বাংলাদেশে কর্মের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারছে না দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যাবস্থা। এজন্য দিনকে দিন শিক্ষিত ও তরুণ বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলছে। বিশেষ করে দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারের চাপ আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়ছে। এতে সম্ভাবনাময় জনগোষ্ঠীর মধ্যে একদিকে বাড়ছে হতাশা, অপরদিকে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট বা জনমিতির সুবিধা থেকে। সর্বশেষ গতকাল রোববার এই কথা শিকার করেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। গতকাল রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘উচ্চশিক্ষায় বৈশ্বিক মান : বাংলাদেশের করণীয়’ শীর্ষক এক সেমিনারে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, দেশে উচ্চশিক্ষার পরিবেশ ক্রমাগতভাবে নিচে নেমেছে। এর পেছনে রয়েছে-শিক্ষকদের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি, ছাত্র রাজনীতির নামে দুর্বৃত্তায়ন। পাশাপাশি শিক্ষক নিয়োগে প্রচণ্ড অনিয়মও দায়ী। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভঙ্গুর করে দেয়া হয়েছে। শিক্ষকদের আলোচনায় গবেষণা নয়, শুধু রাজনীতি থাকে। এমন পরিস্থিতি তৈরির কারণগুলোকে আমলে নিয়েই এগোতে হবে। এরআগে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ (বিবিএস) বিভিন্ন সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও এমন চিত্র উঠে এসেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষিত তরুণরা বেকার থাকায় রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি সম্পদের অপচয় হচ্ছে। ফলে দক্ষতা বৃদ্ধি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষার মান বাড়িয়ে বাস্তব কাজের সঙ্গে সংযুক্ত করার এখনই সময়। এ বিষয়ে কথা হয় ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে. মুজেরী এর সঙ্গে। তিনি বলেন, শিক্ষিত ও তরুণ বেকার বৃদ্ধির বিষয়টি উদ্বেগজনক। কেননা যারা শিক্ষিত তারা যে কোনো কাজ করতে পারেন না। তারা চান প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা সোভন কাজ। কিন্তু আমাদের দেশে ৮৫ শতাংশ কর্মসংস্থানই অপ্রাতিষ্ঠানিক। এখানে বেতন ও সুযোগ-সুবিধা কম। ফলে তারা বেকার থাকছেন। দেশের শিক্ষাকর্মের বাজারের চাহিদা উপযোগী নয়। এতে এখানে একটা মিস ম্যাচ আছে। কিন্তু শিক্ষার হার বাড়ছে, ফলে শিক্ষিত বেকার বাড়তেই থাকবে। এজন্য শিক্ষাকে বাস্তবমুখী করা দরকার। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি করতে হবে। তিনি বলেন, যারা শিক্ষা গ্রহণ করছে তারা তো ব্যক্তিগতভাবে অনেক খরচ করছে। আবার তাদের পেছনে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ আছে। যখন এসব শিক্ষার্থী বেকার থাকছে তখন উভয় বিনিয়োগই অপচয় হচ্ছে। চলতি বছরের ২৪ মার্চ মাসে প্রকাশিত বিআইডিএস’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। কেননা এ দেশে যে শিক্ষা দেয়া হয় সেগুলো বাস্তবতা কিংবা কর্মের সঙ্গে সংযোগ নেই। শিক্ষিত বেকার সংখ্যার মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করার তিন বছর পরও শিক্ষার্থীদের ২৮ শতাংশ বেকার থাকছেন। বিশেষ করে যারা রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস, লাইব্রেরি ব্যবস্থাপনা, ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং বাংলার মতো বিষয়ে পড়ালেখা করেছেন। এদিকে যুবকদের মধ্যে ৮ শতাংশ বেকার, যা জাতীয় বেকারত্ব হারের দ্বিগুণ। এদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। তাই বলা যায় উচ্চশিক্ষা চাকরির মানদণ্ড নয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বেকার বেশি থাকার কারণ হলো, কারিকুলামে দক্ষতার অভাব, ইংরেজির ঘাটতি ইত্যাদি। এ বিষয়ে কথা হয় বিআইডিএস’র গবেষণা ফেলো ড. বদরুন নেসা আহমেদ এর সঙ্গে। তিনি বলেন, বিবিএস বলছে দেশের বেকার রয়েছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ। এই মোট বেকারের মধ্যে আবার শিক্ষিত বেকার ১২ শতাংশ। এই সংখ্যাটি কম নয়। আমরা গবেষণা করেছি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ওপর। সেখানেও শিক্ষিত বেকার থাকার চিত্র উঠে এসেছে। এটা অবশ্যই দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। কেননা যারা শিক্ষা শেষ করেও ৫, ৬, ৭ বছর চাকরি বা কোনো কাজ পাবেন না, তারা কী করবেন? চুরি, ডাকাতি ছিনতাইসহ নানা সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারেন। নারী হলে বিয়ে দিয়ে অন্যের আয়ের ওপর চলতে পারেন। কিন্তু পুরুষের জন্য এটা খারাপ অবস্থা। পাশাপাশি হতাশায় ডুবে অনেক সময় নেশায় আসক্তিসহ আত্মহত্যার প্রবণতার সৃষ্টি হতে পারে। যেটি এখন লক্ষ করা যাচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের মধ্যে বেকার সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৭ সালে এর হার ছিল ১৯ দশমিক ২ শতাংশ, সেটি বেড়ে ২০২২ সালে হয়েছে ১২ শতাংশ। এ ৫ বছরে স্নাতক পাশ করা বেকারের সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৭ সালের হিসাবে এ সংখ্যা ছিল ৪ লাখ, ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ লাখে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন’র মতে, বাংলাদেশ যে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টে (তরুণ জনগোষ্ঠীর আধিক্য) আছে। এটি সাময়িকভাবে এখনো চলছে। আগামী ১৫-২০ বছরের মধ্যে এটি শেষ হয়ে যাবে। তরুণ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে এ সময়ের মধ্যে ব্যবহার করা না গেলে পরে এ সুযোগ আর আসবে না। শিক্ষিত তরুণরা বেকার থাকার ফলে নিজের জন্য কিছু আয় করতে পারছে না। পাশাপাশি রাষ্ট্রের জন্যও কিছু দিতে পারছে না। দুই ক্ষেত্রেই কোনো ফল আসছে না। ফলে এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট সুযোগের অপচয় ঘটছে। এছাড়া শিক্ষিত ও তরুণ বেকাররা সামাজিকভাবে ঝুঁকি তৈরি করছে। কেননা তারা যে স্বপ্ন নিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করছে বাস্তব জীবনে কর্মের বাজারে তার কোনো চাহিদা নেই। ফলে হতাশা সৃষ্টিসহ নানা অসামাজিক কাজে তাদের ব্যবহার করা সহজ হয়। আবার তারা নিজেরাও সময় ও হতাশা কাটানোর জন্য নেশাসহ বিভিন্ন রকম অন্যায় কাজে যুক্ত হতে পারেন। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কর্মে নিয়োজিত জনসংখ্যার বৃহত্তম অংশ অর্থাৎ ৪৭ দশমিক ১ শতাংশ বেসরকারি বা যৌথ উদ্যোগের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। এরপর ২০ দশমিক ৭ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ খানাভিত্তিক (পরিবার) প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত। শুধু ৫ দশমিক ৫ শতাংশ কর্মচারী সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। এদিকে খানাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যারা কাজ করেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক অর্থাৎ ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ মহিলা। এরপর যৌথ উদ্যোগ বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ২৯ দশমিক ২ শতাংশ মহিলা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ মহিলা। তবে সবচেয়ে বেশি পুরুষ কাজ করেন বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আছেন ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ এবং খানাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ১৪ দশমিক ২ শতাংশ মহিলা। তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে ৫৭টি (২০২১ সাল পর্যন্ত ৫০টি) সরকারি এবং ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ২০২১ সালে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ছিল ৪৪ লাখ ৪১ হাজার ৭১৭ জন। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল আরও বেশি ৪৬ লাখ ৯০ হাজার ৮৭৬। করোনা মহামারির কারণে শিক্ষার্থী কমে গেছে। তবে শুধু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়ন করছেন প্রায় ৫ লাখ ২০ হাজার শিক্ষার্থী। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন প্রায় ৩ লাখ ৪২ হাজার জন। এর মধ্যে ১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যয়ন করছেন ১ লাখ ২৯ হাজার শিক্ষার্থী। এসব সরকারি-বেসরকারি, অধিভুক্ত, অঙ্গীভূত বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসা থেকে প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন শেষ করে বের হয়। কিন্তু তাদের সেই শিক্ষা কতটা বাস্তব কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক একজন চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করারশর্তে বলেন, প্রতিবছর যে বিপুল পরিমাণ গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে সেই তুলনায় তো কর্মসংস্থান হচ্ছে না। সেখানে যারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে তারাই চাকরিতে প্রবেশ করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে যারা শিক্ষিত তারা কোথাও না কোথাও কিছু না কিছু করেই থাকে। একেবারেই বেকার বসে থাকে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় এত কলেজ যে সেগুলোর ব্যবস্থাপনা করাটাও কঠিন। তবে এ বিষয়ে একাধিক শিল্প উদ্যোক্তা জানিয়েছেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের দুর্বলতা থাকে। সেক্ষেত্রে আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ করি। এছাড়া শুধু শিক্ষা দিয়ে তো হবে না। আমাদের দরকার টেকনিক্যালভাবে শিক্ষিত জনশক্তি। এখনো আমরা কাজের যোগ্য লোক খুঁজে পাই না।