* পুরো বিচার বিভাগ সংস্কারে রোডম্যাপ ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি
* সংস্কার যুগোপযোগী করতে রোডম্যাপ ঘোষণা
* জুডিসিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল
* বছরের শুরুতেই আরও একটি হটলাইন যুক্ত
* কাগজমুক্ত বিচারকাজ চালু ও সম্প্রসারণ
সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা পদ্ধতি সংস্কার নিয়ে উচ্চ আদালতের রায়ের পর আন্দোলন শুরু। এরপর জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে বিজয় লাভ। টানা ৩৬ দিনের আন্দোলনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এর পরপরই ছাত্রদের তোপের মুখে সাবেক প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ছয়জন পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়ার পর প্রধান বিচারপতি হিসেবে বেশ কয়েকজনের নাম আলোচনায় উঠে আসলেও শেষ পর্যন্ত নিয়োগ পান ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। পুরো বিচার বিভাগ সংস্কার করে নতুন করে ঢেলে সাজানোর রোডম্যাপ ঘোষণা করেন তিনি। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তার এই রোডম্যাপ বাস্তবায়িত হলে জনগণের জন্য সুফল বয়ে আনবে।
জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকারের পতনের পর পর দেশজুড়ে বিচার অঙ্গনে দায়িত্বরত সকল সরকারি আইনজীবীরা (পিপি) পদত্যাগ করেন। তাদের পদত্যাগের পর পরই নতুন করে দায়িত্ব নেয় বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবীগণ। তবে আইন অঙ্গনে ব্যাপক রদবদলসহ নানান উদ্যোগ নিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। চলতি বছর বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ করে আলাদা সচিবালয়, বিচার বিভাগের সর্বস্তরে ডিজিটালের ছোঁয়া অর্থাৎ ই-জুডিসিয়ারি, বিচারক নিয়োগ ও অপসারণের নীতিমালাসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, যা নতুন বছরে জনগণের বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা ফেরাতে সহায়তা করবে। ২০২৪ সালের ১১ আগস্ট দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথগ্রহণ করেন বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি দেশের বিচার বিভাগের মানোন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেন। গত ২১ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ইনার কোর্ট ইয়ার্ডে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা, সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং দেশের জেলা আদালতগুলোর বিচারকদের উপস্থিতিতে বিচার বিভাগ সংস্কার যুগোপযোগী করতে রোডম্যাপ ঘোষণা করেন তিনি। রোডম্যাপে অন্য বিষয়ের সঙ্গে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের জন্য একটি স্বাধীন জুডিসিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল গঠন করার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। নতুন বছরে প্রধান বিচারপতি, সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টসহ বিচার বিভাগের পরিকল্পনা বা প্রত্যাশার কথা জানান সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোছাইন। তিনি বলেন, নতুন বছর হবে দেশের বিচার অঙ্গনের জনআকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশার বছর। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের নীতিমালার বিষয়ে আইন আকারে বা অধ্যাদেশ আকারে নতুন একটা কিছু হবে বলে প্রত্যাশা করছি। সেটা এ বছরই হবে। আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। পৃথক সচিবালয় বা প্রাতিষ্ঠানিক স্বতন্ত্রীকরণের বিষয়েও প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। বিচারকদের পদায়ন সংক্রান্ত নীতিমালাও আমরা প্রস্তুত করছি। প্রধান বিচারপতি প্রত্যেক বিভাগে সফর করে বিচারক, আইনজীবী ও অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। এছাড়া ই-পেপার চালু করাকে টপ-প্রায়োরিটি দেয়া হবে। আমরা যেভাবে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে পেপার মুক্ত ই-পেপার চালু করেছি তেমনি সারাদেশে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবো। এই বিচারক আরও বলেন, বিচার বিভাগে যদি আলাদা সচিবালয় হয়ে যায় তাহলে গত ৫০ বছরের জুডিসিয়ারির চাওয়া বা প্রত্যাশা অনেকটাই পূরণ হবে বলে মনে করি। এছাড়া বিচার বিভাগের সর্বস্তরে দুর্নীতি দূর করা, গুরুত্বপূর্ণ ও পুরোনো ডেথ রেফারেন্স শুনানি, মামলাজট কমাসহ আরও বেশ কিছু বিষয় বেশ গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে বলেও জানান তিনি।
সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ‘জুডিসিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল’ বা ‘বিচার বিভাগীয় নিয়োগ পরিষদ’ গঠনে গত বছরের ২৮ নভেম্বর আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। সেদিন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের গণসংযোগ কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলামের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগ সংস্কারে গত ২১ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি যে রোডম্যাপ (রূপরেখা) তুলে ধরেন, তাতে অন্য বিষয়ের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়। সেই ধারাবাহিকতায় সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন দেশের সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত আইন, বিধি-বিধান, উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত, প্রথাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে বিষদ গবেষণা করে একটি প্রস্তাব (২৮ নভেম্বর) আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। প্রস্তাবে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি ‘জুডিসিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল’ গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশের উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন বা কাউন্সিল রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় বিজ্ঞপ্তিতে। এতে আরও বলা হয়, গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে বিচারক হতে ইচ্ছুক প্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদন বা দরখাস্ত আহ্বান করার উল্লেখ রয়েছে প্রধান বিচারপতির প্রস্তাবে। এছাড়া প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের বিষয়ে মতামত বা পরামর্শ গ্রহণের জন্য কাউন্সিল সংশ্লিষ্ট যে কোনো ব্যক্তিকে কাউন্সিলের সভায় আহ্বান করতে পারবে। শুধু তাই নয়, কাউন্সিল যে কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে প্রার্থী সম্পর্কে তথ্য নির্দেশ দিতে পারবে বলে প্রস্তাবে উল্লেখ রয়েছে। এই কাউন্সিল গঠন করা হলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। এরপর গত ১৬ জানুয়ারি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৫’ এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়।
বিচারপ্রার্থীদের দ্রুত ও নির্বিঘ্নে বিচারিক সেবা দিতে দু’টি হেল্পলাইন নম্বর চালু করেছে সুপ্রিম কোর্ট। আগের হেল্পলাইন নম্বর ০১৩১৬১৫৪২১৬ এর পাশাপাশি নতুন ০১৭৯৫৩৭৩৬৮০ হেল্পলাইন নম্বরটিতে বিচার বা সেবা প্রার্থীরা তাদের অভিযোগ, পরামর্শ জানাতে পারবেন। বিচারপ্রার্থী ও বিচার বিভাগের জন্য প্রধান বিচারপতির নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের অন্যতম হলো হেল্পলাইন চালু। শুধু তাই নয়, সুপ্রিম কোর্টে হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চে সম্পূর্ণ কাগজমুক্ত (পেপার ফ্রি) বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা গত ৫ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়। সব কাগজ অনলাইনে জমা প্রদানের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম প্রস্তুত করে পেপার ফ্রি বিচারিক কার্যক্রম শুরু একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব তত্ত্বাবধান ও উদ্ভাবনে ওই বেঞ্চের সব কাগজ অনলাইনে জমা প্রদানের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম প্রস্তুত করা হয়। ২০২৫ সালে পর্যায়ক্রমে সুপ্রিম কোর্টের অন্য বেঞ্চগুলোতেও পেপার ফ্রি কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা প্রধান বিচারপতির রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে দেশের জেলা আদালতগুলোতেও সম্পূর্ণ পেপার ফ্রি বিচারিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে বলে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ আশা প্রকাশ করেন। ঘোষিত রোডম্যাপের আলোকে ই-জুডিসিয়ারি বাস্তবায়নে প্রধান বিচারপতি বদ্ধপরিকর। দেশের উচ্চ আদালত ও জেলা আদালতগুলোর বিচারপ্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে ই-জুডিসিয়ারির আওতায় আনতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এছাড়া বিচার বিভাগে মেধার চর্চার বিকাশ বৃদ্ধিতে প্রধান বিচারপতি ফেলোশিপ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়নের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। ২০২৫ সালের প্রথম দিকেই এ প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হতে পারে।
বিচার বিভাগ মূলত দেশের জনগণের সেবার জন্যই গঠন করা হয়েছে। তাই বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা কী এবং সেই প্রত্যাশা পূরণে বিচার বিভাগের কী করণীয় সে সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের উদ্দেশ্যে এ বছর দেশের সব বিভাগীয় শহরে অবস্থিত আদালতগুলোতে স্টেকহোল্ডার মিটিং আয়োজন করবে। সেই মিটিংয়ে অংশগ্রহণের ইচ্ছা প্রধান বিচারপতির রয়েছে। এরইমধ্যে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে স্বাধীন কাউন্সিল গঠন, অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদায়ন নীতিমালা প্রণয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এছাড়া ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ আবেদন চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল পুনর্গঠিত হয়েছে এবং সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল বর্তমানে পূর্ণ গতিতে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই ১২ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্টে প্রতি মাসে প্রধান বিচারপতির সভাপতিত্বে মনিটরিং সভা হচ্ছে। সভায় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাদের নিজ নিজ দফতরে সেবা সহজীকরণে নেয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে প্রধান বিচারপতিকে অবহিত করেন।
বিচার বিভাগ নিয়ে প্রধান বিচারপতির উদ্যোগের বিষয়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মো. আব্দুল জাব্বার ভূইয়া বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৪ বছরেও বিচার বিভাগ স্বাধীন ও স্বচ্ছভাবে কাজ করতে পারেনি। দুর্নীতি ও প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি। প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগ পৃথকীককরণ করে আলাদা সচিবালয়, বিচার বিভাগের সর্বস্তরে ডিজিটালের ছোঁয়া অর্থাৎ ই-জুডিসিয়ারি, বিচারক নিয়োগ ও অপসারণের নীতিমালাসহ বেশ কিছু মহৎ উদ্যোগ নিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে নেবেন, যা জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করবে।
প্রধান বিচারপতির বিভিন্ন উদ্যোগের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ও সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, আমি মনে করি বিচার বিভাগ যুগোপযোগী করতে এবং স্বচ্ছ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে সুপ্রিম কোর্টসহ বিচার বিভাগ নিয়ে প্রধান বিচারপতির উদ্যোগ প্রশংসনীয় এবং সুফল বয়ে আনবে। একইকথা জানিয়েছেন অন্তত্ব আরও ১২ জন আইনজীবী।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
ঢেলে সাজানো হচ্ছে বিচার বিভাগ
- আপলোড সময় : ২২-০১-২০২৫ ০৬:৫১:৫১ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২২-০১-২০২৫ ০৬:৫১:৫১ অপরাহ্ন
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ