
মাদকসেবীদের আড্ডা
আ’লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এখন ভূতুড়ে
- আপলোড সময় : ২১-১০-২০২৪ ০৪:১৭:৪৩ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২১-১০-২০২৪ ০৪:১৭:৪৩ অপরাহ্ন


১৯ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ কার্যালয়ে অফিস ভাড়া ও বকেয়া বিদ্যুৎ বিল অর্ধকোটি টাকা, অসহায় ভবনটির মালিক
গত ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। এরপর পর সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন, ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ কেন্দ্রীয় ও ধানমন্ডিস্থ আওয়ামী লীগের কার্যালয়সহ বিভিন্ন থানা ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুন দেয় দূবৃত্তরা। লুটপাট করা হয় এসব ভবনের বিভিন্ন ধরনের মালপত্র। রাজধানীর থানাসহ অন্যান্য ভবনগুলোকে মেরামত করা হলেও এখনো পরিত্যাক্ত অবস্থায় রয়েছে ধানমন্ডি ও ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ দলীয় অফিস।
সরেজমিনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঘুরে দেখা গেছে, একসময়ে ২৪ ঘন্টা সরগরম থাকা ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগ অফিস এখন পোড়া ভবন। ইতিমধ্যেই এর ভেতর থেকে বিভিন্ন ধরনের মালপত্র খুলে নেয়া হয়েছে। নিচতলায় এখনো আগুনে পোড়া ছাই, ভাঙা কাচ, পোড়া কাঠ ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। দ্বিতীয় তলার ফ্লোরে পানির সঙ্গে মিশে আছে পোড়া কাগজপত্র ও বিভিন্ন আসবাবের অংশ। আগুনে পুড়ে যাওয়া কাগজপত্রসহ ভাঙা কাচ এখনো বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের মাদকের বোতল দেখা গেছে প্রতিটি তলায়। এসব ফ্লোরের রুমের দরজা-জানালার গ্রিলের পাশাপাশি নিচতলার বড় কাঠের দরজাটিও খুলে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। ভবনটির সামনের অংশে স্টিলের অক্ষরে লেখা ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ ও ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালের অস্তিত্ব নেই। তবে ভাঙা অবস্থায় দলীয় প্রতীক নৌকা ঝুলতে দেখা গেছে। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে নামফলক। নেতাকর্মীশূন্য দলের স্থায়ী কার্যালয়টি এখন পরিত্যক্ত ভবন। যা ভাসমান মাদকসেবী ও পথশিশুদের আড্ডাস্থল হয়ে ?উঠেছে। তবে দলীয় কার্যালয়ের আশপাশের দোকানি ও ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত ৫ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত নেতাকর্মীদের সরগরম উপস্থিতি ছিল। কিন্তু দুপুর ১টায় পরিস্থিতি অনুমান করতে পেরে কার্যালয়ের প্রধান ফটকে তালা দিয়ে চলে যায় তারা। এরপর তিন দিক থেকে কার্যালয়ে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। পরের দু’দিন কার্যালয়ের ভেতর-বাইরে ব্যাপক লুটপাট হয়। এ সময় যেহেতু দেশের আইনশৃঙ্খলা-পরিস্থিতি খারাপ ছিল, তাই কেউ কাউকে বাধা দেয়নি। কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার আন্দোলন সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে রূপ নিলে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটে। সেদিন রাজধানীর রাস্তায় লাখ-লাখ মানুষের বিজয় মিছিল বের হয়; বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করে। সে থেকে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়টিতে ভূতড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে। তারা জানান, দলীয় নেতাকর্মী ও দারোয়ানবিহীন এই পোড়া ভবনটি এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এটি মূলত এখন মাদকসেবীসহ পথশিশুদের আড্ডাস্থল। যেখানে মাদকসেবনসহ ভাসমান অপরাধীদের কার্যকলাপ চলে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে কর্মরত এক কর্মকর্তা বলেন, ৫ আগস্টের পর ওখানে যাওয়া হয়নি। কেবল ১৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পর দূর থেকে দেখে এসেছি। ভেতরে ঢোকার সাহস হয়নি। আবেগআপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। তাই বর্তমানে কী অবস্থায় আছে তা বলতে পারব না। আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের পাশের এক ব্যবসায়ী বলেন, ২৫ বছর ধরে এখানে ব্যবসা করি। এই দীর্ঘ সময়ে কখনও নেতাকর্মীহীন ভূতুড়ে অবস্থায় দেখিনি আওয়ামী লীগ কার্যালয়। কিন্তু এবার দেখছি। ঢাকার গুলিস্তান এলাকায় ১০ তলাবিশিষ্ট ভবনটি ছিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। ২০১৮ সালের ২৩ জুন এই ভবনটি উদ্বোধন করেন দলের সভাপতি ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পুরাতন ভবনটি ভেঙে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে আট কাঠা জমির ওপর নির্মিত দৃষ্টিনন্দন ভবনটি ছিল আওয়ামী লীগের স্থায়ী ঠিকানা। কার্যালয়ের জায়গাটি ৯৯ বছরের জন্য সরকারের কাছ থেকে ইজারা নেয়া হয়েছে।
অফিস ভাড়া ও বকেয়া বিদ্যুৎ বিল অর্ধকোটি টাকা: ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ ও দলের সহযোগী সংগঠনগুলো গত ১৫-৭-২০১৬ সালে জোরপূর্বক দখলে নেয় ১৯ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ মো: মামুনুর রশীদের ৬ তলা একটি ভবন। তবে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার পলায়নের পর তিনদিন ধরে হামলা-ভাঙচুর হয় ভবনটিতে। এতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগসহ দলের সহযোগী সংগঠনের সবকটি অফিস আগুন দিয়ে লুটপাট করে দুবৃত্তরা। বাদ যায়নি মালিকের ব্যাক্তিগত অফিসও। জানা গেছে, গত ১৫ জুলাই ২০১৬ সালে ভবনটি জোরপূর্বক সরকার দলীয় নেতারা দখলে নেয়ার পর থেকে বিদ্যুৎ বিল বাবদ প্রায় ৩৩ লক্ষ টাকা, পানির (ঢাকা ওয়াসা) বিল প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স সাড়ে ৩ লক্ষা টাকা বকেয়া রয়েছে। ১৫-৭-১৬ থেকে সর্বশেষ ৫-৮-২৪ ইং পর্যন্ত (গত ৮ বছরে) মোট বকেয়া অর্ধকোটি টাকার বেশি। তবে এসব বিল নিয়ে ভবনটির মালিক এখন মহাবিপাকে পড়েছে। অর্থের অভাবে ভবনটির সংস্কার কাজই ঠিকমত করতে পারছে না ভবনটির মালিক মো: মামুনুর রশীদ। তার উপর সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সহযোগী সংগঠনের নেতাদের ব্যবহৃত সরকারি সকল বিল দেয়ার জন্য চাপ আসছে। তবে ভয়ে এখনো আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মীদের নাম প্রকাশ করছেন না ভবনটির মালিক। এমনিতেই ভবনটি দখলে নেয়ার পর কোনো ভাড়া তাকে পরিশোধ করেননি কেউ। তবে দলটির তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা বলছেন, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগ অফিসের ভাড়া বকেয়ার বিষয়টি অত্যান্ত দু:খজনক। এজন্য ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের উদাসীনতাকেই দুষছেন নেতাকর্মীরা। তাদের দাবি, দল ক্ষমতায় থাকতে শীর্ষনেতারা নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত ছিলেন, দলীয় অফিসের দিকে নজর দিতে সময় পাননি। এমনকি অন্যোর ভবন দখলে নিয়ে অফিস করলেও ভাড়া তো দূরের কথা, বিদ্যুৎ বিল, ওয়াসা বিল এবং হোর্ল্ডি ট্যাক্স ও দিতে পারেনি। এরচেয়ে লজ্জা আর কিছুই হতে পারে না। তবে এ বিষয়ে কথা বললে ভবনটির মালিক মো: মামুনুর রশীদ বলেন, আমি নিরিহ মানুষ, কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ নাই। আওয়ামী লীগের লোকজন গত ৮ বছর যাবত ভবনটি দখলে রেখেছে এবং দলীয় অফিস বানিয়ে সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত করেছে। তারা আমাকে কোনো ভাড়া দেয় নাই এবং প্রায় অর্ধকোটি টাকার সরকারি বিল বকেয়া হয়েছে। কোনোটাই পরিশোধ করে নাই। সরকারি অফিসের লোকজন এখন আমাকে বিদ্যুৎ বিলসহ সব দিতে চাপ দিচ্ছে। আমি কিভাবে সেইসব বিল পরিশোধ করবো জানি না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আমার আহ্বান আওয়ামী লীগের অফিসের নেতাদের রেখে যাওয়া বকেয়া বিল থেকে আমাকে মওকুফ করা হোক। আমি এসব বিল দিতে না পারায় অসহায় অবস্থায় আছি।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের ফলে আওয়ামী লীগ সভাপতি দেশ ছেড়ে চলে যায়। এর পর ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, ধানমন্ডি ৩/এ আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়, দলের নির্বাচনি কার্যালয় এবং তেজগাঁও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পাশাপাশি ধানমন্ডি ৩২-এ বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, গণভবন, সুধাসদনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ