* ১২টি নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে, যার মধ্যে ডিমের দাম ১৮০-২০০ টাকায় পৌঁছেছে এক সপ্তাহে
* খাদ্য কেনার জন্য ৪২ শতাংশ মানুষকে ঋণ করতে হচ্ছে
* খাবার কেনার খরচ মেটাতে গিয়ে স্বাস্থ্য ব্যয় কমিয়েছেন ২৬ শতাংশ মানুষ
অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণের ফলে মানুষ হার্ট ও কিডনির সমস্যাসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এটি তাদের কর্মক্ষমতাও কমিয়ে দিচ্ছে
ড. মোহাম্মদ শোয়েব, সদস্য, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ
রাজধানীসহ সারাদেশে প্রতিদিন লাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে দ্রব্যের মূল্য। সে তুলনায় বৃদ্ধি পাচ্ছে না সাধারণ মানুষের আয়। প্রতিনিয়ত হিসাব মেলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন যুক্তি উত্থাপন করা হলেও মানুষের মাঝে আশার সঞ্চার হচ্ছে না। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত সমাজের অবস্থা আরও বেগতিক। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা মাইকে গলা ফাটিয়ে বক্তব্য দিলেও কোনো কাজে আসছে না বরং দেখে মনে হচ্ছে, সবকিছুই যেন সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বিশ্ববাজারের দোহাই দিয়ে ব্যবসায়ীরা অবৈধ মুনাফা অর্জনের নেশায় মত্ত হয়ে পড়েছে। দেশে অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় এক কোটি। নিত্যপণ্যের দাম না কমলে, খাদ্য তালিকায় আরও কাটছাঁট করতে বাধ্য হবেন স্বল্প আয়ের মানুষ। এমনই এক অবস্থায় গতকাল বুধবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও পালন হয়েছে বিশ্ব খাদ্য দিবস।
জানা গেছে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে অতীতের সঞ্চয়কে নষ্ট করছে কিংবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে জীবন-যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলোর সমন্বয় সাধন করছে। বাজারের নিত্যপণ্যের মধ্যে চাল, ডাল, তেল, মসলা, সিলিন্ডার গ্যাসের সমন্বয় করতে গিয়েই সারা মাসের বাজেট ব্যয় করতে হচ্ছে। বর্তমানে কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৮০-২৯০ টাকায়। ব্রয়লার মুরগির কেজি ২০ টাকা বেড়ে হয়েছে ২১০ টাকা। ইলিশ কেজিতে ৩০০-৪০০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে ১৭০০ টাকায়। যা কয়েকদিন আগেও বিক্রি হয়েছে ২০০০-২১০০ টাকায়। তেলাপিয়া মাছ ২২০ টাকা থেকে ২৪০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। চিংড়ি মাছ ৮২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাতলা মাছ প্রতি কেজি ৫২০ টাকা বিক্রি করছে ব্যবসায়ীরা। গতকাল বুধবার বরবটির কেজি ছিল ১৪০ টাকা, যা মঙ্গলবার বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকা কেজি। ৮০ টাকার পটল ১০০ টাকা, ৮০ টাকার করোলা বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা। ২৬০ থেকে ২০ টাকা কমে টমেটো বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকায়। ১০০ টাকার শসা পাওয়া যাচ্ছে ১২০ টাকায়। করোনার প্রভাব কাটিয়ে যখন স্বাভাবিক পথে ফিরে আসছিল সারা পৃথিবীর অর্থনীতি, সে সময় আবার ধাক্কা লাগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। আমদানি-রপ্তানিতে পড়ে ব্যাপক প্রভাব। যুদ্ধ ও করোনার ফলে আমদানিতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে বলে অন্যায়ভাবে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত অথচ অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে যার মাঝে আমদানির প্রভাব পড়ার কথা না। দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া কিন্তু সেটা যদি হয় লাগামছাড়া তাহলে মানুষের মাঝে অস্থিরতা তৈরি হবে এটাই স্বাভাবিক। বেশি কষ্ট হচ্ছে যাদের আয় সীমিত এবং প্রতিনিয়ত আয়ের পরিবর্তন হচ্ছে না। তাদের পক্ষে হিসাব মেলানো অনেক কঠিন হয়েছে। মাসের শুরুতে সারা মাসের খরচের জন্য যে বরাদ্দ রাখা হয় তা দিয়ে সারা মাসের খরচ মেটানো যাচ্ছে না, যার ফলে গচ্ছিত টাকা ও ঋণের মাধ্যমে ব্যালেন্স করতে হচ্ছে নতুবা প্রয়োজনীয়তাকে জলাঞ্জলি দিতে হচ্ছে। পরিবারের খরচ মেটাতে না পারার কারণে অনেকেই যেমন হতাশাগ্রস্ত হচ্ছে অন্যদিকে বিভিন্ন অপকর্মেও পা দিচ্ছে। তা ছাড়াও সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর যেসব ব্যবস্থা রয়েছে তাও সঠিকভাবে আয়ের দিক দিয়ে নিম্নশ্রেণির মানুষের কাছে পৌঁছছে না।
এমন পরিস্থিতিতে গতকাল বুধবার ছিলো বিশ্ব খাদ্য দিবস। কৃষি মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) উদ্যোগে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচিতে পালিত হয়েছে দিবসটি। দিবসটির উদ্দেশ্য ছিলো বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা গড়ে তোলা। খাদ্য দিবস উপলক্ষে কৃষি মন্ত্রণালয় গতকাল বুধবার সকাল ১০টায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল মিলনায়তনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। খাদ্য দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘উন্নত জীবন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য খাদ্যের অধিকার’।
দেশের ২০ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। সিলেট ও বরিশাল অঞ্চলে এ হার সবচেয়ে বেশি, ২৪ শতাংশ। এতে আরও বলা হয়, পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে প্রয়োজনের চেয়ে কম খাদ্য গ্রহণ করছে দেশের ৩০ শতাংশ জনগোষ্ঠী। দেশের আট বিভাগের ১ হাজার ২০০ জনের ওপর পরিচালিত এক জরিপের ভিত্তিতে জাতিসংঘ বলেছে, সাম্প্রতিক বন্যায় কৃষি ও অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি হয়েছে।
জাতিসংঘের জরিপ বলে, খাদ্য কেনার জন্য ৪২ শতাংশ মানুষকে বিভিন্ন সময়ে ঋণ করতে হচ্ছে। আর খাবার কেনার খরচ মেটাতে গিয়ে স্বাস্থ্য ব্যয় কমিয়েছেন ২৬ শতাংশ মানুষ। সবশেষ সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। আর এসব মানুষের মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা সবচেয়ে বেশি।
অন্যদিকে বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে তিন ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। ক্ষুধা মেটানোর সক্ষমতার দিক দিয়ে ১২৭টি দেশের মধ্যে চলতি বছর বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। সূচকমতে, বর্তমানে ‘মাঝারি মাত্রার’ ক্ষুধা মোকাবিলা করছে বাংলাদেশ। গত ১১ অক্টোবর গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (জিএইচআই) বা বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক ২০২৪ প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়।
এদিকে কৃষি জমিতে অতিরিক্ত সার, ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার, কলকারখানার বর্জ্য, রঙ ও কেমিক্যাল, ফরমালিন এসবের যথেচ্ছা ব্যবহার এখন প্রকাশ্য। এতে মাটি, পানি, বাতাসসহ গোটা প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। তাই দেশে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের জন্য আবার একটি আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আন্দোলন ছাড়া মানুষকে সচেতন করা সম্ভব নয়। গতকাল বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত ‘নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করণে আমাদের করণীয়’ শীর্ষক একটি গোল টেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন বক্তারা। বাংলাদেশ সেফ ফুড এলায়েন্স এ আয়োজন করে। বৈঠকে বক্তারা বলেন, রাজধানীসহ শহরাঞ্চলে খোলা ও নোংরা জায়গায় যত্রতত্র বিভিন্ন খাবারের দোকান গড়ে উঠেছে। এ ধরণের খাবার খেয়ে মানুষ নানা রকম রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। পঙ্গু, বিকলাঙ্গ এবং মানসিক ভারসাম্যহীন শিশুর সংখ্যা প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে। এসব বিষয়ে আমাদের জনসাধারণকে সচেতন করে তুলতে হবে। বিসেফ ফাউন্ডেশনের অ্যাডভাইজার ড. মাহমুদুল ইসলাম বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্যের জন্য আবার একটি আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি জেলায় গিয়ে মানুষকে জানাতে হবে।’ শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম ভূইয়া বলেন, ‘কিছু কোম্পানির কাছে মানুষ জিম্মি হয়ে গেছে। যে খাবারটা ভালো, সেটা জানার পরও পাওয়া যাচ্ছে না। দেশে অর্গানিক খাবার থাকলেও, সেটা পাওয়া যায় না। প্রতিটি খাবার উৎপাদন থেকে খাওয়ার আগ পর্যন্ত ভেজালে পরিপূর্ণ।’ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘দেশে কৃষকদের গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের দাবিদার। সচিব, ম্যাজিস্ট্রেটসহ অন্যারা যে গুরুত্ব পান সেটা তারা পান না। ঢাকায় কিছু অভিযান করে সংবাদমাধ্যম আসা যায়, তবে সেটি কার্যকর কিছু হয় না।’ নিরাপদ খাদ্যে কর্তৃপক্ষের সদস্য ড. মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, ‘আমাদের অনেক কিছুই করার থাকে না। আমাদের এখান থেকে কেউ কখনও লাইসেন্স নেয় না। আমরা জানিই না বাংলাদেশে কতজন খাদ্য নিয়ে ব্যবসা করে।’ অনুষ্ঠানে অন্যান্যে মধ্যে ছিলেন- কৃষি ও পরিবেশ সংগঠক ব্রাত্য আমিন, নিরাপদ শপের শাহজাহান পাটোয়ারী প্রমুখ।
সূত্র আরও জানায়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষকে দ্বিগুণ দামে ডিম কিনতে হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে একটি ডিম কিনতে হয়েছে ১০ টাকার বেশি দামে। তা এখন বেড়ে হয়েছে প্রতি পিস ১৫ টাকা। আর ভারতে একটি ডিমের দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭ থেকে সাড়ে ৭ টাকা। বাংলাদেশে বন্যার কারণ দেখিয়ে ক্ষুদ্র খামারিরা জানান, ডিমের চাহিদা বাড়লেও দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ভয়াবহ বন্যায় পোল্ট্রি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে দৈনিক প্রায় ৫০ লাখ ডিমের উৎপাদন কমে গেছে। এর ফলে ডিমের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তারা বলেন, একটি ডিমের দাম ১১ টাকা ৮৭ পয়সা বেঁধে দেয় কৃষি বিপণন অধিদফতর। কিন্তু তাতেও বাজার নিয়ন্ত্রণে না এসে উল্টো দাম আরো বাড়তে থাকে। এই পরিস্থিতিতে সরকার সাড়ে ৪ কোটি পিস ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ফার্মের প্রতি ডজন ডিমের জন্য দোকানভেদে এখনও ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা গুণতে হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসের ব্যবধানে প্রতি পিস ডিমের দাম ১৩ শতাংশ এবং এক বছরে ২০ দশমিক ৪১ শতাংশ বেড়েছে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী, ডিম ও মুরগির উৎপাদনে ৭৫ শতাংশ খরচ খাবারের। ভারত ও বাংলাদেশে এই খরচের পার্থক্য অনেক বেশি জানিয়ে সংগঠনের নেতারা বলেন, খাবারের দাম কমালেই কেবল ডিম ও মুরগির দাম কমানো সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ভারতে প্রতি কেজি ফিডের দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৬ টাকা, আর আমাদের দেশে দাম ৬০ টাকা, প্রায় দ্বিগুণ। ভারতে বাচ্চার দাম ২৫ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ টাকা, আমাদের দেশে বর্তমানে ৮০ টাকা। কখনও কখনও ১২০ টাকা পর্যন্ত দাম উঠে যায়।
ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে মুরগির ওষুধের দামও তিনগুণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারতে ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ভারতে ৮২ টাকা, বাংলাদেশে তা কেন ১৭০ টাকা হবে। এর প্রধান কারণ, পোল্ট্রি খাদ্যের দাম। পোল্ট্রি খাদ্যশিল্পে ‘সিন্ডিকেট’ রয়েছে। সাধারণত, ডিম উৎপাদনের জন্য খামারিদের একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা কিনে লালনপালন করতে হয়। গত জুনের প্রথম সপ্তাহে ভারতে একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার দাম ছিল প্রতিটি ৩৫ থেকে ৫৬ টাকা। পাকিস্তানে ছিল ২১ থেকে ৪২ টাকা। বাংলাদেশে মুরগির বাচ্চার দাম ৭৪ থেকে ৮০ টাকা। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতে প্রতি ডজন ডিমের দাম ছিল বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮১ থেকে ৯৬ টাকা। পাকিস্তানে ছিল ৭৩ থেকে ১১৮ টাকা। বাংলাদেশে ওই সময় ডিম বিক্রি হয়েছে ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকায়।
পোল্ট্রি খাবার খাওয়ানোর মাধ্যমে খামারে মুরগি পালন করা হয়। ট্যারিফ কমিশনের সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুনের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে প্রতি কেজি মুরগির খাবারের (লেয়ার গ্রোয়ার) দাম ছিল ৫৭ থেকে ৫৯ টাকা। ভারতে ছিল ৩৭–৪৮ টাকা। পাকিস্তানে ছিল ৩৯ থেকে ৪১ টাকা। বাংলাদেশে গড় দাম ভারতের চেয়ে ৩৭ ও পাকিস্তানের চেয়ে ৪৬ শতাংশ বেশি। এছাড়া পোল্ট্রি খাদ্যের মূল উপকরণ ভুট্টা, সয়াবিন ইত্যাদি ভারত ও পাকিস্তান অনেকটাই উৎপাদন করে। বাংলাদেশকে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ব্যয় বেশি। আমদানিতে জাহাজ ভাড়া ও অগ্রিম আয়কর বাবদ ব্যয়ও আছে। ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুরগির ডিম উৎপাদন খরচের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ যায় পোল্ট্রি খাদ্যের দামের পেছনে। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সিন্ডিকেটের কারসাজিতে ডিমের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। হাতবদল ও চাঁদাবাজির জন্য ডিমের দাম বেড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, সাম্প্রতিক বন্যায় হাজার হাজার খামার একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে পানির জমে থাকার কারণে কম দামে দ্রুত মুরগি বিক্রি করে দিয়েছেন। কারও কারও মুরগি মরে যাওয়ার কারণে পুঁজি হারিয়েছেন। সব মিলেই ডিমের উৎপাদন কমে গেছে। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে ডিমের খামার রয়েছে ১৩ হাজার। গত দুই বছরে ৬ হাজারের মতো খামার বন্ধ হয়েছে।
এছাড়াও আমদানি স্বাভাবিক থাকার পরেও যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরসহ স্থানীয় সব খুচরা বাজারে কাঁচা মরিচের দাম বেড়েছে কেজিতে ১৫০-২০০ টাকা। কারণ হিসেবে দুর্গাপূজার জন্য টানা পাঁচ দিন আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকার কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা। তবে মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে এমন দাম বৃদ্ধিতে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ ক্রেতারা। খুচরা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আমদানি বাড়লেও আড়তে তেমন কমেনি কাঁচা মরিচের দাম। টানা পাঁচ দিন বন্দর বন্ধ থাকবে জেনে কাঁচামাল গুদামজাত করে দামবৃদ্ধি করেছেন আড়তদাররা। গতকাল বুধবার সকালে বেনাপোল ও শার্শার একাধিক বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সপ্তাহ আগেও এইসব বাজারে ভারত থেকে আমদানি করা কাঁচা মরিচ খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছিল ৮০-১০০ টাকা কেজি। গতকাল তা বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৪০০ টাকা কেজি দরে। এদিকে, গত দুই দিনে এ বন্দরে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে কাঁচা মরিচের আমদানি। সোমবার একদিনে ৫০ ট্রাকে ৫৮১ টন ৯৭০ কেজি কাঁচা মরিচ আমদানি হয়। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১২ ট্রাকে ১৪৪ টন কাঁচা মরিচ আমদানি হয়েছে। কেনা থেকে শুরু করে শুল্ককর মিলিয়ে আমদানি করা এই মরিচের কেজিপ্রতি খরচ পড়েছে ৯৬-১০০ টাকা। অথচ যশোরের শার্শা উপজেলার বিভিন্ন বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৩৮০-৪০০ টাকা কেজি। তবে বন্দর বন্ধ হওয়ায় মরিচের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে বলে আশঙ্কা করছেন সাধারণ বিক্রেতারা। বেনাপোল চেকপোস্ট বাজারে কাঁচা মরিচ কিনতে আসা ফজলুর রহমান বলেন, ‘এক সপ্তাহ আগেও মরিচ কিনেছিলাম ৯০ টাকা কেজি। আজ (গতকাল) দেখছি ৩৫০ টাকা কেজি। এভাবে চললে আমরা চলবো কী করে?’ কাঁচা মরিচ কিনতে আসা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বেনাপোল স্থলবন্দর এলাকার বাসিন্দা। শুনছি এবং দেখছি, এই বন্দরে প্রচুর কাঁচামরিচ আমদানি হচ্ছে। সেই হিসেবে তো ১০০ টাকার নিচে দাম হওয়া দরকার। অথচ এখনও আমাদের ৩৫০-৪০০ টাকা কেজির ওপরে কাঁচামরিচ কিনে খেতে হচ্ছে।’
বেনাপোল বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী রাশেদ আলী বলেন, ‘বেশি দামে মরিচ কিনতে হচ্ছে, তাই বেশি দামে বিক্রি করছি। সব সবজি এবং পেঁয়াজের দামও আকাশ ছোঁয়া। তবে পূজার কারণে পোর্ট বন্ধ থাকায় বাজারে বড় বড় ব্যবসায়ীরা বস্তা বস্তা কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ মজুত করেছিল, দাম বেশি পাওয়ার আশায়।’ আমদানি স্বাভাবিক হলে আবার দাম কমে যাবে। বেনাপোল বন্দরের পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচ আমদানিকারক রফিকুল ইসলাম রয়েল বলেন, ‘পেঁয়াজে তেমন পড়তা না থাকায় এখন কাঁচা মরিচ আমদানি করছি। বর্তমান কাঁচা মরিচ আমদানি অনেক বেশি হচ্ছে। বাজারে মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টা শিগগিরই কেটে যাবে। গত দুই দিনে ৬২ গাড়ি কাঁচা মরিচ আমদানি হয়েছে এই বন্দর দিয়ে।’ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের শার্শা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নুসরাত ইয়াসিন জানিয়েছেন, তারা নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করছেন। ক্রয়-বিক্রয় রশিদ, মূল্য তালিকা, বাড়তি দামে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে কিনা- সবকিছু খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মরিচের দামে কোনো কারসাজি হচ্ছে কিনা তাও যাচাই করা হবে।
পুষ্টিবিদদের মতে, দেশে একদিকে যেমন কমছে উৎপাদন ক্ষমতা, তেমনি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়া মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে হু হু করে। দুই পা নেই-এমন একজন বৃদ্ধা। বাড়ির পাশে বাজারেও জিনিসপত্রের দামে আগুন। তাই রাজধানীর বাংলামোটরে তিনি এসেছেন ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবির) ট্রাক থেকে চাল-আটা কিনতে। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সবার মতো এট যেন দ্রব্যমূল্যের কাছে তারও অসহায় আত্মসমর্পণ। সবার বক্তব্য প্রায় একই। বাজারে নিত্যপণ্যের দামে আগুন; তাই কম দামে কিনতে এসেছেন টিসিবির ট্রাকের লাইনের সামনে। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। খাদ্যের জন্য বেঁচে থাকা, নাকি বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য? দুকেজি চাল কম দামে কেনার জন্য দুঘণ্টা সূর্যের প্রখর রোদ গায়ে মেখে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর উত্তর, খাদ্যের জন্যই এ কষ্ট।
বাঁচতে হলে দরকার সুষম খাদ্য কথাটা জানেন সবাই। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে পর্যাপ্ত খাদ্য নিশ্চিত করাও যেন কারও কারও জন্য বিলাসিতা। অনেকের ঘরে আবার মাঝেমধ্যেই জ্বলে না উনুনও। করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ; এখন আবার সিন্ডিকেটের কারণে বাজারে আগুনের বেজায় তাপ। এতে দিন দিন বেড়েই চলেছে ওএমএসের লাইনে দাঁড়ানো মানুষের সংখ্যা। পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, দেশে অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কম করে হলেও এক কোটির মতো।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু ইউসুফ বলেন, ব্যয় বাড়ায় চাপের মধ্যে আছে সাধারণ মানুষ। তাই ওএমএস ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতা আরও বাড়াতে হবে। এ যখন অবস্থা, তখন সুষম পুষ্টির চিত্রটা যে ভালো হবে না, সেটাই স্বাভাবিক। কম দামে অল্পসংখ্যক খাদ্যপণ্য কেনার কারণে অতি দরিদ্র মানুষের উৎপাদন ক্ষমতাও যাচ্ছে কমে।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য ড. মোহাম্মদ শোয়েব বলেন, অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণের ফলে মানুষ হার্ট ও কিডনির সমস্যাসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এটি তাদের কর্মক্ষমতাও কমিয়ে দিচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, সুস্থ থাকার জন্য যে পরিমাণ খাবার গ্রহণ করা উচিত, সেটি মানুষ পাচ্ছে না। নিত্যপণ্যের দামের প্রভাবে অনেকেরই পুষ্টিকর খাদ্য কেনা সম্ভব হচ্ছে না। এর প্রভাব পড়ছে তাদের স্বাস্থ্যের ওপর।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া
- আপলোড সময় : ১৭-১০-২০২৪ ১২:২৫:৩৭ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৭-১০-২০২৪ ১২:২৫:৩৭ পূর্বাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ