শীতের পিঠার ধুম পড়েছে ঢাকার ফুটপাতে
- আপলোড সময় : ২৩-১১-২০২৪ ০১:০৯:১১ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৩-১১-২০২৪ ০১:০৯:১১ পূর্বাহ্ন
* রাজধানীর অলিগলিতে দেখা মিলছে শীতের পিঠা
* গ্রামের পাশাপাশি ঢাকা শহরেও শীত ছুঁয়েছে
* শীতকে ঘিরেই শহরের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয়েছে পিঠা উৎসব
* চিতই, ভাপা, পাটিসাপটা, কুসুমকলি, পুলিসহ মিলছে নানা রকম পিঠা
গ্রামের প্রচণ্ড শীতের পাশাপাশি গত দুইদিন ধরে ঢাকা শহরেও শীত ছুঁয়েছে। তবে শহরেই যাদের নিত্য বাস তারা হয়তো কনকনে শীতে মায়ের হাতের খেঁজুরের রস কিংবা গুড়ের পিঠার স্বাদ এখনো নিতে পারেননি। কিন্তু পিঠাপুলির এই দেশে থেকে শীতের ঐতিহ্যবাহী পিঠা-মাঠা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন না। শহরের অলিতে-গলিতে কিংবা রাস্তার মোড়ে শীতের সকাল-বিকেল ও সন্ধ্যায় গন্ধ ছড়ায় ধোঁয়া উড়া নানা স্বাদের বাহারি পদের পিঠা। আর তাই রাস্তা কিংবা গলিতে যুগল, বন্ধুরা বা পরিবারের সবাই একসঙ্গে মেতে উঠে পিঠা খাওয়ার উৎসবে। শীতকে ঘিরেই শহরের চরদিকে চলছে এখন পিঠা উৎসব।
সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর ডেমরার স্টাফ কোয়াটার-যাত্রাবাড়ি, শ্যামপুর-কদমতলী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, সদরঘাট, হাজারীবাগ-লালবাগ এবং অভিজাত এলাকাখ্যাত ধানমণ্ডি ৩২, সোবাহানবাগ, কলাবাগান, কারওয়ানবাজার, ফার্মগেট, কাজীপাড়া, মিরপুর, মহাখালী, বাংলামোটর, শাহাবাগ-টিএসসির মোড়, প্রেসক্লাব, সেগুনবাগিচা, বিজয়নগর, ফকিরাপুল, সবুজবাগ-খিলগাঁও, মালিবাগ, রামপুরা ও বনশ্রীসহ বিভিন্ন স্থানে রাস্তার ফুটপাতে প্রায় মোড়ে শীতের সন্ধ্যায় মানুষ আয়েশ করে পিঠা খেতে যান। এ ছাড়া পুরান ঢাকার নাজিরাবাজারেও রয়েছে বেশ কিছু পিঠাপুলির দোকান। মৌসুমি চিতই ভাপা, পাটিসাপটা, কুসুমকলি, আমদেশা ও পুলি পিঠা ছাড়াও বিভিন্ন রকমের নারিকল পুলি পাওয়া যায় এখানকার দোকানগুলোতে। তবে সবচেয়ে বেশি পিঠার ভীড়জমে রুপগঞ্জের তিনশ ফিট নিলামার্কেট এলাকায়।
রাজধানী ঢাকাতে শীতের রস দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পিঠা খাওয়ার সুযোগ না থাকলেও হাতের নাগালেই মিলবে রাস্তার মোড়ে মোড়ে গরম গরম চিতই, ভাপা আর তেলের পিঠা। খেজুর বা আখের গুড় দিয়ে ভাপা আর তেলের পিঠা তৈরি করে বিক্রি করে বিক্রেতারা। ঢাকার রাস্তায় চিতই আর ভাপা পিঠাই বেশি বিক্রি হয়। কয়েক বছর ধরে এই পিঠার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভর্তার বৈচিত্র্যতা। যে দোকানে নানা পদের বৈচিত্র্যময় ভর্তা পাওয়া যায় সেই দোকানেই বিক্রি বেশি। শীতের মৌসুমে গড়ে উঠা এসব পিঠার দোকানিরা পিঠা বিক্রির ওপর নির্ভর করেই বহু পরিবার চালাচ্ছে তাদের সংসার। অনেকে আবার অন্য কাজের পাশাপাশি করেন পিঠা বিক্রি। কোনো কোনো দোকানি প্রতিদিন দুই থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে থাকে। যেদিন খুব কম বিক্রি হয় সেদিনও এক হাজার টাকার বেশি বিক্রি হয়। বিকেল থেকে শুরু হয় বেচাকেনা, চলতে থাকে রাত ১১-১২ টা পর্যন্ত। গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার কয়েকজন পিঠা দোকানির সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
রাজধানীর ডেমরায় প্রায় শতাধিক পিঠার দোকান রয়েছে। আর এসব দোকানে শিতের পিঠার ভীষণ চাহিদা রয়েছে। ডেমরা, হাজীনগর, সারুলিয়া, স্টাফকোয়ার্টার, বড়ভাঙ্গা, কোদালধোয়া, ডগাইর, ছোটমুরগীর ফার্ম, কোনাপাড়া, বাঁশের পূল, আমুলিয়া, পাড়া ডগাইরসহ প্রায় শ’খানেক পিঠার দোকান রয়েছে আরও বিভিন্ন এলাকায়। এসব এলাকার অলি-গলিতে শীতের পিঠার পসরা বসিয়ে দেদার বিক্রি করছে দেশের হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন মুখরোচক বাহারি নামের পিঠা-পুলি। এসব পিঠার মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে চিতই পিঠা, এর সাথে ধনিয়া পাতার ভর্তা, সরিষার ভর্তা, শুটকির ভর্তা এবং কসানো গরুর মাংস। এ ছাড়া বাহারি নামের যেমন, ফুল পিঠা, পাতা পিঠা, চিতই পিঠা, শামুক পিঠা, পাটি শাপটা পিঠা, মালপুয়া পিঠা, তেলের পিঠা, ভাপা পিঠা, লবঙ্গজ্বল পিঠা, মিষ্টি পুলি, ঝাল পূলি, সিদ্ধ পূলি ছাড়াও আরো বিভিন্ন ধরনের পিঠার দোকানে সাধারণ মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। সারুলিয়া এলাকার নোয়াখালী পিঠা ঘরের মালিক মোহাম্মদ নূর হোসেন নুরু বলেন, ডেমরা থানা এলাকায় আমাদের ৪টি পিঠার শো রুম রয়েছে। এছাড়া আমরা ঢাকা শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে বিভিন্ন এলাকায় পিঠা উৎসবে ডিসপ্লে করে থাকি। সেখানে আমাদের বেশ কয়েকটি পিঠার স্টল থাকে। এবার পিঠার বেশ চাহিদা রয়েছে। একে তো শীতের পিঠার আয়োজন, তার ওপর নির্বাচন সবমিলিয়ে এবার ব্যাবসা ভালোই হচ্ছে। তবে রাজধানীর ডেমরায় একশত পার্সন স্বাস্থ্যসম্মত নকশী পিঠা-ঝিনুক পিঠা বিক্রি করেন নরসিংদির মেয়ে মাকসুদা আক্তার। তিনি জানান, তার পিঠা তৈরিতে কোন কৃত্রিমতা নেই। একেবারে প্রাচীন ট্রেডিশন মেনেই খেজুর কাঁটার ডিজাইনে তৈরি করা হয় এই পিঠা। এতে ভালো তেল এবং গুড়ের সংমিশ্রণ থাকায় পিঠাটা খুবই সুস্বাদু হয়। তবে কোনো গন্ধ থাকে না। এছাড়াও নকশি পিঠার ডেলিভারি দিয়ে আলোচনায় ওঠে এসেছেন তিনি। নরসিংদির ঐতিহ্যবাহি নকশি পিঠা ও ঝিনুক পিঠা বিক্রি করে ইতিমধ্যে ক্রেতাদের নজর কেড়েছেন। রামপুরার ওয়াপদা রোডের জাহাজ বিল্ডিংয়ের মোড়ে সারা বছরই চিতই পিঠা বিক্রি করেন নাজমা বেগম। তিনি জানান, শুধু শীতকালই নয়, সারা বছরই প্রতিদিন দুপুরের পর পিঠা বিক্রি করেন তিনি। আশপাশের গলির মানুষজন লাইন দিয়ে তার পিঠা কেনেন। অনেকে ৮ থেকে ১০টা করে বাসায় নিয়ে যান, পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে খান। প্রতিটি চিতই পিঠা ১০ টাকা করে বিক্রি করেন নাজমা। তিনি জানান, পিঠা তৈরির জন্য চালের গুঁড়াসহ আনুষঙ্গিক সব জিনিস জোগাড়ে তার স্বামী সহায়তা করেন। পিঠা বিক্রি করেই তাদের সংসার চলে। ঢাবির কাঁটাবন কনকর্ড টাওয়ারের সামনের ফুটপাতে পিঠা খেতে এসেছেন মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, গ্রামের বাড়িতে আগে শীতের সময় ঘরে প্রায় প্রতিদিনই পিঠা বানানো হতো। সেই সময় আর নেই। এখন পিঠার স্বাদ পেতে হলে ফুটপাতই ভরসা। মগবাজার মোড়ে এক কোনায় ফুটপাতে তেলে পিঠা ভাজতে দেখা যায় রইছউদ্দিন নামে এক পিঠা বিক্রেতাকে। তিনি বলেন, এখানে তেলে পিঠার চাহিদা আছে। অনেকে দেখেই খেতে দাঁড়িয়ে যান। প্রতি পিস তেলে পিঠার দাম ১০ টাকা। এছাড়া চিতই পিঠাও আছে। কয়েক রকমের ভর্তাসহ প্রতি পিস চিতই পিঠার দাম ১০ টাকা। তবে বাহার আহমেদ নামে একজন ক্রেতা বলেন, পিঠা তো একটা আবেগের বিষয়। যখন বাড়িতে থাকতাম, তখন দাদি-নানি পিঠা বানিয়ে খাওয়াতো। তারপর মা বানিয়ে খাইয়েছেন। এখন ঢাকার জীবনে পিঠা বানিয়ে খাওয়ানোর মতো সুযোগ সবার হয় না। ফলে মৌসুমি এই পিঠাগুলো দেখলেই পুরোনো কথা মনে পড়ে যায়। খুব ভালো হোক বা না হোক, একটু খাওয়ার চেষ্টা করি। রাজধানীর মিরপুরের শেওড়াপাড়া মোড় থেকে গলিতে ঢুকতে দেখা গেল ৭/৮টা পিঠার দোকান। এসব দোকানে পাওয়া যাচ্ছে গরম গরম ভাপা আর চিতই পিঠা, সঙ্গে বাহারি সব ভর্তা। সেখানেই অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে পিঠা খাচ্ছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, শীতে পিঠা খাওয়ার ঐতিহ্য আছে আমাদের মতো গ্রাম থেকে আসা মানুষদের মধ্যে। এখন শীত শীত ভাব আসায় গরম গরম পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা। মার্কেটিং বিভাগে চাকরির সুবাদে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন যাওয়া হয়, আর এ কারণেই দেখেছি রাজধানীর এমন কোনো এলাকা নেই, অলি-গলি নেই যেখানে শীতের পিঠার অস্থায়ী দোকান বসেনি। বিশেষ করে চিতই পিঠার দোকান সব জায়গাতেই আছে। প্রতিদিনই সন্ধ্যায় পিঠা খাই রাস্তা ঘাটে। আমার মতো অসংখ্য মানুষ আছে যারা বলতে গেলে প্রতিদিন এই পিঠা দিয়ে নাস্তা খায়। রাজধানীর মালিবাগ এলাকার মগা হাজির গলিতেও বসেছে বেশ কিছু পিঠার অস্থায়ী দোকান। সেখানে বাসার জন্য পিঠা নিতে এসেছেন ওই এলাকার বাসিন্দা সানজিদা খাতুন। তিনি বলেন, শীতের সময় মুখরোচক ভর্তা দিয়ে চিতই খাওয়া অন্য রকম মজার। এছাড়া অন্য সব ভাজা পোড়া খাওয়ার চেয়ে এই পিঠা খাওয়া নিরাপদ। তাই আমি সহ বাচ্চাদের জন্যও পিঠা নিতে এখানে এসেছি। প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় এখান থেকে পিঠা নিয়ে যাই। আগের বছরগুলোতে ৫ টাকা পিস পিঠা কিনেছি, এখন সেটা কিনতে হচ্ছে ১০ টাকায়। শাহাবাগের মোড়ে পাবলিক লাইব্রেরির ঠিক গেটের মুখে পিঠা খেতে খেতে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কামাল হোসেন নামে একজন ছাত্রের সাথে। তিনি বলেন, যখন গ্রামে ছিলাম তখন শীতের সকালে আম্মু প্রায়ই খেঁজুরের রস বা গুড় দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরি করতেন। সকালের নাস্তা হিসেবে শীতের পিঠার সাথে অন্য কিছুর তুলনা হয় না। কিন্তু ঢাকাতে এসে সেই সুযোগ তো আর পাই না। তাই রাস্তার মোড়ে এসে সন্ধ্যার সময় গুড়ের তৈরি ভাপা পিঠা খেয়ে ওই স্বাধ নেয়ার চেষ্টা করছি। আসলে পিঠা তো আমাদের ঐতিহ্য, এটাকে রক্ষা করা উচিত আমাদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার টিএসসি মোড়ের আবদুর রহিম নামের এক পিঠা বিক্রেতার দোকানে বেশ ভিড় জমে সন্ধ্যার পর পর। প্রতিদিন বিক্রি করেন দুই থেকে ৩ হাজার টাকা। প্রতিদিন হাজার টাকার বেশি লাভ হয় বলেও জানান আবদুর রহিম। তিনি জানান, প্রতিটি চিতই পিঠা ১০ টাকা এবং ডিম দিয়ে একেকটি পিঠা ৩০ টাকা রাখেন তিনি। তার কাজে সহায়তা করে ছেলে রফিকুল ইসলাম ও স্ত্রী আফরোজা বেগম। শুধু নান্নু আবদুর রহিমই নন, রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায়, অলিগলিতে শীতের সময় এলে কয়েক হাজার মানুষ পিঠা বিক্রিতে নেমে পড়েন। শীতকালের বাইরে তাদের বেশির ভাগই ফুটপাতে ফল, তরকারি বিক্রি করেন। শীত এলে বিক্রি করেন পিঠা। অবশ্য অনেকে সারা বছরই পিঠা বিক্রি করেন নির্দিষ্ট স্পটে।
জানা গেছে, রাজধানী ঢাকায় ফাস্টফুড সংস্কৃতির এই যুগেও শীতের গরম পিঠার জনপ্রিয়তা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। নগরের বিভিন্ন এলাকার ফুটপাতে গড়ে ওঠা মৌসুমি পিঠাপুলির দোকানে ক্রেতাদের ভিড়ই তার বড় প্রমাণ। বিকেল হতেই দোকানিরা তাদের পিঠার পসরা বসান ফুটপাথে কিংবা অলি-গলিতে। উনুনে আগুন জ্বেলে একের পর এক পিঠা বানাতে ব্যস্ত থাকেন তারা। অন্যদিকে ক্রেতারা গরম গরম পিঠা সাবাড় করতে থাকেন। মহানগরে বসেও গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী এই খাবার উপভোগ করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না অনেকে। এসব দোকানে ১০ টাকায় চিতই, তেলের পিঠা ১০ টাকা আর ভাপা পিঠা ২০ টাকায় পাওয়া যায়। চিতই পিঠার সঙ্গে সর্ষে, ঝাল ও শুঁটকি ভর্তার পাশাপাশি আট থেকে ১০ ধরনের ভর্তা মেলে ফ্রিতে। মৌসুমি এই পিঠা তৈরি ও বিক্রি করতে দোকানিরা বেশ উপভোগ করেন।
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ