
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
পার্বত্য চট্টগ্রামে পানির তীব্র সংকট পাহাড়ে জনজীবন বিপর্যয়
- আপলোড সময় : ১৬-০৪-২০২৫ ০৩:৩২:০৪ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৬-০৪-২০২৫ ০৩:৩২:০৪ অপরাহ্ন


প্রাকৃতিক উৎসের অফুরন্ত পানিকে কেন্দ্র করে মুখর ছিল পাহাড়ের জনজীবন। তবে কয়েক বছর ধরে চিত্র ভিন্ন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এ তিন জেলার জনজীবন। এছাড়া তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ে যাচ্ছে খেতের ফসল। বিশেষজ্ঞরা জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এ তিন জেলায় তাপমাত্রা বেড়েছে। এতে ছোট ছোট ঝিরি-ঝরনা শুকিয়ে গেছে। সরজমিনে দেখা যায়, এ সংকটে পান, নিত্যব্যবহার ও কৃষির জন্য পানির অভাবের পাশাপাশি বর্ষবরণের পানিকেন্দ্রিক নানা উৎসবও ব্যাহত হচ্ছে পাহাড়ে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বান্দরবান সদর উপজেলার রেইছা ইউনিয়নের রেইছা খালটি শুকিয়ে গেছে। এ খাল থেকে একসময় স্থানীয়রা পানি সংগ্রহ করে পান ও কৃষিকাজে ব্যবহার করত। কিছু জায়গায় পানি দেখা গেলেও পুরো খালে পানির অস্তিত্ব নেই। ফলে বিপদে পড়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। স্থানীয়রা জানান, পানির উৎসগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় তিন জেলার কোনো কোনো এলাকায় তিন-পাঁচ বছর ধরে মারমা সম্প্রদায়ের সাংগ্রাই উৎসবে ঐতিহ্যবাহী পানি খেলার আয়োজন বন্ধ রয়েছে। আবার কোনো কোনো এলাকায় বিকল্প উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করে নিজেদের ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তারা।
বান্দরবানের রুমা উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের তংমক পাড়া। থোওয়াইব ঝিরিকে কেন্দ্র করে শতাধিক বছর আগে পাড়াটি গড়ে ওঠে। বর্তমানে পাড়াটিতে ৬৫টি পরিবার রয়েছে। পাড়া হওয়ার পর থেকে প্রতি বছর সাংগ্রাই উৎসবে পানি খেলা অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু চলমান মৌসুমে থোওয়াইব ঝিরির পানি শুকিয়ে গেছে। পানির অভাবে চার বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী পানি খেলা বন্ধ রয়েছে। একইভাবে পাইন্দু ইউনিয়নের পলিসে ঝিরিনির্ভর মোয়ালপিপাড়া ও ক্যলুংখ্যং ঝিরিনির্ভর পলিতং পাড়ায়ও তিন-চার বছর ধরে পানি খেলার আয়োজন করতে পারছে না পাড়াবাসী।
এ বিষয়ে পাইন্দু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উহ্লামং মারমা বলেন, ওই তিনটি পাড়ায় প্রাকৃতিক পানির উৎসনির্ভর বিকল্প পানি প্রযুক্তি গ্র্যাভিটি ফ্লো সিস্টেম (জিএফএস) স্থাপনের লক্ষ্যে কয়েক বছর ধরে উন্নয়ন বোর্ড ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরে ধরনা দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সাড়া মিলছে না। পানির অভাবে আরো বেশি সময় ধরে সাংগ্রাই উৎসবে পানি খেলা বন্ধ হয়ে গেছে থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নের ক্যবুপাড়ায়। রেমায় ফ ঝিরির পানি শুকিয়ে যাওয়ায় এ অবস্থা হয়েছে। এ ঝিরির তীরবর্তী ছয়টি মারমা, ত্রিপুরা ও ম্রো জনগোষ্ঠী মিলিয়ে ১৪টি পাড়া রয়েছে। খাওয়ার পানির চরম সংকটে ভুগছে ওই ১৪টি পাড়ার মানুষ। একইভাবে থানচি সদরের তংক্ষ্যংপাড়া ও বলিপাড়া ইউনিয়নের চেমাখ্যংয়ের তীরবর্তী ক্যচুপাড়াসহ খালনির্ভর অন্যান্য পাড়াবাসীও পানি সংকটে ভুগছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পানি সংকট ও মাত্রাতিরিক্ত তাপপ্রবাহের ফলে তাদের জমির ফসল পুড়ে যাচ্ছে। বান্দরবান সদরের রেইছা ইউনিয়নের লাচা ম মারমা বলেন, এ বছর ভুট্টা, ঢেঁড়স ও এক কানি জমিতে ধান চাষ করেছি। কিন্তু পানির অভাবে কিছুই হয়নি। ভুট্টা গাছে ফুল ফোটার পর পরই তা পুড়ে যায়। এছাড়া ধান ও ঢেঁড়স গাছ অকালেই অপরিপক্ব অবস্থায় পানির অভাবে ও তীব্র রোদে পুড়ে গেছে। আমরা নিজেরাই পানি খাইতে পাই না। খালের মধ্যে অনেক গর্ত করে রেখেছি। সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করে খেয়ে কোনো রকম জীবনযাপন করছি।
একই ইউনিয়নের আরেক কৃষকের নাম আহমদ কবির। বেগুন খেতের পাশে মন খারাপ করে বসে ছিলেন। তিনি জানান, এবার ২০ হাজার টাকা ঋণ করে এক কানি জমিতে বেগুন চাষ করেছেন। কিন্তু গরমে ও পানির অভাবে ফসল উৎপাদন হয়নি। তিনি বলেন, ধারদেনা করে কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করি। ফসল ফলানোর পর আমরা কিছু সংগ্রহে রাখি আর কিছু বিক্রি করি। কিন্তু এবার পানি সংকট এত বেশি যে কোনো ফসল হয়নি। সব গাছ পুড়ে গেছে। যে কয়েকটা বেগুন ধরেছে, সেগুলো রোদে পুড়ে লাল হয়ে গেছে। পোকায় খেয়ে ফেলেছে। এসব তো আর বিক্রি করা বা খাওয়া যাবে না। এখন আমি ঋণের টাকা শোধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। একই চিত্র দেখা যায় রাঙ্গামাটিতেও। দুর্গম পাহাড়ি গ্রামগুলোয় সুপেয় ও ব্যবহার্য পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। গ্রীষ্মের তাপপ্রবাহের আগেই শুকিয়ে গেছে পাহাড়ি ছড়া, ঝরনা ও নালা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার জুরাছড়ি ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কুকিছড়া, ত্রিপুরাপাড়া, জনতাপাড়া, বারুদগলা, সোহেলপাড়ায় ২৪৭টি পরিবারের বাস। তাদের পেশা কৃষিকাজ (জুম চাষ)। সেখানে নিরাপদ পানির জন্য নলকূপ নেই। এসব পাড়ার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পানছড়ি ছড়া। এর ছোট ছোট শাখা রয়েছে। তবে গ্রামের ছড়াগুলো শুকিয়ে মরা ছড়ায় পরিণত হয়েছে। গ্রীষ্মকাল বা শুষ্ক মৌসুমে গ্রামের লোকজনের একমাত্র ভরসা কুয়ার পানি। তবে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় কুয়ার পানিও পাওয়া যাচ্ছে না।
স্থানীয়রা বলছেন, পাড়াগুলো পাহাড়ের চূড়ায় হওয়ায় প্রায় ৫০০-৮০০ ফুট নিচে নামার পর ছোট ঝিরি বা ঝরনার দেখা মেলে। ঝিরিগুলোয় এ সময়ে পানি নেই বললেই চলে। তবু এর ওপরই ভরসা করতে হচ্ছে পাড়ার মানুষকে। আগের মতো বড় ও পানিধারণ সক্ষমতাসম্পন্ন বৃক্ষ না থাকায় শুষ্ক মৌসুমে ছোট ঝিরি বা ঝরনাগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য অরুণ চাকমা বলেন, গরমে পাহাড়ে মানুষের জীবনযাপন অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে পানি সংকট পরিস্থিতি আরো খারাপ করে তুলেছে। জুরাছড়ি ইউনিয়নের কুকিছড়া, সোহেলপাড়ার প্রধান কিরণ জয় চাকমা বলেন, শুষ্ক মৌসুম এলেই এলাকায় পানি সংকট চরম আকার ধারণ করে। নারীরা প্রতিদিন পাড়া থেকে কয়েকশ’ ফুট নিচে নেমে পানি সংগ্রহ করেন।
স্থানীয় বাসিন্দা মল্কা বানু চাকমা ও রঞ্জিতা চাকমা বলেন, গ্রীষ্মকাল এলেই গোসলের কথা ভুলে যেতে হয়। দুই-তিনদিন পর গোসল করতে পারি। তাও আবার এক-দুই লিটার পানি দিয়েই গোসল সারতে হয়। নিরাপদ পানি সংকট চলছে জুরাছড়ির বনযোগীছড়া ইউনিয়নের বালিশপাড়া, ছোট পানছড়ি, এরাইছড়ি; মৈদং ইউনিয়নের আমতলা বাদলহাটছড়া, জামুরাছড়ি, কাঁঠালতুলি ও দুমদুম্যা ইউনিয়নে করল্যাছড়ি, দুলুছড়ি, শিমাইতুলি ও তেছড়িতেও।
দীর্ঘদিন ধরে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পে কাজ করেছেন উন্নয়নকর্মী পলাশ খীসা। জানতে চাইলে তিনি বলেন, জুরাছড়ির এসব গ্রামে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নিরাপদ পানির সংকটের পাশাপাশি কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। তীব্র গরম ও পানি সংকটে গবাদিপশুর মৃত্যুও বাড়ছে।
পার্বত্য এলাকায় সেগুন চাষ হয় ব্যাপক আকারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সেগুন গাছ প্রচুর পানি শোষণ করায় পানির স্তর নিচে নামছে। সেগুন মূলত মনোকালচার পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। এ গাছের ছায়া যেখানটায় পড়ে, সেখানে অন্য কোনো বৃক্ষ জন্মাতে পারে না। জন্মালেও বেড়ে উঠতে পারে না। সেগুন গাছ কাঠের জন্য উপযোগী হলেও পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।
জুরাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইমন চাকমা বলেন, ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে গ্রীষ্মকাল এলেই পানির সংকট দেখা দেয়। এ সময় পানিবাহিত রোগের বিস্তারও বেড়ে যায়। গাছপালা কেটে ফেলা ও বাণিজ্যিকভাবে সেগুন গাছ রোপণের কারণে পানির স্তর দিন দিন নেমে যাচ্ছে। পানি সংকট নিরসনে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরসহ বিভিন্ন উন্নয়ন দফতরে গ্র্যাভিটি-ফ্লো-সিস্টেম (জিএফএস), সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে পাতকুয়া থেকে পানি সরবরাহ প্রকল্পের প্রস্তাব পাঠানো হলেও বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর জুরাছড়ি উপজেলার দায়িত্বরত উপসহকারী প্রকৌশলী রকি দে বলেন, দুর্গমতার কারণে এসব এলাকা এখনো পিছিয়ে। তবে পানি সংকট নিরসনে অধিদফতর থেকে রিং ওয়েল ও গ্র্যাভিটি-ফ্লো-সিস্টেম (জিএফএস) প্রকল্পের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক এমএম শাহ নেওয়াজ বলেন, পুরো বান্দরবানে এখন পানির সংকট। ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিলে এ সমস্যা তীব্র হয়। আমবাগানে পানি দিতে না পারায় অনেক গাছ শুকিয়ে গেছে। এ সমস্যা থেকে উদ্ধার হবে বৃষ্টি নামলে। কিন্তু আগে যে সময়ে বৃষ্টি হতো এখন তার চেয়ে দেরিতে হয়। ফলে কৃষিতে এর সরাসরি প্রভাব পড়ে। তিনি আরো বলেন, এ সংকট মোকাবেলার জন্য বড় পরিকল্পনা করতে হবে। মানুষকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে উৎসাহিত করতে হবে। যদি পরিকল্পিতভাবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যায় তাহলে পানির সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান বলেন, পানি সংকটের পেছনে দু’টি প্রধান কারণ রয়েছে। এগুলো হলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং পরিবেশবিধ্বংসী কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে বন উজাড়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বেড়েছে। এর ফলে বাষ্পীভবন হচ্ছে। এর প্রভাবে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত জলাধারগুলো দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে পাহাড়ে বৃক্ষ নিধনের ফলে পানি চক্রের স্বাভাবিকতা ব্যাহত হচ্ছে। বড় গাছগুলো পানি সংরক্ষণ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এসব গাছ উজাড় হওয়ার ফলে পানি চক্র পাল্টেছে, যার প্রভাব পাহাড়ি অঞ্চলের পাদদেশে অবস্থিত সমতল এলাকায়ও পড়ছে। তিনি জানান, যেহেতু কৃষির ওপর মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্ভরশীল, তাই পানি সংকট মোকাবেলায় টেকসই পানি সংরক্ষণের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এর মাধ্যমে পানি সংকটের কার্যকর সমাধান হওয়া সম্ভব।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ