* সরকারি বইয়ের মান তদারকি করবে সরকারি প্রতিষ্ঠান : এনসিটিবির শীর্ষ কর্তার পাঁয়তারা * বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়ার সম্ভাবনা দিন দিন ক্ষীণ হচ্ছে * মাধ্যমিক স্তরে ২৮ কোটির বেশি বই ছাপাবে সরকার * শিক্ষার্থীদের ভালো মানের বই না পাওয়ার শঙ্কা
বিনামূল্যের পাঠ্যবইয়ের মান যাচাইয়ের জন্য প্রতি বছর ‘ইন্সপেকশন এজেন্ট’ নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেও এজেন্ট নিয়োগ দিতে পারেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ফলে মানসম্মত বই ছাপানোর পাশাপাশি বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়ার সম্ভাবনা দিন দিন ক্ষীণ হচ্ছে। এরপরও বই ছাপার সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, বিনামূল্যে পাঠ্যবইয়ের মান নিশ্চিত করতে এবার কঠোর অবস্থানে এনসিটিবি। তবে এনসিটিবির চাওয়া, সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এ কাজ করানো। ফলে সরকারি প্রতিষ্ঠানের বই সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়েই তদারকি করানো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পাশাপাশি সবকিছু পাশ কাটিয়ে অনভিজ্ঞ ও অদক্ষ প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে জোর করে তদারকির কাজ করাতে তৎপরতা শুরু হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। পাঠ্যবই মুদ্রণের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, বিগত বছরগুলোতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বই তদারকির জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়া হয়। চলতি বছর প্রাথমিক স্তরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়া হলেও মাধ্যমিক স্তর নিয়ে দ্বিমুখী অবস্থান নিয়েছে এনসিটিবি। ফলে শিক্ষার্থীদের ভালো মানের বই হাতে না পাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এনসিটিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে পাঠ্যবই মুদ্রণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে তদারকির কাজ করানো হচ্ছে। শুধু এনসিটিবি নয়, টিসিবি, রেলওয়ে, খাদ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের অন্তত ২০টি প্রতিষ্ঠান তৃতীয় পক্ষ দিয়ে পণ্যের মান যাচাই করে থাকে। মূলত দরপত্র ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় এ কাজ করা হয়। কিন্তু এনসিটিবি সরকারি বইয়ের মান নিয়ন্ত্রণে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়েই তদারকি করাতে চাইছে। এ পরিস্থিতিতে বইয়ের মান রক্ষা করা সম্ভব হবে না বলছেন মুদ্রণের সঙ্গে জড়িতরা। শুধু তা-ই নয়, ২৮ কোটি বই ছাপানোর জন্য কমপক্ষে এক লাখ টন কাগজ, কালি, আর্ট পেপার তদারকি করতে হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা ৫০টির বেশি প্রেসে ২৪ ঘণ্টা একজন করে তদারকি কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার মতো জনবল, মেশিনারিজ, ল্যাবসহ আনুষঙ্গিক কোনো কিছুই সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই। তারপরও এনসিটিবির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জোর করে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে এনসিটিবির বিতরণ শাখার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করারশর্তে জানান, মাধ্যমিক স্তরে ২৮ কোটির বেশি বই ছাপাবে সরকার। এজন্য দরপত্রসহ আনুষঙ্গিক প্রায় সব কাজ শেষ করে এনেছে প্রতিষ্ঠানটি। ইতোমধ্যে ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণির বইয়ের কার্যাদেশ দেয়া শুরু হয়েছে। গত সপ্তাহে অষ্টম শ্রেণির বইয়ের দরপত্রের অনুমোদন দিয়েছে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত কমিটি। নবম ও দশম শ্রেণির বইয়ে দরপত্র মূল্যায়নের কাজ চলছে। ফলে সব কাজ শুরু হচ্ছে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে। কিন্তু বই ছাপানোর আগে ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগ দিতে হয়। বই মুদ্রণের জন্য প্রেসের মালিকদের সঙ্গে চুক্তিপত্র করার সময় ইন্সপেকশন কোম্পানির নাম উল্লেখ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হয়। এটি না থাকায় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করতে পারছে না বলে এনসিটিবির ওই কর্মকর্তা জানান। তবে বই ছাপার সঙ্গে জড়িতরা জানান, বিনামূল্যে পাঠ্যবইয়ের মান নিশ্চিত করতে এবার কঠোর অবস্থানে এনসিটিবি। ছাপার আগে ও পরে তদারকির জন্য দুটি ভাগে পিডিআই ও পিএলআই এজেন্ট ইন্সপেকশন নিয়োগ দিতে হয়। যার কোনোটি এখনও হয়নি। ফলে চুক্তি করলেও ছাপা কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। এতে বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়ার সম্ভাবনা দিন দিন ক্ষীণ হচ্ছে। তারা বলছেন, বই ছাপার আগে তিন স্তর এবং পরে এক স্তর, মোট চার স্তরে তদারকি করে পরিদর্শন এজেন্সি। শুধু তা-ই নয়, গভীর রাতে নিম্নমানের বই ছাপানো ঠেকাতে প্রত্যেকটি ছাপাখানায় ২৪ ঘণ্টার জন্য তদারকি কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হয়। তারা প্রথমে প্রেসে কাগজের মান (স্থায়িত্ব ও জিএসএম) ঠিক আছে কি না, তা দেখে ছাড়পত্র দিলেই বই ছাপা হয়। ছাপা হওয়া পর মান যাচাই করে ফের ডেলিভারি জন্য ছাড়পত্র দেয়া হয়। এই স্তরকে (প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন) পিডিআই বলে। বই পৌঁছার পর প্রত্যেক উপজেলা থেকে বই সংগ্রহ করে সেগুলোর মান যাচাই করতে (পোস্ট ল্যান্ডিং ইন্সপেকশন) পিএলআই এজেন্ট নিয়োগ দেয়া হয়।
এনসিটিবি সূত্রে জানা যায়, প্রাথমিকের পাঠ্যবই ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রেসে ছাপানোর কাজ শুরু হয়েছে। মাধ্যমিকের বইয়েরও (বিভিন্ন লট) কার্যাদেশ দেয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু মাধ্যমিকের পাঠ্যবই ছাপার পর সেগুলোর মান ঠিক আছে কি না, বিশেষ করে কাগজের মান, ছাপার মান, কালি, আঠা, বাইন্ডিংসহ অন্যান্য বিষয় যাচাই-বাছাই করে এগুলোর ইন্সপেকশন সার্টিফিকেট দেয়া হয়। গতকাল সোমবার (২ ডিসেম্বর) পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোনো প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়া হয়নি। এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, গত বছরের চেয়ে এবারও ৩০-৪০ শতাংশ কমে টেন্ডারে অংশ নিয়েছে তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানের কাজের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাই তদারকির কাজটি সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে করানো যায় কি না, তা বিবেচনায় আনা হয়েছে। তবে, সেই প্রতিষ্ঠানের ল্যাব ও অভিজ্ঞতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়াদি মিললেই কাজ দেয়া হবে অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে করানো হবে। এ বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি বলেন, তদারকি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ না হলেও চুক্তি করতে সমস্যা হবে না। এনসিটিবির তদারকি টিম মাঠে কাজ করবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ইন্সপেকশন এজেন্সি নিয়োগের জন্য দরপত্র দিয়ে তা এখন মূল্যায়ন পর্যায়ে আছে। দরপত্রে অস্বাভাবিক কম দর দেয়ার কারণ দেখিয়ে বিকল্প উপায়ে কাজ দিতে হঠাৎ করে মাধ্যমিক পর্যায়ের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান খোঁজা শুরু করে এনসিটিবি। ইতোমধ্যে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান দুবার পরিদর্শন করেছে। সেই প্রতিষ্ঠানে এ কাজের জন্য পর্যাপ্ত মেশিনারিজ, ল্যাব, পাল্প (কাগজ তৈরির মণ্ড) যাচাইয়ের জন্য কেমিস্ট কোনো কিছুই নেই। প্রেসে ২৪ ঘণ্টা লোক বসিয়ে রাখার মতো জনবলও নেই। এরপরও জোর করে প্রতিষ্ঠানটিকে দিয়ে মেশিনারিজ ক্রয় করাতে চাইছে এনসিটিবি। সেই মেশিন বিদেশ থেকে এলসি করে আনতে দুই মাসের বেশি সময় লাগবে। ততক্ষণে নির্ধারিত সময়ে বই পৌঁছে দেয়ার সময় চলে যাবে। এমন কারণ দেখিয়ে এনসিটিবিকে না করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। অন্যদিকে বুয়েট, বিএসটিআই এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে (বিসিএসআইআর) ল্যাব ও মেশিনারিজ থাকলেও অর্ধশতাধিক প্রেসে ২৪ ঘণ্টা লোক বসিয়ে রাখার মতো জনবল নেই। যদিও এনসিটিবির বিতরণ শাখা সূত্র বলছে, মাধ্যমিকের ২৮ কোটি বই ছাপানোর জন্য প্রায় এক লাখ টন কাগজ প্রয়োজন। সঙ্গে কালি, আর্ট পেপার তদারকি করতে হয়। এমন মহাযজ্ঞ করার মতো জনবল ও সক্ষমতা সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু এনসিটিবি নয়, সরকারের অন্তত ২০টি প্রতিষ্ঠান যারা শত থেকে হাজার কোটি টাকার কেনাকাটা করে তারাও মান যাচাইয়ের জন্য তৃতীয় পক্ষকে বেছে নেয়। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন (বিএসএফআইসি), টিসিবি, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, খাদ্য মন্ত্রণালয়, রেলওয়ে, তিতাস গ্যাস, বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল কর্পোরেশনের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, আমাদের কেনাকাটার মান রক্ষার জন্য তৃতীয় পক্ষ দিয়ে তদারকি করানো হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে তদারকি করালে মানের চেয়ে আপস বেশি হয়, এটা স্বাভাবিক। এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে কাজ করানোর যায় কি না, সেটি যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তারা যদি সক্ষম না হয় তবে ভিন্ন সিদ্ধান্ত আসতে পারে। সবকিছু বিবেচনা করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
বিনামূল্যে পাঠ্যবই
মান নিশ্চিতে কঠোর অবস্থানে এনসিটিবি
- আপলোড সময় : ০৫-১২-২০২৪ ১২:২১:৪৭ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৫-১২-২০২৪ ১২:২১:৪৭ পূর্বাহ্ন
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ