়ি-পাতিল ধুতে ছাই ব্যবহার করে। সাধারণত মাটির চুলা বানানোর কাজটি করে থাকে গ্রাম বাংলার নারীরা?
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
