* দ্বিকক্ষ সংসদের পক্ষে জোরালো অবস্থানে বিএনপি
* দ্বিকক্ষ সংসদ ব্যবস্থা ৭৮টি দেশে চালু আছে
* ব্রিটেন থেকে দেশে দেশে দ্বিকক্ষ সংসদ, সুবিধার সঙ্গে আছে চ্যালেঞ্জও
* দ্বিকক্ষ সংসদ নিয়ে যা বলছেন বাম নেতারা
* দ্বিকক্ষের সংসদ নিয়ে নানা মত দিয়েছেন বিশিষ্টজনরা
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগের মাঝে বিভিন্ন মহল থেকে নির্বাচনী ব্যবস্থায় জাতীয় সংসদ দুই কক্ষ বিশিষ্ট করার বিষয়ে আলোচনা বেশ জোরে-শোরেই হচ্ছে। তবে এ নিয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। এই পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ব্রিটেনে।
দেশটি থেকে দেশে দেশে দ্বিকক্ষ সংসদ ব্যবস্থা চালু হচ্ছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে সংবিধান সংস্কারেরও উদ্যোগ নিয়েছে এবং সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই সংবিধান সংস্কার কমিশন কাজ শুরু করার পর দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। এককথায় বলতে গেলে দেশের রাজনীতিতে এবার আলোচনায় ঝড় তুলছে ‘দ্বিকক্ষ সংসদ’। তবে এ নির্বাচন ব্যবস্থান সুবিধার পাশাপাশি আছে নানা রকম চ্যালেঞ্জও। সর্বশেষ যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্স ক’দিন আগেই শেষ হলো যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন। আর এ বছরই নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হলো ভারতে। দু’টি দেশেরই আইনসভা দুই কক্ষবিশিষ্ট। বর্তমান বিশ্বে অনেক দেশই দুই কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার রীতি অনুসরণ করে। দুই কক্ষবিশিষ্ট ব্যবস্থা বা বাইক্যামেরালিজম হলো এমন একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে আইনসভা দু’টি পৃথক কক্ষে বিভক্ত থাকে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে সাধারণ শাসনব্যবস্থাগুলোর মধ্যে একটি। এ পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য হলো আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভারসাম্য ও পর্যালোচনা নিশ্চিত করা।
দ্বিকক্ষ সংসদের পক্ষে জোরালো অবস্থানে বিএনপি: দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ নির্বাচনের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। কারণ অভ্যুত্থানের অনেক আগেই দ্বিকক্ষ সংসদের প্রস্তাব প্রথম উত্থাপন করেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ফ্যাসিবাদমুক্ত নতুন বাংলাদেশে দ্বিকক্ষ সংসদের পক্ষে দলটির অবস্থান আরও স্পষ্ট। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্র মেরামতে ৩১ দফা রূপরেখা প্রকাশ করে বিএনপি। এই রূপরেখার পঞ্চম দফায় ‘উচ্চ-কক্ষবিশিষ্ট’ আইনসভার কথা বলা হয়। বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ওই রূপরেখার ঘোষণা দেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা চাওয়া দেশের অন্যতম বৃহত্তর রাজনীতিক দল বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, তারা ক্ষমতায় গেলে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করবেন এবং দ্বিকক্ষ পার্লামেন্ট গঠন করবেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল শেখ হাসিনার মত দৈত্য, আরেকটা দৈত্য যাতে সৃষ্টি না হয়, এজন্য ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর হাতে সব ক্ষমতা দেয়া যাবে না। দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। জনগণের ভোটে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে, দ্বিকক্ষ পার্লামেন্ট গঠন করা হবে। একইসুরে কথা বলেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। তিনি বলেন, বিএনপির ৩১ দফার মধ্যে অন্যতম দ্বিকক্ষ সংসদ।
দ্বিকক্ষ সংসদ নিয়ে যা বলছেন বাম নেতারা: দেশের রাজনীতিতে আলোচনায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ। এখন কেবল এককক্ষ বিশিষ্ট সংসদের হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা আছে উল্লেখ করে অনেকে বলছেন, দ্বিকক্ষ সংসদ হলে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভারসাম্য থাকবে। তবে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিসহ সামগ্রিক বাস্তবতাকে সামনে রেখে অধিকাংশ বামপন্থি রাজনৈতিক দল এটি সমর্থন করছে না। যদিও কেউ কেউ বলছে, মতৈক্যের ভিত্তিতে হলে তাতে তাদের সমর্থন থাকবে। দেশের বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর অধিকাংশই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ সমর্থন করছে না। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক জোটের দলগুলোর এই ধরনেরই অবস্থান। ওই দলগুলোও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রয়োজন আছে বলে মনে করে না। এ জোটের দলগুলো সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালুর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমেই জনমতের প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব বলে ওই দলগুলো মনে করে। তবে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলছেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গুরুত্ব আছে বলে মনে করি না। যেখানে ফেডারেল সরকার আছে, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী আছে সেখানে সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হতে পারে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের জন্য দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রয়োজন হয়। আমাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতায়ও এটা অপ্রয়োজনীয়। তিনি বলেন, সিপিবি সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালুর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে আইন সভায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পাঠানোর ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন বলে আমাদের পার্টি সিপিবি মনে করে। আর এই পদ্ধতির নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃত অর্থেই জনমতের প্রতিফলন ঘটবে বলে আমরা মনে করি।
দ্বিকক্ষের সংসদ নিয়ে নানা মত দিয়েছেন বিশিষ্টজনরা: অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগে জাতীয় সংসদ দুই কক্ষ বিশিষ্ট করার বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে। এদের মধ্যে রয়েছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও পর্যবেক্ষকরা। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ এক কক্ষ বিশিষ্ট। বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় ৩০০ আসনের এই কক্ষের সদস্যদের নিয়েই এতোদিন গঠিত হয়েছে সরকার। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা সরকারের ইচ্ছারই কেবল প্রতিফলন হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই কক্ষের সংসদ হলে উচ্চ কক্ষের অনুমোদনের ভিত্তিতেই কেবল বাস্তবায়ন হবে নিম্নকক্ষের সিদ্ধান্ত। এতে জনগণের ভোটে সরাসরি নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নিম্নকক্ষে এলেও প্রতিষ্ঠা পাবে ক্ষমতায় ভারসাম্য। ফলে জনগণের ওপর দলীয় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে যায়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের টানা ১৬ বছরের শাসন অবসানের পর ভবিষ্যতে যেন কোনো দল সেই সুযোগ না পায় মূলত সেই দৃষ্টি ভঙ্গি থেকেই দুই কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের আলোচনা হালে পানি পেয়েছে। অনেকেই নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ক কমিশনকে এই পদ্ধতি আনার সুপারিশ করতে প্রস্তাবনা দিচ্ছেন। তবে এমন প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের সংশোধন দরকার বলে মনে করছে ওই সংস্কার কমিশন। তাদের মতে সংবিধান সংস্কার কমিশনকে এই উদ্যোগ নিতে হবে। কেননা, দুই কক্ষের সংসদীয় পদ্ধতি চালু করতে হলে সংবিধানে সেই বিধান আনতে হবে। আবার সংবিধান সংশোধন করতে হলেও নিতে হবে দলগুলোর মতামত। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনা বলেন, আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন নেই। এই সিস্টেমই কার্যকর হতে পারে। নতুন কোনো সিস্টেম দরকার আছে বলে মনে করি না। তিনি বলেন, আমাদের যে সিস্টেম আছে, যেটা মানুষের কাছে পরীক্ষিত। এই সিস্টেমই কার্যকর করে তোলা দরকার। এটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা। সংসদ কয় কক্ষের হবে এটা দলগুলোর ওপর ছেড়ে দেয়া ভালো। এ বিষয়ে কথা বলেছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ। তিনি বলেন, সংসদীয় পদ্ধতি থাকবে। আমেরিকান ওই দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সিস্টেম আনার দরকার নেই। নির্বাচনকে সরলীকরণ করতে হবে। মনোনয়ন বাণিজ্য যদি বন্ধ করা না যায় সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। আর ঢাবি’র রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ও ঢাকা ইন্টারন্যাশল ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, পলিটিকস নিডস ইমিডিয়েট বেনিফিট। সবাই তাৎক্ষণিক সুবিধা চায়। বর্তমান সরকারের উচিত আগে দ্রব্যমূল্যে হাত দেয়া। তাদের দায়িত্ব হলো নিরপেক্ষ নির্বাচন দেয়া। সেটাই করা উচিত। সংবিধান সংশোধন করতে হলে সবগুলো দলের না হলেও অন্তত বড় দলগুলোর ঐকমত্য প্রয়োজন। ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারলে করা যেতে পারে। এ নিয়ে কথা বলেছেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ক কমিশন প্রধান ও সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, অনেক ধরনের মতামত আছে। অনেক রকম গুরুত্বপূর্ণ, অভিনব, সৃজনশীল প্রস্তাব রয়েছে। এক্ষেত্রে অনেক মতামত বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সংবিধান সংস্কার কমিশনেও এমন প্রস্তাব এলে আমরা সংশ্লিষ্ট কমিশনের সঙ্গেও বসবো। সব পর্যালোচনা করেই সরকারকে সুপারিশ দেবো। কিছু সুপারিশ নতুন কমিশন বাস্তবায়ন করবে। আর কিছু সুপারিশ রাজনৈতিক দলগুলো বাস্তবায়ন করবে।
৭৮ টি দেশে চালু আছে দুই কক্ষের সংসদ: আন্তর্জাতিক সংসদীয় ইউনিয়নের (আইপিইউ) দেয়া হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের ১৯০টি জাতীয় সংসদের মধ্যে, ৭৮টি দুই কক্ষবিশিষ্ট (মোট ১৫৬টি কক্ষ) এবং ১১২টি এক কক্ষবিশিষ্ট। অর্থাৎ সদস্য দেশগুলোতে মোট ২৬৮টি সংসদীয় কক্ষ রয়েছে। এসব কক্ষের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৪৬ হাজার। আইপিইউর সদস্য ১৮১টি। প্রাচীন গ্রিস ও রোমেও দ্বিকক্ষীয় ব্যবস্থার চর্চা ছিল। যদিও এগুলো পুরোপুরি দ্বিকক্ষীয় কাঠামো ছিল না। এথেন্সে শাসন ব্যবস্থায় দু’টি প্রধান সংস্থা ছিল। প্রথমটি হলো এক্লেসিয়া, যেখানে সাধারণ নাগরিকেরা অংশ নিতেন। দ্বিতীয়টি অ্যারিওপেগাস বা পরামর্শদাতা পরিষদ। রোমে সিনেট অভিজাত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করত, আর প্লেবিয়ান অ্যাসেম্বলি সাধারণ নাগরিকদের উদ্বেগ ও মতামত প্রকাশের একটি মঞ্চ ছিল। এসব ব্যবস্থা বিভিন্ন সামাজিক স্বার্থের ভারসাম্য রক্ষার ধারণা প্রতিফলিত করত। এ ধরনের প্রাথমিক কাঠামো পরবর্তী দ্বিকক্ষীয় আইনসভাগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

আলোচনায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা
- আপলোড সময় : ২৫-১১-২০২৪ ১২:১৯:২০ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৫-১১-২০২৪ ১২:১৯:২০ পূর্বাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ