ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান দিবস আজ। ১৯৬৯ সালের এদিনে বাঙালির স্বাধিকার আদায়সহ পাকিস্তানি স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খানবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মতিউর রহমানসহ পাঁচজন শহীদ হন। তাদের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলনসহ স্বাধীনতা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয়।
এ দেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান তাৎপর্যপূর্ণ মাইলফলক। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ ও বঞ্চনা থেকে বাঙালিকে মুক্ত করতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা করেন। এতে স্বাধিকার আন্দোলনের গতি তীব্রতর হলে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে। এর বিরুদ্ধে ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক-জনতার দেশব্যাপী দুর্বার ও স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলন শুরু হয়।
এক পর্যায়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি ঢাকায় হরতালের ডাক দেয়। এই হরতাল চলাকালে সচিবালয়ের সামনে শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে বকশীবাজার নবকুমার ইনস্টিটিউটের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান রাজপথের চার সঙ্গীর সঙ্গে শহীদ হন। এর আগে ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে আসাদুজ্জামান আসাদ শহীদ হওয়ায় গোটা পূর্ব পাকিস্তান এমনিতেই বিক্ষোভে তেঁতে ছিল। ২৪ জানুয়ারি মতিউরদের আত্মত্যাগের মধ্যদিয়ে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন দুর্বার গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ডাকসুর তৎকালীন ভিপি ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে ছাত্রসমাজের পাশাপাশি রাজপথে নামে বিক্ষুব্ধ বাঙালি। অবশেষে গণঅভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুসহ রাজবন্দিদের মুক্তি দেয়ার পাশাপাশি নিজেও পদত্যাগে বাধ্য হন।
এরই ধারাবাহিকতায় ’৭০-এর নির্বাচনে বাঙালির অবিস্মরণীয় বিজয়, ’৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চের গণহত্যা ও ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার পথ ধরে তার নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যায়। ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণী দিয়েছেন। পৃথক বাণীতে গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদনসহ তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন তারা।
গণ-অভ্যুত্থান দিবস বাংলাদেশের স্বাধীকার আন্দোলনের ইতিহাসে অনন্য সাধারণ দিন : রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছেন, গণ-অভ্যুত্থান দিবস বাংলাদেশের স্বাধীকার আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার ইতিহাসে এক অনন্য সাধারণ দিন। গণ-অভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার দেয়া এক বাণীতে তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। তিনি বলেন, ঊনসত্তরের ২৪ জানুয়ারি শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়ন বন্ধ ও পাকিস্তানি সামরিক শাসন উৎখাতের দাবিতে কারফিউ ভঙ্গ করে রাজনীতিক-ছাত্র-শিক্ষক-জনতা মিছিল বের করে। মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন ঢাকাস্থ নবকুমার ইনস্টিটিউশন স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমানসহ আরো অনেক সংগ্রামী প্রাণ। ১৯৬৯ সালের এই দিনে দেশের স্বাধিকার আন্দোলনে যারা শহিদ হয়েছেন, তাদের স্মৃতির প্রতি তিনি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে শহিদ মতিউরসহ অন্যান্য শহিদের রক্ত বৃথা যায়নি উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পথ ধরে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার। জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানসহ দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান যুগিয়েছে অমিত প্রেরণা। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ ধরে অর্জিত এই স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। তিনি শহিদ মতিউরসহ দেশের মুক্তি সংগ্রামের সকল শহিদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায় : প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। গণঅভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার দেয়া এক বাণীতে তিনি বলেন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফা, পরবর্তীকালে ১১ দফা ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি মহান স্বাধীনতা। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ১৯৬৯ সালের পুরো জানুয়ারি ছিল আন্দোলনে উত্তাল। পাকিস্তানি সামরিক শাসন উৎখাতের সংকল্প নিয়ে ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সংগ্রামী জনতা শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়ন ও সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে মিছিল বের করেন। মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউটের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক এবং মকবুল, আনোয়ার, রুস্তম, মিলন, আলমগীরসহ অনেকে শহিদ হন। অপশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে। এই মহান দিনটির স্মরণে শহিদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফলে অর্জিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারসহ সকলের দায়িত্ব হলো সেই মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, যাতে আমরা একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি। প্রধান উপদেষ্টা শহিদ মতিউরসহ দেশের মুক্তি সংগ্রামের সকল শহিদের রূহের মাগফেরাত কামনা করেন।
দিবসটিকে গুরুত্ব দিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে গণমাধ্যমে এক বিবৃতি পাঠিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ২৪ জানুয়ারি আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর ১৯৬৯ সালের এই দিনে তদানীন্তন পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। গণআন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে তা গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছিল। পতন নিশ্চিত হয়েছিল সামরিক স্বৈরশাসকের। আর এরই ধারাবাহিকতায় প্রশস্ত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পথ। তারেক রহমান বলেন, গণঅভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্যই ছিল স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন, বহুদলীয় রাজনৈতিক কার্যক্রম, বহুমত এবং চিন্তার চর্চা ও মানুষের নাগরিক স্বাধীনতা ফিরে পাওয়া। আমাদের জাতীয় জীবনে ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থানের তাৎপর্য অপরিসীম। সুতরাং আজকের এ মহান দিনে আমি স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র এবং মানুষের মৌলিক ও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাই।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান দিবস আজ
- আপলোড সময় : ২৪-০১-২০২৫ ০২:৩৮:৩৯ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৪-০১-২০২৫ ০২:৩৮:৩৯ অপরাহ্ন
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ