* মামলার ভয়ে কেন্দ্র থেকে শুরু করে থানা-ওয়ার্ড ও ইউনিট পর্যায়ের নেতারাও আত্মগোপনে
* চরম অনিশ্চয়তার পলাতক নেতাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান
* সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতারা
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। মামলা-হামলার ভয়ে একই পথের পথিক হয়ে জীবন রক্ষার্থে দেশত্যাগ করেন দলটির কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা, ইউনিয়ন-ওয়ার্ড এবং ইউনিট পর্যায়ের তৃণমূল নেতারাও। বাদ যায়নি মেয়র-উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বাররাও। তবে জীবন বাঁচাতে তারা পালিয়ে গেলেও অনেক অর্থকষ্টে দিনযাপন করছেন নেতাদের পরিবার-পরিজনেররা। তবে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। এরআগে ৫-৮ আগস্টের মধ্যে গঠন হয় অন্তর্বর্তী সরকার। তবে হাসিনা দেশ ছাড়ার পরই বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে আওয়ামী লীগের নেতাদের উপর হামলা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয়া শুরু হয়। এতে মৃত্যুও হয় অনেকের।
রাজধানী খিলগাঁও থানা আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর একজন নেতার স্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমার স্বামী কারো ক্ষতি করে নাই। গত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও তিনি অপরাধমূলক কোনো কাজে জড়িত হন নাই এবং নিজের পরিবার-পরিজনের নামে একটা বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাটও কিনতে পারেন নাই। জমানো কোনো টাকাও নেই। দুই মেয়ে ও এক ছেলে স্কুলে পড়ালেখা করে। তাদের লেখাপড়া তো দুরের কথা, দুই বেলা খাবার তুলে দেয়াই কঠিন হয়ে পড়ছে। ঠিকমত বাসাভাড়াও দিতে পারছেন না বলে জানান তিনি। এ সময় তিনি বলেন, গত ৪ মাসে কোনো নেতা আমাদের খবর নেয় নাই। লালবাগের চকবাজার থানা আওয়ামী লীগের কার্যকরি সদস্যে এক নেতার স্ত্রী বিলকিস বেগম (ছদ্ধনাম) বলেন, আমার স্বামী কাউকে খুন করেনি, কারো জায়গা-জমি দখল করেনি। আজকে তাকেও সাড়ে তিনমাস আত্মগোপনে থাকতে হচ্ছে। তার হার্টে একটি রিং পড়ানো আছে। আমাদের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নাই। জানি না, মহান আল্লাহ তাকে কেমন রেখেছেন। আওয়ামী লীগের ধানমণ্ডির পাটি অফিসের পাশে বিভিন্ন জুস ও চা বিক্রি করেন শামসুদ্দিন। তার দোকানে একসময় আড্ডা দিতে আওয়ামী লীগের ছোট-বড় সকল নেতারা। আত্মগোপনে থাকা অনেকের পরিবার-পরিজনেরা তার দোকানে পরিবারের কর্তাদের খোঁজ-খবরের জন্য আসছেন। কিন্তু কেউ তাদের সন্ধ্যান দিতে পারছেন না। একইকথা বলেছেন ঢাকা মহানগর কৃষকলীগের একজন নেতা। নাম প্রকাশ না করারশর্তে তিনি জানান, আওয়ামী লীগ প্রায় চার মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল, কেউ একটা চাকরিও দিতে পারে নাই। তখনও কষ্টে জীবন-যাপন করেছি, এখনও করছি। তবে এখন স্বাধীনভাবে কিছু করতে পারছি না। তিনি জানান, গত ৫ আগস্টের পর থেকে আজ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন নিরীহ নেতাকর্মীদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে বেধর মারধর করা হয়েছে এবং তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকায় রফাদফা করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তবে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা তো দুরের কথা, উল্টো বিএনপির ওই নেতাদের কথামত কাজ করেছে। যাত্রাবাড়ির বেশ কয়েকজন পলাতক নেতার সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, আমরা ক্ষমতায় থাকাকালে এলাকার বিএনপি-জামায়াত কিংবা অন্যকোনো দলের নেতাকর্মীদেও সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করিনি। অথচ ৫ আগস্টের পর আমরা এলাকা ছাড়া। বাড়ি-ঘরে দেয়া হয়েছে আগুন। পরিবার-পরিজন কোথায় আছে জানিনা। ৪৮নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর হাজী আবুল কালাম অনু ৫ আগস্টের পর পরই এলাকা থেকে পালিয়ে জীবন বাঁচিয়েছেন। তিনি জানান, বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের নির্দেশে আমার কার্যালয় ও বাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে। কেউ এগিয়ে আসেনি। তিনি বলেন, কোনো সুস্থ দেশে এরকম রাজনীতি হতে পারে না। এ থেকে অতিদ্রুত বের হতে না পারলে আগামীতে আরও ভয়াবহ হতে পারে। আবুল কালাম অনুর সঙ্গে সুর মিলিয়ে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের অন্তত্ব ২২জন নেতাকর্মী একই কথা বলেছেন। তারা দেশে একটি সুস্থধারার রাজনীতি ফিরে আসুক, এটা প্রত্যাশা করেন।
চরম অনিশ্চয়তার পলাতক নেতাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান : দেশের ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক খাতের নানা ব্যবসায় সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন আওয়ামী লীগসংশ্লিষ্টরা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চরম সংকটে পড়েছেন দলটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের তীব্রতা ও সরকার পতনের আভাস পেয়ে অনেকে আগেই দেশ ছাড়েন। আবার কেউ কেউ আওয়ামী লীগের পতনের পর পালিয়ে যান। আবার আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের যেসব নেতা দেশ ছাড়তে পারেননি, তারা আত্মগোপনে রয়েছেন। ফলে আওয়ামী লীগ নেতাদের মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম এখন চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে। তবে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ফলে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে দলটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো। অনেক প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ব্যাপক লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। এমনকি কোনো কোনোটি বন্ধও হয়ে গেছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বহু শ্রমিক। আবার এসব প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে। ব্যবসায়িক কার্যক্রম ব্যাহত হলে ঋণ পরিশোধে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর এসবের সামগ্রিক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সর্বশেষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে মেয়র হন মো. আতিকুল ইসলাম। সরকার পতনের পরও দেশে অবস্থান করেছিলেন তিনি। গত ১৮ আগস্ট তিনি উত্তর সিটি করপোরেশনের কার্যালয়ে যান এবং সেই খবর ছড়িয়ে পড়ে। পরে জনরোষ এড়াতে উত্তর সিটির ভবন থেকে তিনি পালিয়ে যান। তার পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন তিনি। বর্তমানে বিজিএমইএর সাবেক এ সভাপতির অনুপস্থিতিতে তার মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ইসলাম গ্রুপের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রধান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত থাকায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আমাদের হাজার হাজার কর্মীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। কবে সবকিছু ঠিক হবে কিছুই আমাদের জানা নেই। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দফায় দফায় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজী টায়ার্সের কারখানায়। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। সর্বশেষ গত ২৫ আগস্ট কারখানাটিতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এর আগে ও পরে কারখানাটিতে ব্যাপক মাত্রায় লুটপাটও চালানো হয়। পুরোপুরি ভস্মীভূত হয় কারখানাটির কাঁচামাল রাখার গুদাম। তবে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতি প্রসঙ্গে গাজী টায়ার্সের নির্বাহী পরিচালক (প্রশাসন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান জানান, সরকার পতনের পর কারখানায় দফায় দফায় আগুন দেয়া হয় ও লুটপাট করা হয়। কারখানার বড় বড় মেশিন অল্প সময়ের মধ্যে লুট করে নিয়ে গেছে। এটি একটি পরিকল্পিত ক্রাইম। তাছাড়া যে ভবনটি আগুন লেগে পুড়ে গেছে, সেই ভবনে সব কেমিক্যাল, কাঁচা রাবার ও সালফার ছিল। এতে হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। এ কারখানায় প্রায় আড়াই হাজার কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারী কর্মরত ছিলেন। ক্ষতিগ্রস্ত কারখানাটি শিগগিরই চালু না হলে শ্রমিকরা বেকার হয়ে যাবেন। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে প্রতিষ্ঠানটির আরেক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের কারখানায় কয়েকবার লুটপাট হয়েছে। আগুন দেয়া হয়েছে দুই দফায়। তবে সর্বশেষ গত ২৫ আগস্ট আগুন দেয়ার পর শ্রমিকরা সবাই বেকার হয়ে পড়েছেন। জুলাইয়ের বেতন দেয়া হয়েছে। আর আগস্টের বেতন এখনো হয়নি। আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি। তিনি তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর ২০২৪-২৬ মেয়াদে সভাপতি নির্বাচিত হন। জানা গেছে, সরকার পতনের আগে তিনি পারিবারিক কারণে সিঙ্গাপুর যান। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি আর দেশে ফেরেননি। যদিও এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি মামলার আসামি হয়েছেন আওয়ামী লীগের এ নেতা। তবে এসএম মান্নান কচি তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠান সেহা ডিজাইন (বিডি) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সরকার পতনের পর প্রতিষ্ঠানটি ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

অর্থকষ্টে পলাতক আ’লীগের নেতাদের পরিবার-পরিজন
- আপলোড সময় : ১০-১২-২০২৪ ১০:১৩:০৭ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ১০-১২-২০২৪ ১০:১৩:০৭ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ