
সংশোধন হচ্ছে আইন
স্ত্রীর সঙ্গে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক করলে সেটা ‘যৌন নির্যাতন’
- আপলোড সময় : ২১-০৪-২০২৫ ০৪:৩২:৫১ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২১-০৪-২০২৫ ০৪:৩২:৫১ অপরাহ্ন


‘পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০’ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সংশোধিত আইনের অধ্যাদেশের খসড়া করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রণয়নের ১৫ বছর হলেও পারিবারিক সহিংসতা রোধে আইনটি সেভাবে প্রয়োগ করা যায়নি। তাই আইনটি সংশোধনের মাধ্যমে যুগোপযোগী করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। জানা যায়, আইনটি যুগোপযোগী করতে সাতটির মতো ধারা বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। বিভিন্ন ধারায় পরিমার্জন আনা ছাড়াও কমপক্ষে চারটি নতুন ধারা ও উপধারা যুক্ত করা হয়েছে খসড়া অধ্যাদেশে। খসড়া অনুযায়ী, স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন বা স্থাপনের চেষ্টাও যৌন নির্যাতন হিসেবে গণ্য হবে। পারিবারিক সহিংসতা সম্পর্কিত আবেদনের ৭ নয়, তিন কার্যদিবসের মধ্যে আদালত শুনানির তারিখ নির্ধারণ করবেন। দুই মাসের মধ্যে করতে হবে আবেদন নিষ্পত্তি। এছাড়া কোনো আদেশ লঙ্ঘনের শাস্তি বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে খসড়া অধ্যাদেশে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ বলেন, ‘পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইনটি আমরা পর্যালোচনা করছি। এটি সংশোধনের মাধ্যমে যুগোপযোগী করা হবে।’ মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ড. প্রকাশ কান্তি চৌধুরী বলেন, ‘সংশোধিত আইনের খসড়া করা হয়েছে। খসড়া চূড়ান্ত করতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এখন জাতীয়ভাবে বড় একটা পরামর্শ সভা করে খসড়াটি চূড়ান্ত করা হবে। এরপর আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ের বিষয়টি আছে। এসব প্রক্রিয়া অনুসরণের পর খসড়াটি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদনের জন্য উঠবে। এরপর এটি অধ্যাদেশ আকারে জারি হবে।’ সংশ্লিষ্টরা জানান, পারিবারিক সহিংসতা আইন প্রণয়নের ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এই আইনের সুফল মেলেনি। আইনটি সম্পর্কে বিচারক ও আইনজীবীদের মধ্যেও ধারণা কম। ভুক্তভোগীরাও অনেক সময় এ আইনে মামলা করতে আগ্রহী হন না। ২০১০ সালে আইনটি প্রণীত হলেও দেশের অনেক জেলায় চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গত এক দশকে এ আইনের অধীনে কোনো মামলা হয়নি বলে এর আগে বেসরকারি একটি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছিল। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন বাস্তবায়নের জন্য সচেতনতা তৈরি জরুরি। এ আইন বাস্তবায়নের কিছু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে আইনটি সংশোধন করা হচ্ছে। সচেতনতা সৃষ্টি, আইনটির বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব নতুন আইনে নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে। ‘পারিবারিক সহিংসতা’ শিরোনামে দ্বিতীয় অধ্যায়ে যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে সংশোধিত খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘যৌন নির্যাতন’ অর্থ যৌন প্রকৃতির এমন আচরণ, যা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির জন্য অনিরাপদমূলক, হুমকিস্বরূপ, অপরাধমূলক বা অপমানজনক বলে প্রতীয়মান হয়। যৌন নির্যাতন অর্থে স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন বা স্থাপনের চেষ্টাও অন্তর্ভুক্ত হবে।বর্তমান আইনে ‘যৌন নির্যাতন’ অর্থে যৌন প্রকৃতির এমন আচরণও অন্তর্ভুক্ত হবে, যা দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সম্ভ্রম, সম্মান বা সুনামের ক্ষতি হয়। ‘মানসিক স্বাস্থ্য আইন, ২০১৮’ এর ধারা ২ এর উপধারা ১৮ অনুসারে মানসিক সুস্থতায় বাধাগ্রস্ত করা এ আইনের আওতায় মানসিক নির্যাতন অন্তর্ভুক্ত হবে বলে সংশোধিত অধ্যাদেশের খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, প্রতিকার পাওয়ার জন্য সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদন পাওয়ার তিন কার্যদিবসের মধ্যে আদালত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আবেদন শুনানির তারিখ নির্ধারণ করবে। বর্তমান আইনে এই সময় ৭ কার্যদিবস। প্রতিটি আবেদন (ক্ষতিপূরণ আদেশের আবেদন ছাড়া) নোটিশ জারির তারিখ থেকে সর্বোচ্চ ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে আদালত নিষ্পত্তি করবে বলে খসড়া আইনে বলা হয়েছে। বর্তমান আইন অনুযায়ী কোনো কারণে ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে আবেদন নিষ্পত্তি করা না হলে অতিরিক্ত ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তি এবং এরপরে আরও সাত কার্যদিবস সময় নেওয়ার সুযোগ ছিল। এ সংশ্লিষ্ট দুটি উপধারা (২০ এর ২ ও ৩) বাতিল করা হয়েছে খসড়ায়। খসড়ায় বলা হয়েছে, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির পারিবারিক সম্পর্ক থাকার কারণে অংশীদারি বাসগৃহে বসবাসের অধিকার থাকবে। একজন বিধবা নারী তার মৃত স্বামীর অংশীদারি বাসগৃহে বসবাসের অধিকারী হিসেবে গণ্য হবেন।
যুক্ত হচ্ছে আরও যেসব বিষয়
১৭(খ) নতুন একটি ধারা যুক্ত করা হয়েছে। ‘কাউন্সিলিং’ উপ-শিরোনামে এ ধারায় বলা হয়েছে, আদালত উপযুক্ত মনে করলে মামলা চলাকালীন যে কোনো পর্যায়ে প্রয়োজনে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা প্রতিপক্ষ ব্যক্তিকে এককভাবে বা যৌথভাবে কাউন্সিলিংয়ের জন্য কাউন্সিলিং বিষয়ে দক্ষতা রয়েছে এমন সেবা প্রদানকারী সংস্থার কাছে পাঠাতে পারবেন। ‘শিশু ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির বিশেষ অধিকার সংরক্ষণ’ শিরোনামে তিনটি উপধারা নিয়ে ১৮(ক) ধারা যুক্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়, আবেদন নিষ্পত্তি বা কার্যক্রমের প্রত্যেকটি পর্যায়ে আদালত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য উপযোগী পরিবেশ এবং ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবে। আবেদন নিষ্পত্তি বা কার্যক্রমের প্রত্যেকটি পর্যায়ে আদালত জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ নিশ্চিত করবে। এ বিষয়ে সরকার যথাযথ বিধি প্রণয়ন করবে বলে সংশোধিত খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। সংশোধিত আইনের খসড়ায় সরকারের দায়িত্ব নামে একটি ধারা যুক্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়- আইন বাস্তবায়নে সরকার নিম্নলিখিত ব্যবস্থা নেবে- এই আইনে উল্লিখিত বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে প্রয়োগকারী কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা, বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ও সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেবে। পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় করবে ও এ কার্যক্রমের পর্যালোচনা এবং মূল্যায়ন করবে। পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুর সুরক্ষায় তহবিল গঠন করবে এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক আশ্রয় নিবাস স্থাপন করবে। আইনের বিধানের ব্যাপক প্রচার নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত বিরতিতে টেলিভিশন, রেডিও ও গণমাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে প্রচারণা চালাবে।
বাতিল হচ্ছে আরও যেসব ধারা
বর্তমান আইনে বসবাসের আদেশের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত নিম্নরূপ বসবাস আদেশ দিতে পারবে-১৫(ক) সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যে অংশীদারি বাসগৃহে বা এর যে অংশে বসবাস করেন সেই গৃহে বা অংশে প্রতিপক্ষকে বসবাস করার বা যাতায়াত করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ। নতুন আইনে এই ধারাটি বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বর্তমান আইনের ১৫(৫) ধারা বিলুপ্তির সুপারিশ করা হয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে- প্রতিপক্ষকে জামানতসহ বা জামানত ছাড়া এই মর্মে মুচলেকা সম্পাদনের (আদালত) আদেশ দিতে পারবে যে তিনি বা তার পরিবারের জন্য কোনো সদস্য ভবিষ্যতে পারিবারিক সহিংসতামূলক কাজ করবে না। ১৬(৫) ধারায় বলা হয়েছে, আদালত সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ও তার সন্তানের ভরণপোষণের জন্য যেমন জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত তেমন জীবনযাত্রার জন্য পর্যাপ্ত ও যুক্তিযুক্ত অর্থ দেওয়ার জন্য প্রতিপক্ষকে আদেশ দিতে পারবে। এই ধারাটিও বিলুপ্তির সুপারিশ করা হয়েছে আইনের খসড়ায়। ১৬(১০) ধারাও বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে এই ধারার অধীন দেওয়া ক্ষতিপূরণ আদেশের অর্থ ‘পাবলিক ডিমান্ড রিকভারি অ্যাক্ট, ১৯১৩’ এর বিধান অনুযায়ী আদায় করা যাবে। বর্তমান আইনে ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, আদালতের কাছে উপযুক্ত বলে বিবেচিত না হলে প্রতিপক্ষকে সুরক্ষা আদেশ না মানার শাস্তি না দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের সমাজ কল্যাণমূলক কাজে সেবা দেওয়ার জন্য আদেশ দিতে পারবে। এ সেবার বিষয়টি তত্ত্বাবধানের জন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া যাবে। সংশোধিত আইনে এ ধারাটি বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমান আইনে ‘সরেজমিনে তদন্ত’ শিরোনামে ২৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো আবেদন নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আদালত পক্ষগুলোকে জানিয়ে ঘটনার সত্যতা নিরূপণের জন্য সরেজমিনে তদন্তের আদেশ দিতে পারবে এবং এ তদন্তকাজ আদালতের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। তবে নতুন আইনের খসড়ার ‘কল্যাণ রিপোর্ট ইত্যাদি’ শিরোনামে ২৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো আবেদন নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আদালত কার্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে পক্ষগুলোকে জানিয়ে একজন উপযুক্ত বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির মাধ্যমে ‘কল্যাণ রিপোর্ট’ প্রস্তুত করার আদেশ দিতে পারবে। ওই বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির যোগ্যতা, কল্যাণ রিপোর্টের নমুনা ও তার বিষয়বস্তু বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে।
শাস্তি বাড়ছে
সুরক্ষা আদেশ লঙ্ঘনের শাস্তির বিষয়ে বর্তমানে আইনে বলা হয়েছে, প্রতিপক্ষের সুরক্ষা আদেশ বা এর কোনো শর্ত লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ছয় মাস কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধ আবার করলে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে। সংশোধিত আইনে বলা হয়েছে, কোনো আদেশ (যেমন- সুরক্ষা আদেশ, বসবাস আদেশ, ক্ষতিপূরণ আদেশ, সন্তানের সাময়িক তত্ত্বাবধান আদেশ) বা আদেশের কোনো শর্ত প্রতিপক্ষ লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ এক বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড পেতে হবে। একই অপরাধ আবার করলে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে। বর্তমান আইনে মিথ্যা আবেদন করার শাস্তি সর্বোচ্চ এক বছরের জেল বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। সংশোধিত খসড়ায় বলা হয়েছে, মিথ্যা আবেদন করার শাস্তি ছয় মাসের জেল বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। তবে শর্ত রয়েছে, শুধু আবেদন প্রমাণে ব্যর্থ হলেই তাকে মিথ্যা আবেদন বলে গণ্য করা যাবে না। বরং আবেদনকারীর বিরুদ্ধে যে কোনো সুপারিশের আগে তার বিদ্বেষপূর্ণ অভিপ্রায় আইনানুগভাবে তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণিত হতে হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ