
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের আলোচনায় বক্তারা
গণমাধ্যম সংস্কারের জোরালো দাবি
- আপলোড সময় : ০৫-০৫-২০২৫ ০৫:২২:২০ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৫-০৫-২০২৫ ০৫:২২:২০ অপরাহ্ন


* সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলাম, আছি এবং থাকব: মির্জা ফখরুল
* গণমাধ্যমের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ অনেক কমে গেছে : নাহিদ ইসলাম
* প্রশ্ন করার জন্য সাংবাদিকের চাকরি যায়, এমন দেশে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করছি
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ যদি বাস্তবায়ন হয়, তাহলে গণমাধ্যমের ওপর কোনো ফ্যাসিবাদী শক্তি আর আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে না। দেশের গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়তে স্বাধীন গণমাধ্যমের বিকল্প নেই। সাংবাদিকদের দায়িত্বশীলতা ও সাহসিকতাকে সম্মান জানিয়ে তাদের নিরাপত্তার জন্য কার্যকর আইন জরুরি। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পৃথক আইন প্রণয়ন এবং সাংবাদিকতাবিরোধী সব কালাকানুন বাতিল, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যেভাবে মামলা হচ্ছে, তা অতিদ্রুত বন্ধের দাবি জানান তারা। এ সময় গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ মেতে সংস্কারের পক্ষে মতামত দেন নেতারা।
গতকাল রোববার দুপুরে ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস ২০২৫ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় উপস্থিত বক্তারা এসব কথা বলেন। সম্পাদক পরিষদ এই সভার আয়োজন করে।
বিএনপি বরাবরই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতে থাকবে বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ক্ষমতায় থাকুক আর না থাকুক বিএনপি গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করবে। কখনোই অন্যায়ভাবে অন্যের মতকে চাপিয়ে দেয়াকে সমর্থন করব না। তিনি বলেন, আমরা নির্দ্বিধায়, দৃঢ় চিত্তে, স্পষ্ট করে বলতে পারি- আমরা বরাবরই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলাম, আছি এবং ভবিষ্যতে থাকব। ক্ষমতায় থাকি আর না থাকি, যেখানেই থাকি, এই ব্যাপারে আপনাদের নিশ্চয়তা দিতে পারি।
গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশ করে বিএনপির এই নেতা বলেন, আপনাদের প্রতি অতীতে যে নির্যাতন নিপীড়ন হয়েছে, আপনাদের আইনকানুন যে পুরোপুরি ফ্যাসিবাদী চরিত্র দেয়া হয়েছে, এ ব্যাপারগুলোতে আমরা লড়াই করেছি। আমরা লড়াই করে চলেছি। এখনো করছি। খুব স্পষ্ট ভাষায় দৃঢ়ভাবে আবারও বলতে চাই আমরা কখনোই অন্যায়ভাবে অন্যের মতকে চাপিয়ে দেয়াকে সমর্থন করব না। আমরা আরেকজনের মতের স্বাধীনতাকে নিশ্চয়ই দৃঢ়ভাবে সমর্থন দেব।
সংস্কারের প্রসঙ্গ টেনে মির্জা ফখরুল বলেন, আমাদের বিপক্ষে প্রচার চালানো হয় আমরা সংস্কারের বিপক্ষে। প্রায়ই বলা হয় সংস্কার নয় আমরা নির্বাচন চাই। অথচ সংস্কারের বিষয়টি শুরু হয়েছে আমাদের দ্বারা। আমরাই এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা থেকে বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থা এনেছি। আমরাই সংসদীয় ব্যবস্থায় গেছি রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা থেকে। অনেক আপত্তি সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আমরা সংবিধানে নিয়ে এসেছি। এগুলো বাস্তবতা। ওই বাস্তবতা থেকে অযথা আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করে অন্য পথে দেখানো, এটার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে থাকতে পারে। বর্তমানে গণমাধ্যমের সামনে কথা বলতে গিয়ে কিছুটা আতঙ্কিত থাকেন বলেও জানান মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে কিছুটা আতঙ্কিত থাকি সম্প্রতিকালে প্রেসের সামনে কথা বলতে গিয়ে। মনে হচ্ছে কোনো প্রেস আমার কথাগুলো কীভাবে নেবে। তারপর তারা কীভাবে ছাপবে। অথবা সোশ্যাল মিডিয়া কীভাবে এটা উপস্থাপন করবে। এটা আমাদের জন্য যারা আমরা রাজনীতি করি। এটা আমাদের জন্য সত্যি একটা চিন্তার বিষয়। কারণ সম্প্রতিকালে চরিত্র হরণ করার যে প্রবণতা বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখা দিয়েছে, এটাতে চিন্তিত না হয়ে উপায় নেই।
বিএনপিই প্রথম সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে উন্মুক্ত করেছিল উল্লেখ করে দলের মহাসচিব বলেন, তার আগে এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা বাকশাল ছিল, সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমরা বলি না যে আমরা একেবারেই ধোয়া তুলসী পাতা। কিন্তু এ কথা নিঃসন্দেহে বলতে পারি আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য অনেক বেশি কাজ করেছি। আজকের যে আকাশ মাধ্যম, এটা আমাদের দ্বারাই শুরু হয়েছিল। অনেকগুলো মিডিয়া আছে যেগুলো আমাদের সময়ে তৈরি করা। আমাদের সময়েই সংবাদপত্রের এবং সংবাদকর্মীদের ওপর নিপীড়ন তুলনামূলক কম হয়েছে। গণতন্ত্র যদি সত্যিকারার্থে প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তাহলে গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে হবে বলে মনে করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, আমি মনের মধ্যে চিন্তা করব আমি যা বলব সেটাই সঠিক তাহলে সঠিকভাবে আমরা গণতন্ত্র চর্চা করতে সক্ষম হব না। একই ভাবে সংবাদমাধ্যম আমার কথা বললে ঠিক আছে, আর আমার কথা না বললে ঠিক নেই এই চিন্তা ভাবনাও কিন্তু গণতান্ত্রিক চর্চাকে শক্তিশালী করবে না।
আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক ও সাবেক তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, গণমাধ্যমে ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ আগের তুলনায় অনেকটাই কমে গেছে। তিনি বলেন, গণমাধ্যমের কথা আসলেই অনেক আলোচনা-সমালোচনার বিষয় চলে আসে। যেটা বিগত সরকারের সময়ও ছিল, আমি উপদেষ্টা থাকাকালীনও ছিল। ফ্যাসিস্ট সরকার গত ১৬ বছর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর যে দলীয়করণ নীতি চালিয়েছে, গণমাধ্যমও তার বাইরে ছিল না। সুতরাং গণমাধ্যমকে এই ফ্যাসিজমের ভেতর থেকে বের করে আনতে আমাদের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা প্রয়োজন। কারণ বিগত সময়ে মিডিয়া ও ফ্যাসিজমের যে সম্পর্ক ছিল, সেটা আধিপত্য থেকে যদি মিডিয়া বের না হয়, তাহলে জুলাই পরবর্তী যে মুক্ত গণমাধ্যমের চিন্তা আমরা করছি, তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। নাহিদ ইসলাম বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে গণমাধ্যমে বিভিন্ন মিস ইনফরমেশন প্রকাশিত হতে দেখেছি। এ বিষয়ে গণমাধ্যমগুলোর আরও পেশাদারিত্ব দেখানো প্রয়োজন। কারণ দল বা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে এর ভিকটিম আমরা হয়েছি। আমাদের কথা নানা সময়ে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমরা আশা করবো, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গণমাধ্যমের যে সম্পর্ক রয়েছে, তা আরও ইতিবাচক হবে। তিনি বলেন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন অনাকাক্সিক্ষতভাবেই দেরি হচ্ছে। এই সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত। তাহলেই আমরা বলতে পারবো জুলাই পরবর্তী যে গণমাধ্যম আমরা চেয়েছিলাম, তা দৃশ্যমান হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, গণমাধ্যমের মালিকানার বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। কারণ অনেক কর্পোরেট মালিকানা বা একটি গোষ্ঠী গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে। ফলে তাতে গণমানুষের কথা না উঠে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ধারণ করে। তাই কর্পোরেট মালিকানায় কতগুলো গণমাধ্যম থাকতে পারবে, তা নিয়ে আমাদের সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন। তিনি বলেন, গণমাধ্যম বিভিন্ন সময়ে সরকারি চাপের মধ্যে পড়েছে। তবে আমি মনে করি গণমাধ্যমের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপের পরিমাণ অনেকটাই কমে গেছে। বিশেষত আমার সময়েও সেটা অনেক কম ছিল। আমরা কোনো গণমাধ্যম বন্ধ করার পক্ষে নেই। কিন্তু তাদের ভেতরকার ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে আমরা কথা বলেছি।
গণমাধ্যমকে বাধাগ্রস্থ করার প্রধান শক্তি রাজনৈতিক দলগুলো: রাজনৈতিক দলগুলো গণমাধ্যমকে বাধাগ্রস্থ করার প্রধান শক্তি- বলে মন্তব্য করেছেন সম্পাদক পরিষদ এর সহ-সভাপতি ও নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবির। তিনি বলেন, সারাবিশ্বে যখন ঘটা করে গণমাধ্যম মুক্ত দিবস পালন করতে হয়, তখন বুঝতে হবে যে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখন খর্বিত হচ্ছে। বাংলাদেশে বিগত সময়ের চেয়ে এখন গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রার্থক্য সূচিত হওয়ার লক্ষণ দেখা গেছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার যে সূচক, বাংলাদেশ এখনো সেই সূচকে অনেক নিচে অবস্থান করছে। গণমাধ্যমকে বাধাগ্রস্থ করার প্রধান শক্তি রাজনৈতিক দলগুলো। তিনি আরও বলেন, ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলেও বিভিন্ন দেশের সাথে যে অসম চুক্তি রয়েছে, তা এখনও রিভিউ করার কোন উদ্যোগ দেখিনি। বরং আমরা দেখছি যে, যারা আন্দোলন করেছে, তারা ১৬ ডিসেম্বর মানে না- এর দায় কাদের? নারী সংস্কার কমিশন মানে না- এর দায় কাদের? একদিকে আমরা যেমন আশাবাদী হয়ে উঠছি, অন্যদিকে আবার আশঙ্কাও দেখছি। যে কোনো সংস্কারের বটম লাইন হবে- স্বাধীনতা। ’৭১ কে ধরেই সব ধরণের সংস্কার হতে হবে।
প্রশ্ন করার জন্য সাংবাদিকের চাকরি যায়, এমন দেশে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করছি: যে দেশে প্রশ্ন করার জন্য সাংবাদিকের চাকরি যায়, সে দেশে আমরা মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করছি। এর দায় সরকারকে দেব নাকি আর কাকে দেব জানি না এমন মন্তব্য করেছেন দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, গণমাধ্যম ছাড়া গণতন্ত্র চর্চা সম্ভব নয়। আমাদের কথা বলতে দিতে হবে, লিখতে দিতে হবে, প্রশ্ন করতে দিতে হবে। তাহলেই গণমাধ্যম মুক্তির স্বাদ পাবে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্যে আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকে লড়াই চালিয়ে যাবো। তবে স্বাধীনতার সীমা নির্ধারণ করা উচিত। প্রত্যেকের জবাবদিহিতা দরকার। গণমাধ্যম কতিপয় গোষ্ঠীর মালিকানার মাধ্যমে তাদের সেবা করার চর্চায় পরিণত হয়েছে। গণমাধ্যমের মালিকানার ক্ষেত্রে নীতিমালা দরকার, যেন একচেটিয়া মালিকানা না গড়ে উঠে। এমন কোন নীতিমালা থাকা যাবে না-যা গণমাধ্যমের গলা টিপে ধরে। ভয়হীন সমাজ তৈরি করতে চাই। রাষ্ট্র এমন কোনো আইন করতে পারবে না- যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করে। সাংবাদিকদের এথিক্যাল জার্নালিজমের জন্যে নীতিমালা থাকা উচিত। মব আক্রমণ চলছে। ভয়ের চোটে চাকরি চলে যাচ্ছে। রাষ্ট্র যদি মব আন্দোলন বন্ধ করতে না পারে, তাহলে রাষ্ট্রের অস্তিত্বই থাকে না।
সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দৈনিক বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনাম। আলোচনা সভায় রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। সম্পাদকদের মধ্যে বক্তব্য দেন দ্য নিউ এজের সম্পাদক নূরুল কবির, মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ও কালের কণ্ঠের সম্পাদক হাসান হাফিজ। আলোচনাসভায় আরও উপস্থিত ছিলেন দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, সমকালের সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলী, দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দিন প্রমুখ।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ