* ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ * সিনিয়রিটি বা গ্রেডেশন লিস্ট মানা হয়নি * প্রকল্প পরিচালকের তালিকায় অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী * দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী প্রস্তাব পাঠিয়েছেন
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)’র প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে প্রস্তাবিত ১৬ জনের তালিকায় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী প্রকৌশলীদের স্থান দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে বোর্ড সদস্যরা জনপ্রতি মোটা অংকের ঘুষ আদায় করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এনিয়ে এলজিইডি ভবনে বিগত সরকারের সময় প্রতিহিংসার স্বীকার হয়ে বঞ্চিত প্রকৌশলীদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
বঞ্চিতরা ক্ষোভ প্রকাশ করে অভিযোগে বলেছেন, সুবিধাবাদি আওয়ামীপন্থি প্রকৌশলীকে ১৬ জন প্রকল্প পরিচালকের তালিকায় স্থান দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে জুনিয়রদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এলজিইডির সার্বিক নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় ২০০৫ ব্যাচের কর্মকর্তারা।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ সুপারিশে জ্যেষ্ঠতার তালিকা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, দীর্ঘ ১৬ বছর ভিন্ন মতাদর্শের হওয়া নির্যাতিত, বঞ্চিত ও বৈষম্যের স্বীকার জ্যেষ্ঠতার তালিকায় এগিয়ে থাকা প্রকৌশলীদেরকে উপেক্ষা করে গত সপ্তাহে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে ১৬ জন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের সুপারিশ পাঠায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, যাদের নাম সুপারিশ করা হয়েছে তারা আওয়ামী লীগের ১৬ বছরে বিভিন্ন জেলায় নির্বাহী প্রকৌশলী, প্রধান কার্যালয়ে লাভজনক প্রকল্পে বিভিন্ন পদে এবং প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। এরমধ্যে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শেখ নুরুল ইসলাম নিয়ম বহির্ভূতভাবে প্রকল্প পরিচালক হতে চায়। তার গ্রামের বাড়ী গোপালগঞ্জে। সে শেখ মুজিবর রহমানের মাজার পূজারী, কট্টর আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে এলজিইডিতে পরিচিত।
যাদের নাম প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার প্রস্তাব পাঠানো হয় তারা হলেন, শেখ নুরুল ইসলাম (ক্লাইমেট ডিজিস্টার রেজিলান্ট প্রকল্প) গ্র্যাডিশন সিরিয়াল নাম্বার ২৩, রেফায়েত নূর, গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ, নির্বাহী প্রকৌশলী সাপোর্টিং ব্রিজ (ইউনিয়ন পরিষদ কমপেক্স ভবন নির্মিত প্রকল্প) গ্র্যাডিশন সিরিয়াল নাম্বার- ১৩৯, লতিফ হোসেন নির্বাহী প্রকৌশলী (টাঙ্গাইল প্রোজেক্ট) গ্রাডিশন সিরিয়াল নাম্বার- ২০৩, মোহাম্মদ ফয়জুল হক, নির্বাহী প্রকৌশলী (গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প), সোনিয়া নওরিন, নির্বাহী প্রকৌশলী (নগর অবকাঠামো উন্নয়ন) (কুয়েত ফান্ড), গ্র্যাডিশন সিরিয়াল নাম্বার ৩০৬, মো. আব্দুস সালাম নির্বাহী প্রকৌশলী (এফডিএমএল প্রকল্প ট্রাডিশন রোহিঙ্গা প্রকল্প) গ্রাডিশন সিরিয়াল নাম্বার ২৮৪, মোহাম্মদ জাকির হোসেন, নির্বাহী প্রকৌশলী আইন শাখা (পার্বত্য চট্টগ্রাম পল্লী উন্নয়ন অবকাঠামো প্রকল্প) গ্র্যাডিশন সিরিয়াল নাম্বার ২১৬, মলয় চক্রবর্তী, গ্রামের বাড়ী গোপালগঞ্জের সীমান্তে ফরিদপুর জেলা, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ইমারজেন্সি অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রজেক্ট) গ্র্যাডিশন সিরিয়াল নাম্বার ৫০, মোঃ শরীফ হোসেন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (বৃহত্তর কুমিলা জেলার আমিন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প) ট্রেডিশন সিরিয়াল নাম্বার ৫৪, মো. রায়হান সিদ্দিকী রুয়েট ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি (প্রভাতী প্রকল্প) গ্রেডিশন সিরিয়াল নাম্বার ১০৯, মোহাম্মদ মাকসালিন, নির্বাহী প্রকৌশলী, (বৃহত্তর রংপুর জেলার গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প) গ্রাডিশন সিরিয়াল নাম্বার ১০৫, নাজনীন নাজ, নির্বাহী প্রকৌশলী (রংপুর বিভাগের নয়টি পৌরসভার উন্নয়ন প্রকল্প) গ্র্যাডিশন সিরিয়াল নাম্বার ১১২, মোহাম্মদ আজিজুর রহমান নির্বাহী প্রকৌশলী (পৌরসভার পরিচ্ছন্ন কর্মীদের আবাসিক ভবন নির্মাণ প্রকল্প), গ্র্যাডিশন সিরিয়াল নাম্বার ২৫৬, মো. সিরাজুল ইসলাম, নির্বাহী প্রকৌশলী (কুমিল্লা ব্রাহ্মণবাড়িয়া চাঁদপুর জেলার গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প) গ্র্যাডিশন সিরিয়াল নাম্বার ১২৯, অমিতাভ সানা নির্বাহী প্রকৌশলী খুলনা বাগেরহাট সাতক্ষীরা জেলার গ্রামীন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রেডিশন সিরিয়াল নাম্বার ১৬৫, ফায়জুল, নির্বাহী প্রকৌশলী (পটুয়াখালী বরগুনা প্রকল্প) গ্রেডিশন সিরিয়াল নাম্বার ২৭৫।
এই বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সিনিয়র নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, আমরা আওয়ামী সরকারের সময়ে ভিন্ন মতাদর্শের হওয়ার ফলে দীর্ঘদিন বঞ্চিত এবং বৈষম্যের স্বীকারসহ নানা হয়রানীর তোপে ছিলাম। অথচ, গ্রাডিশন তালিকায় সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও কট্টর আওয়ামী পন্থী সকলের নাম প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়। এখানে অনেকের নাম আছে যারা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমানোর জন্য আর্থিকভাবে সহযোগীতা করেছে। আমরা স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার নিকট এই বিষয়ে অভিযোগ জানাবো বলে তারা জানান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এলজিইডিকে গতিশীল করতে কয়েকটি প্রকল্পের পিডি পরিবর্তন ও নতুন প্রকল্পের জন্য পিডি নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয় বেশ কিছু দিন আগে। বিগত সরকারের সময় সদ্য সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আলি আখতার হোসেন ১৬ জনের একটি তালিকাও চূড়ান্ত করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেন।
অভিযোগ উঠেছে ওই তালিকায় সিনিয়রিটি বা গ্রেডেশন লিস্টের তোয়াক্কা না করে মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে অপেক্ষাকৃত জুনিয়রদের প্রাধান্য দিয়ে নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের সময় ওই তালিকা পুনর্মূল্যায়নের জন্য ফেরত পাঠানো হয় এলজিইডিতে। রুটিন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী গোপাল কৃষ্ণ দেব নাথ পিডি নিয়োগ প্রস্তাব পাঠাতে তৎপরতা শুরু করেন এবং গত সপ্তাহে ১৬ জনের একটি প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেন।
এ প্রস্তাব পাঠানোর পর এলজিইডিতে ব্যাপক সমালোচনা ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এবারও প্রস্তাবে সিনিয়রিটি বা গ্রেডেশনের তোয়াক্কা না করে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর যোগসাজশে জুনিয়রদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সূত্র জানায়, এখানেও ঘুষের পরিমাণকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এই তালিকা তৈরিতে সক্রিয় ছিল তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রশাসন) মাহবুবুর রহমান, নির্বাহী প্রকৌশলী (প্রশাসন) আবু হানিফ মৃধা, জাকির হোসেন নির্বাহী প্রকৌশলী (আইন)।
সূত্র আরো জানায়, পিডি নিয়োগ প্রস্তাবের তালিকায় প্রকল্পের বরাদ্দের পরিমাণের উপর ঘুষের রেট নির্ধারণ করা হয়েছে। এর পরিমাণ ৫০ লাখ থেকে দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত। এই হারে ওই ১৫ জনের নিকট থেকে প্রায় এগারো কোটি টাকা ঘুষ লেনদেনের চুক্তি হয়। জানা যায় চুক্তির প্রায় অর্ধেক পাঁচ কোটি টাকা নগদ আদান প্রদান হয়েছে।
পিডি নিয়োগ প্রস্তাবে প্রার্থী সংগ্রহ ও দর কষাকষির কাজ করেছেন শফিকুর রহমান, ফারুক হোসেন, সাইফুল ইসলাম, ফেরদৌস আহমেদ ও জাকির হোসেন।
সূত্র আরও জানায়, শফিকুর রহমান কয়েক বছর পূর্বে এলজিইডির ম্যাকানিক্যাল শাখা থেকে অবসরে যায়। আ.লীগ সরকারের পতনের পর সে আবার এলজিইডিতে আস্তানা গেড়েছে। বর্তমানে তিনি পিডির প্রস্তাব পাঠানোসহ নির্বাহী প্রকৌশলী বদলির তদবিরে ব্যস্ত।
ফারুক হোসেন বর্তমান কর্মস্থল নির্বাহী প্রকৌশলী, সাপোর্টিং ব্রীজ প্রকল্প। তিনি অনিয়ম দুর্নীতিতে সিদ্ধহস্ত বলে এলজিইডি সংশ্লিষ্টদের কাছে ব্যাপক পরিচিত। ইন্ডিভিজুয়াল কনসালটেন্ট নিয়োগে তদবির করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আলি আখতার হোসেন মিটিংয়ে বলেন, ফারুক হোসেন ঘুষ নিয়ে কনসালটেন্ট নিয়োগের তদবির করেন এবং ঘুষের টাকায় উক্ত ফারুক হোসেন বসুন্ধরায় আলিশান বহুতল ভবন বানিয়েছেন এমন অভিযোগ রয়েছে।
মোহাম্মদ জাকির হোসেন এলজিইডির আইন শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী। তিনি এলজিইডিতে কেসের বন্যা বইয়ে দিয়েছেনে এমন অভিযোগ এলজিইডি সংশ্লিষ্টদের। প্রমোশনসহ কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে প্রায় তিন শতাধিক মামলা চলমান। এরমধ্যে প্রায় ডজন খানেক মামলা প্রমোশন বঞ্চিতদের। তাদের পক্ষে মহামান্য আদালত রায় দিলেও জাকির হোসেন ‘গ্রেডেশন বা সিনিয়রিটি ব্রেক করে রায় পাওয়াদের প্রমোশন দিলে এলজিইডিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে’ উল্লেখ করে প্রমোশন দেয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে মতামত দিয়েছেন। অথচ তিনি নিজেই ২১৫ জন সিনিয়রকে টপকিয়ে পিডি প্রস্তাবে নাম লিখিয়েছেন! এবং তিনি নিজেই সকল প্রকার অনিয়ম উপেক্ষা করে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আইন শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী পদে নিযুক্ত আছেন!
ফেরদৌস আহমেদ পল্লী সড়কে গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী। বর্তমান রুটিন দায়িত্ব পাওয়া প্রধান প্রকৌশলী গোপাল কৃষ্ণ দেব নাথ এর নিকট ২০০৫ ব্যাচের হানিফ মৃধা, ফেরদৌস আহমেদ, ফারুক হোসেনসহ কয়েকজন অনেকটা আদেশের সুরে বলেছিল এলজিইডি ২০০৫ ব্যাচের হাতে উড়িয়ে দিতে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
এলজিইডি’র ১৬ প্রকল্প
প্রস্তাবিত পরিচালকের তালিকা নিয়ে অসন্তোষ
- আপলোড সময় : ১৪-১১-২০২৪ ১২:১৯:৪২ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৪-১১-২০২৪ ১২:১৯:৪২ পূর্বাহ্ন
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ